ভিশন ২০৩০-এর আওতায় সৌদিতে নানা ধরনের সংস্কার শুরু করেছেন সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। সৌদির এই ডি-ফ্যাক্টো নেতা সরকারের অংশ হওয়ার পর সেখানে আইন সংস্কারের পাশাপাশি এসেছে বড় সামাজিক পরিবর্তন। অভিযোগ রয়েছে, অত্যাচার-নিপীড়নের মাধ্যমে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে রেখেছেন মোহাম্মদ বিন সালমান। কেউ কেউ মনে করছেন, সংস্কারের নামে ধর্ম ধ্বংসের খেলায় মেতেছেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ।
করোনার সংক্রমণ বাড়ায় গত ৩০ ডিসেম্বর মুসলমানদের পবিত্রতম স্থান মক্কা ও মদিনায় বিধিনিষেধ আরোপ করে সৌদি আরবের সরকার। মুসল্লিদের দুই মিটার দূরত্ব মেনে চলার নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু সৌদি আরবের ডিফ্যাক্টো নেতা মোহাম্মদ বিন সালমান পুরো সৌদি আরবের আর কোথাও বিধিনিষেধ আরোপ করেননি। সৌদি আরবের অন্য শহরগুলোতে কোনো রকম বিধিনিষেধ ছাড়াই চলছে কনসার্ট ও অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠান। সৌদি সরকারের একটি অনুষ্ঠানে গত মাসে ৭০ হাজার সৌদি নাগরিককে জড়ো করা হয়েছিল। মূল উদ্দেশ্য ছিল চার দিনব্যাপী নৃত্যানুষ্ঠান।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভিশন ২০৩০-এর আওতায় সৌদিতে এমনই নানা সংস্কার শুরু করেছেন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। এর ধারাবাহিকতায় নারীদের গাড়ি চালানো, মাঠে বসে খেলা দেখা ও সিনেমা হল চালুর অনুমতি দিয়েছে যুবরাজের আজ্ঞাবহ সৌদি সরকার। পাশাপাশি সৌদি আরবে ‘নাইট ক্লাব’ চালু করা হয়েছে।
গত বছরের এপ্রিলে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌদি আরবের স্কুলগুলোতে ভারতীয় সংস্কৃতি, ইতিহাস, যোগ বা আয়ুর্বেদ নিয়ে চর্চার পরিকল্পনা করেছেন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান।
জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত মাসে সৌদিতে নিষিদ্ধ হয় তাবলিগ জামাত। সৌদি আরবের ইসলামিক অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রী তখন জানিয়েছিলেন, ইসলামের পাঠ দেওয়ার নামে বিশ্বজুড়ে সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করছে তাবলিগ। সে কারণেই তাদের সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক রাখা যাবে না। দাওয়া গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও একই ফতোয়া জারি করা হয়েছে।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের মে মাসে সৌদি আরবের ইসলামিক অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছিল যে, মসজিদে উচ্চ শব্দে মাইক বাজানো যাবে না। মসজিদের লাউডস্পিকারের ভলিউম সর্বোচ্চ তিন ভাগের এক ভাগ পর্যন্ত বাড়ানো যাবে। এই নির্দেশনায় ওয়াজ মাহফিল বা অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পরিবর্তে বিশেষ করে আজানের সময় লাউডস্পিকারের ভলিউম নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। সৌদি সরকারের এমন সিদ্ধান্তে সেখানকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিন্দার ঝড় ওঠে। সমালোচকেরা হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে রেস্তোরাঁ ও ক্যাফেতে উচ্চ শব্দে মিউজিক বাজানো নিষিদ্ধ করার দাবি তুলতে শুরু করেন।
এ নিয়ে মদিনা শহরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক মনে করেন, এই সরকার পুণ্যলাভের পথ বন্ধুর করে তুলছে। আর করছে অপকর্মের প্রচার।
সৌদি আরবের সালাফিরা মনে করেন, মোহাম্মদ বিন সালমান তাঁদের সঙ্গে সৌদি রাজপরিবারের সম্পর্ক নষ্ট করেছেন। তিনি সৌদির ধর্মীয় পুলিশের ক্ষমতা কমিয়েছেন। ফলে এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য দোকান ও রেস্টুরেন্ট জোর করে বন্ধ করা যায় না। এ ছাড়া নারীর গালে পুরুষের চুম্বনের বিষয়টিতেও তাঁরা আর বাধা দিতে পারেন না।
এদিকে রাজধানী রিয়াদে শুক্রবারের জুমার নামাজের খুতবায়ও সরকারের প্রশংসা করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোয় জনপ্রিয় ধর্মগুরুদের কোনো কিছু টুইট করতে নিষেধ করে দিয়েছে সৌদি সরকার। তবে সৌদি আরবে সালাফি মতাবলম্বী অনেকে মুখে সরকারের সমালোচনা করে যাচ্ছেন। রিয়াদে হওয়া শীতকালীন উৎসব নিয়েও আপত্তি তুলেছেন সালাফি ধর্মগুরুরা। ওই উৎসবে ঘোড়দৌড়সহ বিভিন্ন ধরনের খেলা ও গানের ব্যবস্থা ছিল। সালাফিদের অভিযোগ, যুবরাজ মোহাম্মদ সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে খেলছেন।
সৌদি আরবের জেদ্দা শহরে একজন ধর্ম ব্যাখ্যাকারী বলেছেন, সমালোচকেরা হচ্ছে পিঁপড়ার মতো। তাদের রাজত্ব মাটির নিচে। সৌদি যুবরাজ তাদের মুখ বন্ধ করতে পেরেছেন; তবে রাজত্ব ধ্বংস করতে পারেননি।
ইকোনমিস্টের নিবন্ধে বলা হয়েছে, সৌদি রাজপরিবারের অনেক সদস্যই যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ওপর নাখোশ। তাঁদের কাছে আগে জনসাধারণ ও নিজেদের জন্য ব্যয় করার জন্য প্রচুর অর্থ ছিল। কিন্তু যুবরাজ অভিজাততন্ত্রকে বাধা দিচ্ছেন। তিনি বেশ কয়েকজন সৌদি যুবরাজকে বিলাসবহুল হোটেলে আটকে রেখেছেন। তাঁদের সম্পদ ও নগদ অর্থ জব্দ করেছেন। অনেক যুবরাজই আবার তাঁদের সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। সরকারি চুক্তি থেকে কমিশন পাওয়াও ওই সব যুবরাজের জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। নিন্দুকদের কথায়, মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবে একনায়কতন্ত্র চালু করেছেন।
অবশ্য দুর্নীতিবাজ যুবরাজদের শাস্তি দেওয়ায় অনেক সৌদি নাগরিকই বেশ খুশি হয়েছেন। এতে মোহাম্মদ বিন সালমানের ক্ষমতা আরও পোক্ত হয়েছে। সৌদির অনেক নাগরিকের অসন্তুষ্টিও রয়েছে মোহাম্মদ বিন সালমানের ওপর। সেখানে এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ছেলে-মেয়েদের সহশিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে, যা মেনে নিতে পারছেন না অনেকে। নারীর ক্ষমতায়ন বাড়িয়ে সরকার পুরুষের ক্ষমতা কমাচ্ছে বলেও কারও কারও ধারণা।
সৌদির সাবেক একজন সেনাসদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘আগে যদি আমার মেয়ের অনুমতি ছাড়া রাতে বাইরে যাওয়ার কথা প্রশাসনকে জানাতাম, তাহলে তাঁকে হাতকড়া পরিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে যেত। কিন্তু এখন সে যদি পুলিশকে বলে যে তাঁকে যেতে বাধা দেওয়া হচ্ছে, তাহলে আমাকে ধরে নিয়ে যাবে।’
সৌদির কিছু নাগরিক মনে করেন, মোহাম্মদ বিন সালমান ধর্মীয় গোঁড়ামিকে মধ্যপন্থা দিয়ে পরিবর্তন করছেন না। বরং ধর্মকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিচ্ছেন। মদিনার একজন সুফিসাধক বলেন, যুবরাজ মোহাম্মদ ইউরোপের নীতিতে চলছেন।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সৌদি যুবরাজের অর্থনৈতিক নীতি পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করে তুলছে। ব্যবসায়ীরা একদিকে অভিযোগ করছেন, যুবরাজ বেসরকারি খাতকে বিপদে ফেলতে বিশাল সার্বভৌম-সম্পদ ও ক্ষমতা ব্যবহার করছেন। সৌদিতে এখন বেসরকারি খাতে ভর্তুকি দেওয়া কমে গেছে। পাশাপাশি কর ও অন্যান্য সরকারি ফি বাড়ানো হয়েছে।
সৌদি আরবের একজন ট্যাক্সিচালক জানান, একসময় পানির চেয়ে সৌদিতে তেলের দাম কম ছিল। তবে মোহাম্মদ বিন সালমানের শাসনামলে এটি চার গুণ বেড়েছে। সৌদি সরকারের জবাবদিহিও এখন কমে গেছে বলে মনে কেরন তিনি।
এই সমস্ত অসন্তোষ থেকে কী হতে পারে? কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ধারণা করছেন, সৌদি আরবে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির মতো ব্যক্তির আবির্ভাব হতে পারে। আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি ইরানে ক্ষমতাসীন শাহের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
সৌদি বাদশাহ ফয়সাল ১৯৭৫ সালে তাঁর ভাগনের গুলিতে নিহত হন। ওই ঘটনা উল্লেখ করে সৌদির একজন সাবেক কর্মকর্তা ইকোনমিস্টকে বলেন, মোহাম্মদ জানেন যে, তাঁর পরিবার কী করতে পারে। তাঁরা তাঁকে ক্ষমা করবে না।
অনেকে অবশ্য আশা করছেন, বিপদ এলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সৌদি যুবরাজের পক্ষে দাঁড়াবেন। কিছু বিশ্লেষকেরা মনে করেন, মোহাম্মদ বিন সালমান না থাকলে তাঁর আনা সংস্কারগুলোর গতি বিপরীত দিকে ঘুরে যেতে পারে। আর ইকোনমিস্টের এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, সৌদি আরবের পরিবর্তন উপরিতল দিয়ে হয়েছে। তবে তৃণমূল থেকে এই পরিবর্তন হয়নি।
তবে সৌদি আরবে সহসাই পরিবর্তন হবে বলে মনে করছেন না বিশ্লেষকেরা। কারণ, মোহাম্মদ বিন সালমান দেশটিতে নিজের গতিতেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। রাজপরিবারের অনেক সদস্যকে আটকে রেখেছেন তিনি। অভিযোগ আছে, হাজার হাজার ধর্মপ্রচারক কারাবন্দী আছেন সৌদিতে। এসব বন্দীর মধ্যে রয়েছেন সৌদির জনপ্রিয় ধর্মপ্রচারক সালমান আল ওদাহ। যাঁর টুইটারে ১ কোটি ৪০ লাখ অনুসারী রয়েছে। সৌদি যুবরাজের সমালোচকেরাও এখন প্রচণ্ড ভীত। সৌদি আরবের বাইরে থাকলেও তাঁরা ফোন বন্ধ করে রাখছেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে চরমপন্থা বিশেষজ্ঞ থমাস হেগহ্যামার বলেন, ‘প্রযুক্তির বহুল ব্যবহারের কারণে সৌদি আরব একটি পূর্ণাঙ্গ নজরদারি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আমি মনে করি না, একটি বিদ্রোহ বা অভ্যুত্থান সেখানে সম্ভব।’
সব মিলিয়ে বলা চলে, বিন সালমান ঘোষণা দিয়েই তাঁর এই সংস্কার অভিযান শুরু করেছেন। ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে তিনি রাজ পরিবারে থাকা নিজের প্রতিদ্বন্দ্বিদের কোণঠাসা করেছেন। আবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা করে জনমতকে পাশে টানতে চাইছেন। অর্থনীতিকে বহুমুখীকরণের লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ নিচ্ছেন। বিনোদন ও পর্যটন খাতে আলাদা করে মনোযোগ দিয়েছেন। জ্বালানি তেলকে সার্বভৌম সম্পদের বদলে পুরোপুরি বাণিজ্যিক পণ্যে রূপান্তরিত করছেন। নারী স্বাধীনতা বা ক্ষমতায়নের কথা বলছেন। কিন্তু নারী-পুরুষনির্বিশেষে কারওই বাক্স্বাধীনতা বা ভিন্নমত পোষণ ও প্রকাশে তিনি বিশ্বাসী নন। সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যায় তাঁর সংযোগের বিষয়টি অন্তত তেমনটাই বলে। এমন অভিযোগ নানা দিক থেকেই উঠেছে।
ফলে বিন সালমানের সংস্কার উদ্যোগের কোনোটি নিজের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে, কোনোটি আবার সেই একচ্ছত্র ক্ষমতাকে নিরাপদ করতে পশ্চিমা সহায়তা পাওয়ার লক্ষ্যে নেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। যে কারণে নাগরিক, রাষ্ট্রীয় বা ধর্মীয় পরিসরে তাঁর নেওয়া সংস্কার পদক্ষেপের মূল লক্ষ্যটি অস্পষ্ট এবং সেই সূত্রে জনবিচ্ছিন্ন। ফলে ভিন্নমত থাকলেও তার প্রকাশ নেই। এ অবস্থায় এখন পর্যন্ত বেশ ভালোভাবেই টিকে আছেন সৌদি যুবরাজ। বিতর্ক উঠলেও চলছে সংস্কার অভিযান। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ক্ষোভ থাকলেও তা প্রকাশের সাহস পাচ্ছেন না সৌদি নাগরিকেরা। আর সেই ফাঁকে আরও ডালপালা মেলছে যুবরাজের ক্ষমতার মহিরুহ।