হোম > সারা দেশ > ঢাকা

ফরিদপুরে সাংবাদিকের বাবা-মাকে জখম: গ্রেপ্তার ব্যক্তি হামলাকারী নন, বাদী ও ভুক্তভোগীদের দাবি

ফরিদপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ২১: ৫৮
আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০২: ১৪
ফরিদপুর জেলা পুলিশ সুপার আব্দুল জলিলের সংবাদ সম্মেলন। ছবি: আজকের পত্রিকা

ফরিদপুরের মধুখালীতে আজকের পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক সৌগত বসুর বাড়িতে ঢুকে বাবা-মাসহ তিনজনকে কুপিয়ে আহত করার ঘটনার রহস্য উদ্‌ঘাটনের দাবি করছে পুলিশ। তবে এ ঘটনায় করা মামলায় যাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তিনি ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন বলে মামলার বাদী ও ভুক্তভোগীদের দাবি। তাঁরা বলছেন, তাঁদের বাড়িতে একজনই ঢুকে হামলা করেছিল। কিন্তু পুলিশ যাকে গ্রেপ্তার করেছে, তিনি হামলাকারী নন। ছবি দেখে সেই ব্যক্তি ‘হামলাকারী নন’ বলে ভুক্তভোগীরা শনাক্ত করার পরও তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

মামলার বাদী সাংবাদিক সৌগত বসু আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘পুলিশ প্রকৃত আসামিকে গ্রেপ্তার করেনি। ছবি দেখে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি অভিযুক্ত নন উল্লেখ করার পরও কেন তাঁকে আসামি করা হলো, আমি বুঝতে পারিনি।’

গত শুক্রবার রাতে উপজেলার ডুমাইন পূর্বপাড়ার বোস বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে সৌগত বসুর বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্যামলেন্দু বসু (৬৫), মা কাকলী বসু (৬০) ও প্রতিবেশী কিশোরী প্রীতি মালো (১৫) আহত হন। তাঁরা সবাই ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পরদিন শনিবার বিকেলে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির নামে মধুখালী থানায় এজাহার দাখিল করেন। রাতে তা মামলা হিসেবে নেওয়া হয়। ওই মামলায় তাঁদেরই গ্রামের পরিমল কুমার রায়ের ছেলে পল্লব কুমারকে (১৯) গ্রেপ্তার দেখিয়ে গতকাল রোববার আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।

পুলিশের দাবি, ঘটনার রাতেই পল্লবকে আটক করা হয়। তখন বিশেষায়িত স্টিলের তৈরি লাঠি ও একটি ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। পরে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে কার্যবিধি ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেয়। এ দুটি আলামত ও আসামির স্বীকারোক্তিতে ঘটনার রহস্য উদ্‌ঘাটন হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

আজ সোমবার দুপুর ১২টার দিকে ফরিদপুর পুলিশ সুপার আব্দুল জলিল সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানান। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) শৈলেন চাকমা, সহকারী পুলিশ সুপার (মধুখালী সার্কেল) ইমরুল হাসান, মধুখালী থানার ভারপ্রাপ্ত (ওসি) মো. নুরুজ্জামান ও তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) মোক্তার হোসেনসহ পুলিশের অন্যান্য কর্মকর্তারা তখন উপস্থিত ছিলেন।

রহস্য উদ্‌ঘাটনের দাবি পুলিশের

সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার আব্দুল জলিল বলেন, ‘ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের’ এক পর্যায়ে আসামি ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। চুরির উদ্দেশ্যেই সে ওই বাড়িতে ঢুকেছিল। আদালতে সোপর্দ করা হলে সে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

পল্লব কেন চুরি করতে গেল— এমন প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, ‘নেশার টাকা জোগাড় করার জন্য গিয়েছিল।’

পুলিশ সুপারের দাবি, পল্লব গাঁজা সেবন করে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন এবং সে নিজেও স্বীকার করেছে। এক সময় তাকে ফরিদপুরে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছিল।

উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও স্টিলের লাঠি। ছবি: আজকের পত্রিকা

আসামি যেভাবে শনাক্ত করে পুলিশ

পুলিশ সুপার বলেন, ‘ভুক্তভোগীরা আমাদের জানায়, তাঁরা হামলাকারীকে নির্দিষ্ট করে চিনতে পারেননি, দেখলে চিনতে পারবেন। ভুক্তভোগীরা যখন অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে আসেন, তখন তাঁরা একজনের নাম বলেছেন বলে অ্যাম্বুলেন্সের চালক (টুটুল) ও তাঁদের সঙ্গে আসা মজনু নামে একজন জানিয়েছেন। হাসপাতালে যাওয়ার পর পল্লবের নাম বলা হয়।’

পুলিশ সুপার বলেন, ‘আমরা যাকে ধরেছি, ঘটনার সঙ্গে তাঁর বক্তব্য এবং উদ্ধারকৃত আলামতের মিল আছে কি-না সেটা গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া বাদী বলেছেন, তাদের বাড়ি উঁচু বাউন্ডারি ঘেরা থাকায় চোর বাড়ির পেছনের স্কুল দিয়ে প্রবেশ করতে পারে। পরে আসামিও জানায়, স্কুলের পাশে চিপাগলি দিয়ে গাছ বেয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে সে।’

গ্রেপ্তারের পর ভুক্তভোগীদের সামনে আসামিকে উপস্থাপন করা হয়েছে কি না— এই প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার বলেন, ‘আসামি আমরা দেখিয়েছি, কিন্তু তাঁরা ওইভাবে বলেননি।’

তবে পল্লবকে সশরীরে ভুক্তভোগী আহতদের সামনে হাজির করা হয়নি। পুলিশ হাসপাতালে গিয়ে মোবাইল ফোনে ধারণ করা পল্লবের ছবি আহতদের দেখায়। ওই ছবি দেখেই তাঁরা ‘হামলাকারী পল্লব নন’ বলে শনাক্ত করেন।

আহত তিনজনকে কোপানো হয়নি, দাবি পুলিশের

পুলিশ সুপার আব্দুল জলিল বলেন, হামলায় আহত শ্যামলেন্দু বসু (৬৫), কাকলী বসু (৬০) ও প্রতিবেশী কিশোরী প্রীতি মালোকে (১৫) কোপানো হয়নি। তবে ‘মেডিকেল রিপোর্ট’ এলে চূড়ান্তভাবে জানা যাবে।

তিনি আরো বলেন, ভুক্তভোগীদের স্টিলের লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়। লাঠিটি পল্লব সঙ্গে করে নিয়ে আসে। শ্যামলেন্দু বসু তাকে ধরার চেষ্টা করলে পল্লব লাঠি দিয়ে তাঁকে তিনটি আঘাত করে। পরে অন্যদেরও আঘাত করে স্টিলের লাঠি ফেলেই পল্লব পালিয়ে যায়।

বিশেষ স্টিলের লাঠিটা পল্লব কোথায় পেল

আসামির বরাত দিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, নিজ গ্রাম ও পাশের গ্রামের মাঝামাঝি এলাকায় নেশা করতে গিয়ে নাকি এই লাঠি তাঁর পায়ে বাঁধে, এভাবে সে লাঠিটা পেয়ে যায়। এককথায়, এটা কুড়িয়ে পাওয়া লাঠি।

যিনি গ্রেপ্তার, তিনি হামলাকারী নন

গ্রেপ্তার আসামি নিয়ে ভুক্তভোগী ও বাদীর বক্তব্যের সঙ্গে পুলিশের বক্তব্য ভিন্ন হওয়ায় মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভুক্তভোগী কাকলী বসু ও কিশোরী প্রীতি মালোর দাবি, ওই বাড়িতে পল্লব নয়, অন্য একজন প্রবেশ করেছিলেন, যিনি ওই বাড়িতে ভ্যানে করে গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহ করতেন। তিনি একই এলাকার রেজাউল মীরের ছেলে ইমরান মীর (১৮)।

মামলার বাদী সৌগত বসু বলেন, তাঁর মা (কাকলী বসু) ও প্রীতি মালোকে পুলিশ ঘটনার পরদিন পল্লবের ছবি দেখালে তাঁরা জানিয়েছেন, পল্লব হামলাকারী নন। বরং ইমরানের সঙ্গে হামলাকারী ব্যক্তির চেহারা, আকার-আকৃতিতে মিল রয়েছে।

কাকলী বসু বলেন, ‘ওই রাতে যে এসেছিল, সে বেশি লম্বা ছিল না। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের ও মাথায় বাটি ছাট (এক ধরনের স্টাইল) চুল ছিল। কিন্তু পুলিশ যাকে দেখিয়েছে, তাঁর মাথায় সামনের দিকে লম্বা চুল ছিল।’

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রীতি রোববার রাতে আজকের পত্রিকার প্রতিনিধিকে বলে, ‘পল্লবকে আমি চিনি। রাতে পল্লব আসেনি। ঠাকুমাদের বাসায় (সৌগতদের বাসায়) একটা লোক গ্যাস দিয়ে যেত, রাতে ওই লোকই এসেছিল।’

প্রীতি আরও বলে, ‘রাতে অ্যাম্বুলেন্সে করে যখন আসছিলাম, তখন দাদু (শ্যামলেন্দু বসু) আহত অবস্থায় বারবার জানতে চাচ্ছিল, তাঁর সঙ্গে কী হয়েছিল। পল্লব এসেছিল কি না (পল্লব মাদকাসক্ত হিসেবে পরিচিত)। তখন আমি বলেছিলাম, না। ওই সময় ড্রাইভার টুটুল ও যে আমাদের সঙ্গে এসেছিল, তাঁরা মনে করে, ঘটনাটি পল্লব ঘটিয়েছে। পরে তারাই পুলিশকে পল্লবের নাম জানায়। কিন্তু পল্লব চুরি করতে আসেনি।’

মামলার বাদী সাংবাদিক সৌগত বসু বলেন, ‘পুলিশ প্রকৃত আসামিকে গ্রেপ্তার করেনি। গ্রেপ্তারকৃতের ছবি দেখে শনাক্ত না করার পরও কেন তাকে আসামি করা হলো, আমি বুঝতে পারিনি। পুলিশকে বলা হয়েছে আরও একজনের (ইমরান) নাম। আহতদের সবার মাথায় আঘাত থাকায় ঘটনার পর তাঁদের মধ্যে নাম ও চেহারা নিয়ে এক রকম দ্বিধা ছিল। এজন্য ঘটনার দিন আমাদের পক্ষ থেকে কেউ নাম বলেনি। পরদিন পুলিশ আমাদের জানায়, তাঁরা পল্লবকে আটক করেছেন। তখন আমরা ‘হামলাকারী পল্লব নয়’ বলেছি, ইমরানের কথাও বলেছি। আমরা পুলিশের মাধ্যমেই জেনেছি, ইমরান ফোন বন্ধ করে পলাতক আছেন।’

বাদী ও ভুক্তভোগীদের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, ‘তাঁরা সন্দেহ করল কি না করল, তার থেকে বড় কথা আমরা তদন্তে এবং বাস্তবতায় কী পেয়েছি। এছাড়া এজাহার দায়েরের সময় আমি বলেছিলাম, যাকে সন্দেহ করছেন, তাঁর নামটা দেন। কিন্তু তাঁরা নামটা দেননি।’

পুলিশ সুপার আরও বলেন, ‘রাতে পুলিশকে তাঁরা (ভুক্তভোগীরা) এমন কিছু বলেননি। পরদিন সকালে তাঁর ছেলে (বাদী) জানায়, এখানে ইমরান নামে একজনের নাম এসেছে, তখন আমি বলেছি, আপনার মা এবং যারা সঙ্গে এসেছিল, তাঁরা পল্লবের নাম বলেছে।’

এজাহারে কারও নাম উল্লেখ না থাকার ব্যাখ্যা দিয়ে সৌগত বসু বলেন, ‘আমরা চাইনি কোনো নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি করা হোক। পুলিশ ঘটনার পর ব্যাপক তৎপরতা দেখিয়েছে। যখন যে তথ্য চেয়েছে, আমরা দিয়েছি। পল্লবকে হামলাকারী নয় বলে মা (কাকলী বসু) ও প্রীতি শনাক্ত করার পর আমি নিজেও পুলিশকে জানিয়েছি। ইমরানের কথাও বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। ইমরান পলাতক সেটাও দেখছি। পুলিশ বলছে, পল্লবকে ঘুম থেকে আটক করা হয়েছে। এটা কীভাবে সম্ভব, যার চেহারা মা ও প্রীতি দেখে ফেলেছে, সে এমন ঘটনার পর বাড়িতে ঘুমিয়ে থাকবে! আর যার প্রতি সন্দেহ, সে কিন্তু পালিয়েছে।’

সবাইকে লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে- পুলিশের এই বক্তব্যে সৌগত বসু বলেন, তাঁর বাবাকে প্রথমে লাঠি দিয়ে কপালের মাঝ বরাবর আঘাত করা হয়— সেটি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবে মাথায় আরও তিনটি ক্ষত আছে, যেগুলো লাঠির আঘাতের নয়, ধারালো অস্ত্রের কোপে চিড়ে যাওয়ার ক্ষত। তবে হামলাকারী তাঁর মা ও প্রীতিকে স্টিলের লাঠি দিয়ে আঘাত করে। যে দা উদ্ধার করা হয়েছে, তাতেও রক্ত ছিল।

এদিকে ঘটনার পর থেকেই ইমরান মীর নামে ওই যুবক পালিয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া ইমরানের পরিবারের অন্য সদস্যরাও বাড়িতে নেই বলে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য জীবন বিশ্বাস নিশ্চিত করেছেন।

ইউপি সদস্য আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ঘটনার দিন রাত ১২টার দিকে পুলিশ আমাকে ফোন দিয়ে পল্লবের বাড়ির ঠিকানা চায়। তখন পুলিশ এলে আমিও সঙ্গে যাই। বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পল্লব ঘুমিয়ে রয়েছে। ওর বাবা জানায়, রাত ৯টায় বাড়িতে ফিরে এসেছে। এ ছাড়া সারা দিন মাঠে পেঁয়াজ লাগিয়েছে।’

ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তাকে ছুরিকাঘাত

‘পানি পানি করে অনেকবার চিল্লাইছিল ফেলানী, পরোয়া করেনি বিএসএফ’

পিএসসিতে নাশকতাচেষ্টার অভিযোগে যুবক গ্রেপ্তার

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা যাত্রা, বিমানবন্দরে অতিরিক্ত নিরাপত্তা জোরদার