কয়েকদিন আগে ঠাকুরগাঁও সদর থানায় এক লোক এসে বলেন, ‘বাবাকে খুন করেছি। এই হত্যার জন্য নিজের বিচার চাই।’ গোলাম আজম নামে ওই ব্যক্তির কথামতো শহরের শান্তিনগরের বাসায় গিয়ে ফজলে হকের (৭০) মরদেহ উদ্ধার করেপুলিশ। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) সাবেক ছাত্র গোলাম আজম এখন কারাগারে রয়েছেন।
তাঁর পরিবারের সদস্যরা বলছেন, শিক্ষাজীবনে হল থেকে একবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়ার পর তার মানসিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয় এবং চিকিৎসার পরও তার অবস্থার উন্নতি হয়নি। গোলাম আজমের মা রমিসা বানু স্বামী হত্যার ঘটনায় ছেলের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করলেও বলেছেন, ‘স্বামী হারিয়েছি, এখন সন্তান হারাতে চাই না।’
শহরের শান্তিনগর এলাকায় ফজলে হক (৭০) নামের এক কাঠ ব্যবসায়ীকে হত্যা করেছেন তাঁর সন্তান গোলাম আজম। শ্বাসরোধ ও ছুরিকাঘাতে হত্যার পর সেই ছেলে নিজেই থানায় গিয়ে পুলিশকে জানিয়ে শাস্তির দাবি করেছেন।
গতকাল বুধবার গোলাম আজমের বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয় আজকের পত্রিকার প্রতিনিধির। পরিবারের সদস্যদের দাবি, গোলাম আজম মানসিক রোগে ভুগছিলেন। তাই তিনি এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন।
গোলাম আজমের বড় ভাই নূর আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার ছোট ভাই মেধাবী ছাত্র ছিল। তবে সে বিষণ্নতায় ভুগত। প্রায় সময় পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ওপর রেগে যেত। তবে এলাকার মানুষের সঙ্গে তাঁর আচরণ স্বাভাবিক ছিল। এসব বিষয়ে তাঁকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগতেন বাবা। এর মাঝে আজমকে রংপুরের এক মানসিক চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয়। সে চিকিৎসকের দেওয়া ওষুধ খেতে চাইতো না। বাবা তাঁকে ওষুধ খাওয়ালে, সে বাবার ওপরেও প্রায় সময় চড়াও হতো।’
নূর আলম আরও বলেন, ‘আমার ভাই সব সময় নিঃসঙ্গ থাকত। একা একা থাকার কারণে তাঁর মধ্যে বিষণ্নতা কাজ করত।’
কারাভোগের পর থেকেই আজমের মানসিক অসুস্থতার শুরু হয় বলে দাবি করেছেন তাঁর বড় বোন ফাহিমা খাতুন। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এক মাস কারাভোগের পর থেকে আমার ভাই বিষণ্নতায় ভুগত। রাতে ঘুমের ঘরে চিৎকার করে উঠত! প্রতিবেশীরাও তাঁর চিৎকারে ছুটে আসত। তাঁর স্বপ্ন ছিলে ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার। এ জন্য সে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতিও নেয়। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পর যে মামলাটি হয়, সেটি চলমান ছিল। এ জন্য সে শঙ্কিত ছিল যে, মামলার কারণে যদি বিসিএস ক্যাডার না হতে পারে। তবে মামলার বিষয়ে পরিবারের সদস্যদের সে কিছুই বলত না।’
ফাহিমা খাতুন আরও বলেন, ‘গোলাম আজম ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয়। ২০১৬ সালে রুয়েট থেকে বের হয়ে গোলাম আজম চার-পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছে। কোনোখানেই সে বেশি দিন টেকেনি। বাবাকে হত্যার আগে শহরের একটি কিন্ডারগার্টেনে যোগ দিয়েছে। তাঁর স্ত্রী ও তিন মাস বয়সী একটি ছেলে রয়েছে।’
মানসিক অসুস্থতার অন্যতম একটি কারণ উল্লেখ করেন গোলাম আজমের মা রমিসা বানু। তিনি জানান সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার ভাইভায় গোলাম আজমের নামের বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। নাম পরিবর্তনের বিষয়েও কথা ওঠে সেখানে। পরে ফল প্রকাশের পর দেখা যায়, তাঁর চাকরিটা হয়নি। এই নাম পরিবর্তন নিয়েও বাবার সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডার কথাও জানান তিনি।
রমিসা বানু বলেন, ‘গোলাম আজম বাড়ি থেকে কোরআন শরীফ ও জায়নামাজ কারাগারে পাঠানোর জন্য বলেছে। আমি স্বামীকে হারিয়েছি, এবার ছেলে হারাতে চাই না।’ বলে কাঁদতে শুরু করেন।
আজকের পত্রিকার কথা হয় শাহিন আলম নামে শান্তিনগর এলাকার এক বাসিন্দার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘গোলাম আজম কখনো কারও সঙ্গে খারাপ আচরণ করেনি। তবে সে কারও সঙ্গে তেমন মিশতোনা।’
এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগ নেতা মোতালেব হোসেন চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘নিহত ফজলে হকের বাড়ি মূলত বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার দুওসুও ইউনিয়নের সনগাঁও গ্রাম। তিনি সন্তানদের পড়াশোনার জন্য শহরের শান্তিনগরে বসবাস করছিলেন। কিন্তু সন্তানের হাতেই তাঁর মৃত্যু হলো।’
এদিকে ঠাকুরগাঁও জেলা কারাগার সূত্রে জানা গেছে, বাবাকে হত্যার পর কারাগারে অনুশোচনায় ভুগছেন গোলাম আজম। বাবার জানাজা ও দাফন কোথায় হয়েছে সেই খোঁজও চেয়েছেন কারা কর্তৃপক্ষের কাছে।
প্রসঙ্গত গত রোববার রাত ২টার দিকে ঠাকুরগাঁও পৌর শহরের শান্তিনগর একুশে মোড় এলাকার এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামাল হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মধ্য রাতে আজম থানায় এসে নিজেকে সোপর্দ করে বলেন—‘‘বাবাকে খুন করছি। এই হত্যার জন্য নিজের বিচার চাই।’ ’ পরে আজমের দেওয়া তথ্যমতে পুলিশ ওই বাসা থেকে ফজলে হকের মরদেহ উদ্ধার করে। ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ ঠাকুরগাঁও জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।’
এ সময় ওসি আরও বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে পারিবারিক কলহের কারণে ছেলে তাঁর বাবাকে ধারালো চাকু দিয়ে হত্যা করেছে।