বুল বুল চৌধুরী নামের এক ব্যক্তির জন্মনিবন্ধন ব্যবহার করে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলায় কোটি টাকার জমি বিক্রি করা হয়। বুল বুল চৌধুরীর জন্মনিবন্ধনে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার কানিহারী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) তথ্য দেওয়া। ৫২ শতক ওই জমি নিয়ে ওয়ারিশদের আপত্তির পর খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জন্মসনদটি ভুয়া। এমনকি বাহুবলের পুটিজুরী ইউপি থেকে নেওয়া ওয়ারিশান সনদও ভুয়া বলে জানিয়েছে ওই ইউপি কর্তৃপক্ষ।
গত ৪ নভেম্বর স্টেট অ্যাকুইশন (এসএ) পরচায় দেখা যায়, ওই জমির মূল মালিক ছিলেন ব্রজেন্দ্র কুমার চৌধুরী। উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁর তিন ছেলে বানোয়ারি লাল চৌধুরী, বিনয় কুমার চৌধুরী ও ব্রজলাল চৌধুরী স্বত্বাধিকারী হন। বানোয়ারি লাল চৌধুরীর ছেলে বুল বুল চৌধুরীর নামে ওই জমি বিক্রি করা হয়েছে।
তবে ব্রজলাল চৌধুরী ও বিনয় কুমার চৌধুরীর সন্তানেরা উত্তরাধিকার হিসেবে জমি বিক্রি ও দলিল তৈরিকে বেআইনি অভিযোগ করে আদালতে মামলা করেছেন। তাঁদের দাবি, বুল বুল চৌধুরী বহু বছর আগে ভারতে চলে গেছেন। এরপর আর দেশে আসেননি। বিক্রেতা হিসেবে বুল বুল চৌধুরী নামের একজনকে সাজিয়ে দলিল তৈরি করা হয়েছে।
ওই জমির উত্তরাধিকার দাবিদার বুল বুল চৌধুরীর চার চাচাতো ভাইবোন। তাঁরা হলেন দক্ষিণ ডুবাঐ গ্রামের ব্রজলাল চৌধুরীর তিন ছেলে পান্না লাল চৌধুরী, হিরক চৌধুরী ও মানিক চৌধুরী এবং বিনয় কুমার চৌধুরীর মেয়ে কৃষ্ণা চৌধুরী। এই চারজন হবিগঞ্জ সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে ৯ জনের বিরুদ্ধে একটি স্বত্ব মামলা করেছেন। জমির দখল নিয়ে তাঁরা অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞার আবেদনও করেন। গত ১৯ নভেম্বর আদালত তা মঞ্জুর করেছেন।
মামলায় তিন ক্রেতার পাশাপাশি বুল বুল চৌধুরী, মো. হারুন মিয়া, মিন্টু চন্দ্র চন্দ, দলিল লেখক আব্দুল কাদির মাহমুদ, উপজেলা সাবরেজিস্ট্রার ও হবিগঞ্জ জেলা সাবরেজিস্ট্রারকে বিবাদী করা হয়েছে।
ভূয়া জন্মনিবন্ধনের তথ্য ঘাঁটতে গিয়ে জানা যায়, গত ২৪ এপ্রিল বাহুবলের পুটিজুরী ইউনিয়নের দক্ষিণ ডুবাঐ গ্রামের বানোয়ারী লাল চৌধুরী ও শীলা রানী চৌধুরীর সন্তান পরিচয়ে বুল বুল চৌধুরীর নামে ত্রিশালের কানিহারী ইউপি থেকে একটি অনলাইন জন্মনিবন্ধন হয়। এরপর এই জন্মনিবন্ধন ও পুটিজুরী ইউপি থেকে দেওয়া ওয়ারিশান সনদপত্রের মাধ্যমে গত ১৭ সেপ্টেম্বর ৫২ শতক জমি বাহুবল সাবরেজিস্ট্রি অফিসে দলিলের মাধ্যমে বিক্রি হয়; যার দলির নং-২৯৪৫/২৪। এই জমি কেনেন বাহুবলের শেওড়াতলী গ্রামের মৃত ফিরোজ মিয়ার ছেলে মোবাশ্বির আহমেদ, ভাটপাড়া গ্রামের মৃত আকল মিয়ার ছেলে ছালেক মিয়া ও গাজীপুর গ্রামের নোয়াব উল্লার ছেলে আজির উদ্দিন।
বুল বুল চৌধুরীর এক চাচাতো ভাই হিরক চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বুল বুল চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে ভারতে অবস্থান করছেন। তিনি ভারতে যাওয়ার পর আর দেশে আসেননি। এখন ভুয়া জন্মনিবন্ধন ও ওয়ারিশান সনদের মাধ্যমে একজনকে বুল বুল চৌধুরী সাজিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। রেজিস্ট্রি দলিলে যে ব্যক্তির ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা বুল বুল চৌধুরীর নয়। যে জমি বিক্রি করা হয়েছে, তা আমাদের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তি। আমাদের এই সম্পদ গ্রাস করার জন্য এই মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।’
দক্ষিণ ডুবাঐ গ্রামের ষাটোর্ধ্ব ইয়াকুত মিয়া বলেন, বানোয়ারী লাল চৌধুরী ও তাঁর ভাইয়েরা আমাদের এলাকার একটি সম্ভ্রান্ত পরিবার। সেই পরিবারের একজন হিসেবে আমি শুধু বুল বুল চৌধুরীর নাম শুনেছি। যিনি ভারতে থাকেন। তবে কখনো সামনাসামনি দেখা হয়নি।’
বাহুবলের পুটিজুরী ইউপি চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) আবুল কালাম বলেন, বুল বুল চৌধুরীর নামে ওয়ারিশান সনদটি তাঁর ইউনিয়ন থেকে দেওয়া হয়নি। প্রতিটি সনদের স্মারক তথ্য পরিষদে সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু এর কোনো প্রমাণ অফিসে নেই। এটা নিশ্চিতভাবে একটি ভুয়া ওয়ারিশান সনদ। তা ছাড়া বুল বুল চৌধুরী মৃত মা শীলা রানী চৌধুরীকে ওয়ারিশান দেখানো হয়েছে। অথচ ওয়ারিশান হিসেবে মৃত শীলা রানী চৌধুরীর নাম উল্লেখ করার কথা নয়।
জমির ক্রেতাদের একজন শেওড়াতলী গ্রামের মৃত ফিরোজ মিয়ার ছেলে মোবাশ্বির আহমেদ দাবি করেন, বুল বুল চৌধুরীর কাছ থেকে নিয়ম মেনে তাঁরা জমি কিনে রেজিস্ট্রি করেছেন। এখন আদালতে মামলা হয়েছে। তবে বর্তমানে তিনি জমি দখলে আছেন।
বাহুবল সাবরেজিস্ট্রি অফিসের সাবরেজিস্ট্রার মো. মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে দলিল রেজিস্ট্রি করেছি। রেজিস্ট্রির সময় জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধন সনদের একটি হলেই হয়। আমি অনলাইন জন্মনিবন্ধন পেয়েছি; পাশাপাশি ভূমি অফিসের নামজারি ছিল। দলিল করার সময় ছবির সাথে বুল বুল চৌধুরীকে শনাক্ত করা হয়েছে। একজন শনাক্তকারীও ছিলেন। তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্রও দেওয়া হয়েছে। যে কারণে আইনিভাবে দলিল সম্পাদনে কোনো ত্রুটি ছিল না।’
এ বিষয়ে বাহুবল উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শিবরাজ চৌধুরীকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি।