সাধারণ মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়বে

আসাদুজ্জামান নূর, ঢাকা

প্রকাশ : ০৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০২: ০৪
ফাইল ছবি

রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য অন্তর্বর্তী সরকার অর্থবছরের মাঝামাঝি এসে ভ্যাটের (মূল্য সংযোজন কর) ওপর ভর করার যে পথটি বেছে নিয়েছে, তা প্রতিকূল ফলাফল নিয়ে আসতে পারে বলে অর্থনীতিবিদেরা আশঙ্কা করছেন। ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের মাধ্যমে সরকার সম্পদশালীদের ওপর সরাসরি বাড়তি কর আরোপের পরিবর্তে পরোক্ষ করের বোঝা বাড়াচ্ছে।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইতিমধ্যেই মূল্যস্ফীতিতে কাহিল সাধারণ মানুষের ওপর এ কৌশল চাপ আরও বাড়াবে। কারণ, পণ্য এবং সেবার দাম বাড়বে বলে এ ধরনের পরোক্ষ করের বোঝা গরিব এবং মাঝারি আয়ের মানুষদের ওপর সমানভাবে পড়বে। এটি সমাজের উচ্চমাত্রার আয়বৈষম্যকে আরও তীব্র করবে।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী মহলের ধারণা, মূল্যস্ফীতির এ নতুন ধাক্কা এবং বৈষম্য বৃদ্ধি দীর্ঘ মেয়াদে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ অবস্থায় সরকার কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে সর্বস্তরের জনগণের জন্য মঙ্গলজনক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, তা একটি বড় প্রশ্ন।

প্রাথমিকভাবে ৪৩ ধরনের পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হবে। গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। উপদেষ্টা পরিষদ এ-সংক্রান্ত অধ্যাদেশের খসড়াটি নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানা যাবে।

ভ্যাট বৃদ্ধির বিষয়ে ঠিক কী কী পরিবর্তন আনা হচ্ছে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো জানানো হয়নি। তবে এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) রেস্তোরাঁয় খাবারের বিলের ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বর্তমানের নন-এসি হোটেল সেবার ওপর থাকা সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাটও বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তৈরি পোশাক কেনার ক্ষেত্রেও ভ্যাট বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে তৈরি পোশাকের দোকানের বিলের ওপর সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। এটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। অর্থাৎ তাতে তৈরি পোশাক কেনার খরচও বাড়বে। মিষ্টির ভ্যাটও সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এসবের বাইরে বিস্কুট, আচার, সিআর কয়েল, ম্যাট্রেস, ট্র্যান্সফরমার, টিস্যুপেপার ইত্যাদি পণ্য এবং ড্রাইভিং লাইসেন্সের কার্ডের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, ‘দেশ চালাতে রাজস্ব লাগবে। সে জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। আর এটা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। চূড়ান্ত হোক। এ বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করা হবে। অধ্যাদেশ জারি হোক। তারপর বিস্তারিত বলা যাবে।’

ব্যবসায়ীদের অন্যতম প্রধান সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যে পণ্য বা সার্ভিসের ওপরই ভ্যাট বাড়ানো হোক না কেন, প্রভাব পড়বেই। মানুষের খরচ তো একটু বাড়বেই। মূল্যস্ফীতি আছে, বাড়ছে। সাধারণ মানুষের অসুবিধা হবেই।’

অর্থনীতিবিদেরা প্রায় সমস্বরে বলেছেন, রাজস্ব বাড়ানোর তাগিদ থেকে সরকার দ্রুত সমাধানের সহজ পথ বেছে নিয়েছে—দীর্ঘমেয়াদি কঠিন পথে যায়নি। কিন্তু এর কারণে বৈষম্য বাড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্ন আয়ের মানুষ।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, রাজস্ব আদায় বাড়ানোর চাপেই এটি করা হয়েছে। কারণ, এটি সহজ উপায়। কিন্তু এটি মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়াবে। সাবান, ডিটারজেন্ট, পেইন্ট, এলপিজির ওপর ভ্যাট বাড়বে, যেগুলো মধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্তদের ওপর প্রভাব ফেলবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘সরকার কর-জিডিপির অনুপাত বাড়ানোর কঠিন পথে না গিয়ে সহজ পথে হাঁটল। পরোক্ষ কর ধনী-গরিব সবার জন্যই সমান। পরোক্ষ কর বাড়লে ধনীদের সমস্যা হয় না, সমস্যা হয় গরিবদের। এতে অসমতা আরও বাড়বে।’

রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‍্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. আব্দুর রাজ্জাক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ভ্যাটের মতো পরোক্ষ কর বাড়ালে বৈষম্য দূর করা যায় না। রাজস্ব বাড়ানোর সহজ উপায় হচ্ছে, ভ্যাট বাড়ানো। সরকার সেটাই করেছে।’

সরকারের এই উদ্যোগ প্রত্যাশা অনুযায়ী কার্যকর হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ও প্রকাশ করেছেন সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, ‘পরোক্ষ কর বাড়ানোর কারণে মানুষের ভোগ কমে যেতে পারে। তখন এ ভ্যাট বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত থেকে কাঙ্ক্ষিত ফল আসবে না।’ এ সময় ভ্যাট বাড়ানোর উদ্যোগকে মূল্যস্ফীতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে সরকারেরই দুটি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের প্রতিফলন বলে মনে করছেন সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে একদিকে যখন বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে এনবিআরও ভ্যাট বাড়াচ্ছে। অথচ সমন্বয় থাকলে কিছু ক্ষেত্রে উল্টো কর হ্রাসের কথা ছিল।’

অর্থ উপদেষ্টার ভিন্নমত

ভ্যাট বৃদ্ধিতে জিনিসপত্রের দামের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অত্যাবশ্যকীয় সব পণ্যের শুল্ক কমিয়ে জিরো (শূন্য) করে দেওয়া হয়েছে। আপনারা সে ছাড়টা দেখবেন।’

যেসব পণ্যের ওপর কর বাড়ছে, সেগুলো মূল্যস্ফীতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে খুবই কম গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করে উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের মূল্যস্ফীতির মূল সূচকগুলো হলো চাল, ডাল ইত্যাদি।’

সরকারের এই উদ্যোগের পরিণতিতে সাধারণ মানুষের কষ্ট হবে কি না, জানতে চাইলে সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মনে হয় না কষ্ট হবে।... তিন তারকার ওপর যে রেস্টুরেন্টগুলো, সেগুলোর ক্ষেত্রে ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। ভাতের রেস্টুরেন্ট বা অন্য রেস্টুরেন্ট থেকে তো যাবে না।’

বৈশ্বিক ঋণদাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে এটি করা হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘না, সবদিক চিন্তাভাবনা করেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

প্রসঙ্গত, সম্প্রতি আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণের শর্ত হিসেবে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ করার শর্ত দিয়েছে। বাংলাদেশকে দেওয়া ৪৭০ কোটি ডলারের চলমান ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তির অর্থ ছাড়ের আগে গত ডিসেম্বরেই ঘুরে গেছে আইএমএফের একটি মিশন। ঋণের পরিমাণ বাড়ানোর শর্ত হিসেবে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন তাগিদ দিয়েছে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানটি।