দেশের উত্তরাঞ্চল শীতে কাঁপছে ডিসেম্বর থেকেই। তবে রাজধানীবাসী এত দিন সেভাবে ঠান্ডার অনুভূতি পায়নি। সেই অনুভূতি শুরু হয়েছে নতুন বছরের শুরুতেই। গতকাল বৃহস্পতিবার এক দিনে ঢাকার তাপমাত্রা কমেছে প্রায় ২ ডিগ্রি। এর মধ্যেই আবহাওয়া অধিদপ্তর দিয়েছে দুঃসংবাদ। সংস্থাটি বলছে, এক সপ্তাহ পর তাপমাত্রা আরও কমতে পারে। এদিকে শীত বাড়তেই দেশজুড়ে হাসপাতালগুলোয় ঠান্ডাজনিত রোগীর চাপ বাড়তে শুরু করেছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গতকাল ঢাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগের দিন বুধবার এখানে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৫ ডিগ্রি। তার আগের দিন, মঙ্গলবার ঢাকার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৫ দশমিক ৮ ডিগ্রি। আর গত সোমবার এখানে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ১৮ দশমিক ২ ডিগ্রি। অর্থাৎ চার দিনে ঢাকার তাপমাত্রা কমেছে ৪ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এদিকে গতকাল দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায় ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
তাপমাত্রা আরও কমতে পারে
আবহাওয়া অধিদপ্তরের জানুয়ারি মাসের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এ মাসে দেশের পশ্চিম, উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একটি থেকে দুটি মাঝারি (৬ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) থেকে তীব্র (৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস) শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। দেশের অন্যান্য এলাকায় দুটি থেকে তিনটি মৃদু (১০ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) থেকে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে।
এ মাসে দিন ও রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকতে পারে। তবে দিন ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য কম থাকবে। ফলে শীতের অনুভূতি বাড়তে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ তরিফুল নেওয়াজ কবির গতকাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, চুয়াডাঙ্গা ছাড়াও রাজশাহীতে তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রির কাছাকাছি আছে। এটা অনেকটা শৈত্যপ্রবাহের মতোই। এমন তাপমাত্রা আরও কয়েক জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে থাকতে পারে। তিনি আরও বলেন, এ মাসের ৭ তারিখের পর তাপমাত্রা আরও কমতে পারে। রাতের তাপমাত্রা কমে যাবে। ফলে শীতের অনুভূতি বেশি হবে।
সৈয়দপুরে বিমান চলাচল বিঘ্নিত
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ঘন কুয়াশার কারণে দেশের কোথাও কোথাও তীব্র শীত অনুভূত হতে পারে। বিমান চলাচল, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন এবং সড়ক যোগাযোগ সাময়িকভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
নীলফামারীতে ভোররাত থেকে বৃষ্টির মতো কুয়াশা পড়ছে। সূর্যেরও দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। তীব্র শীত আর হিমেল হাওয়ায় জনজীবন নাকাল হয়ে পড়েছে। ঘন কুয়াশার কারণে সৈয়দপুর বিমানবন্দরের রানওয়েতে দৃষ্টিসীমা কমে এসেছে। এতে ফ্লাইট চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে দেরি হচ্ছে দূরপাল্লার বাস ও ট্রেনেরও। হাসপাতালে বাড়ছে শীতজনিত রোগীর সংখ্যা।
সৈয়দপুর বিমানবন্দর আবহাওয়ার পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের তথ্যমতে, গতকাল সকাল ৯টায় এখানে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১২ ডিগ্রি। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলেছে, ঘন কুয়াশার কারণে সকালের দিকে ফ্লাইট অবতরণে বিঘ্ন ঘটছে। তবে কোনো ফ্লাইট বাতিল করা হয়নি।
নওগাঁর বদলগাছী আবহাওয়া অফিসে গতকাল সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১০ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তারা জানায়, তাপমাত্রা কমার পাশাপাশি হিমেল হাওয়ার কারণে শীতের অনুভূতি কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।
রাজধানীসহ পুরো দেশ কাঁপছে শীতে
গতকাল রাজধানীর মালিবাগ, মগবাজার, রামপুরা, তেজগাঁও, কারওয়ান বাজার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, তীব্র ঠান্ডার কারণে খেটে খাওয়া মানুষের জীবন-জীবিকা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। দিনমজুরেরা কাজের ফাঁকে উষ্ণতার খোঁজে আগুন পোহাতে বাধ্য হচ্ছেন। গতকাল সারা দিন রাজধানীতে সূর্যের দেখা প্রায় পাওয়াই যায়নি।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রংপুর বিভাগের পঞ্চগড়, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, দিনাজপুর এবং রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ, পাবনা, নাটোরসহ প্রায় সব জেলায়ই শীত জেঁকে বসেছে। হিমেল হাওয়া ও কনকনে ঠান্ডায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা থাকছে ৯ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ, পাবনা, নাটোরে পারদ নেমেছে ১০ ডিগ্রির কাছাকাছি।
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়া পর্যবেক্ষক রাকিবুল হাসান বলেন, ডিসেম্বরের মাঝামাঝি চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে গিয়েছিল। এরপর সাগরে নিম্নচাপের কারণে শীত কিছুটা কমতে থাকে। ওই মাসের বাকি দিনগুলোয় তেমন শীতের অনুভূত ছিল না। তবে নতুন বছরের শুরুতেই শীতের তীব্রতা বাড়তে শুরু করেছে। তিনি আরও বলেন, উত্তরের দিক থেকে ঝিরঝির হিমেল হাওয়া শীতের অনুভূতি বাড়াচ্ছে। চলমান শৈত্যপ্রবাহ তিন-চার দিন স্থায়ী হতে পারে।
চুয়াডাঙ্গা শহরের একটি হোটেলের কর্মচারী কাজল চক্রবর্তী বলেন, ‘ভোরে কাজে আসতে হয়। এই শীতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কাজ তো করে খেতে হবে, তাই কিছুই করার নেই।’ পাখি ভ্যানচালক আমজাদ হোসেন বলেন, ‘আবার তীব্র শীত পড়া শুরু করছে। আবার কাজ কম হবে, ভাড়া হবে না, শীতে বাপু লোকজন বের হয় না।’
চুয়াডাঙ্গার পাশাপাশি শীত জেঁকে বসেছে নীলফামারী, নওগাঁসহ এই অঞ্চলের অন্যান্য জেলায়ও।
উত্তরের জেলা গাইবান্ধায় তিন দিন ধরে সূর্যের দেখা নেই। শীতের তীব্রতা থেকে রক্ষা পেতে পুরোনো গরম কাপড়ের দোকানগুলোয় ভিড় করছেন নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষেরা।
তীব্র ঠান্ডায় কাহিল হয়ে পড়েছে কুড়িগ্রামের চিলমারীর মানুষও। গতকাল কুড়িগ্রামে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১১ দশমিক ৩ ডিগ্রি। চিলমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আমিনুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালে ঠান্ডাজনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। শীত আরও বাড়লে রোগীও বাড়বে।
চিলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সবুজ কুমার বষাক বলেন, সরকারিভাবে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৬০০ কম্বল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৮০০ বিতরণ করা হয়েছে। আরও বরাদ্দের জন্য চাহিদা পাঠানো হয়েছে।
এদিকে সিলেট অঞ্চলের দিনমজুর ও চা-শ্রমিকেরাও তীব্র শীতে পড়েছেন বিপাকে। মৌলভীবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মো. মামুনুর রহমান বলেন, শীতের যত তীব্রতা বাড়ছে, ততই ঠান্ডাজনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
সার্বিক বিষয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ শাহানাজ সুলতানা আজকের পত্রিকা বলেন, সূর্যের দেখা না মেলায় শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে। আর এর সঙ্গে রয়েছে উত্তরের হিমেল হাওয়া। তবে আজ শুক্রবার দিনের তাপমাত্রা একটু বাড়তে পারে। কুয়াশা কেটে গেলে হয়তো শীতের অনুভূতিও একটু কমবে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন চুয়াডাঙ্গা, নীলফামারী, গাইবান্ধা, নওগাঁ, চিলমারী (কুড়িগ্রাম) ও কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি]