স্ট্রেইট টাইমসের প্রতিবেদন
পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে ব্যাপক পরিমাণে সিনথেটিক মাদক জব্দের বিষয়টি উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে, মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধের মধ্যেও এ ধরনের মাদকের ব্যাপক উৎপাদনের খবর পাওয়া গেছে। মিয়ানমারের মাদক চক্রগুলো মেটাঅ্যামফিটামিন, এক্সট্যাসি, কেটামিন ও ইয়াবার (যা মেটাঅ্যামফিটামিন ও ক্যাফেইনের সমন্বয়ে গঠিত) দাম কমিয়ে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আরও বেশি বেশি এসব মাদক সরবরাহ করছে।
মিয়ানমারের শান রাজ্য এই অঞ্চলের সিনথেটিক মাদকের প্রধান উৎস হিসেবে চিহ্নিত। আর থাইল্যান্ড হলো গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল (এই অঞ্চলটি থাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চল, লাওস ও মিয়ানমারের একটি অংশ নিয়ে গঠিত) অঞ্চলের মাদক পরিবহনের প্রধান রুট।
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ দপ্তরের (ইউএনওডিসি) ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, থাইল্যান্ডে ২০২৩ সালে ৬৪৮ দশমিক ৯ মিলিয়ন ইয়াবা ট্যাবলেট এবং ২৬ দশমিক ৪ টন ক্রিস্টাল আইস জব্দ করা হয়েছে। ২০১৯ সালে জব্দ করা হয়েছিল ৩৯৫ মিলিয়ন ইয়াবা ট্যাবলেট এবং ১৭ দশমিক ৬ টন আইস।
থাইল্যান্ডের নারকোটিকস কন্ট্রোল বোর্ড (ওএনসিবি) জানিয়েছে, ২০১৯ সালের তুলনায় এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ। সে সময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ছিল বিশ্বের বৃহত্তম ও দ্রুত বর্ধনশীল ক্রিস্টাল মেথের বাজার। ২০০৭ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে বিভিন্ন মাদক জব্দের পরিমাণ ৮ গুণেরও বেশি বেড়েছিল।
থাইল্যান্ডের নারকোটিকস কন্ট্রোল বোর্ড জানিয়েছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত থাইল্যান্ড-মিয়ানমার সীমান্তে থাই কর্তৃপক্ষ ৪৮৮ মিলিয়ন ইয়াবা ট্যাবলেট এবং প্রায় ১০ টন আইস জব্দ করেছে। সংস্থাটি বলেছে, ‘আইস জব্দের পরিমাণ গত তিন বছরে ওঠানামা করছে...আমরা দেখতে পাচ্ছি যে প্রথমে এগুলো দক্ষিণ থাইল্যান্ডে পাচার হচ্ছে। পরে সেখান থেকে তৃতীয় দেশে বিতরণের জন্য পাঠানো হচ্ছে।’
তারা আরও বলেছে, ‘মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধ সাংগঠনিক অপরাধ চক্রগুলোকে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে দিয়েছে, যার ফলে অসীম পরিমাণ মাদক উৎপাদনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।’
ইউএনওডিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ২০১৯ সালে প্রায় ১৪০ টন বিভিন্ন ধরনের মেটাঅ্যামফিটামিন মাদক জব্দ করা হয়েছিল। ২০২৩ সালে সেই পরিমাণ বেড়ে ১৯০ টনে দাঁড়ায়। এতে আরও বলা হয়, মাদক চক্রগুলো রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত নয়, এমন রাসায়নিক ব্যবহার করে খরচ কমিয়ে উৎপাদন বাড়িয়ে দিচ্ছে।
চক্রগুলো উচ্চতর বিশুদ্ধতার সিনথেটিক মাদক তৈরি করছে। ইউএনওডিসি বলেছে, ‘উৎপাদন বাড়ানোর কারণে, এক টনেরও বেশি মাদক পরিবহনকারী চালান এখন খুব সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠেছে।’ ইউএনওডিসির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৯ সালে কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোতে ক্রিস্টাল মেথের পাইকারি মূল্য প্রতি কেজি ১০ থেকে ১২ হাজার মার্কিন ডলার ছিল। ২০২৩ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৪ থেকে ৭ হাজার ডলারে।
পাচারকারীরা আগে সাধারণত মিয়ানমার-থাইল্যান্ডের সীমান্ত ব্যবহার করে স্থলপথে মাদক পরিবহন করত। কিন্তু গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলে অভিযান বাড়ানোর পর সংগঠিত অপরাধ চক্রগুলো কৌশল পরিবর্তন করে সমুদ্রপথকে কাজে লাগাতে শুরু করে।
ইউএনওডিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংগঠিত অপরাধ চক্রগুলো ক্রমশ স্থলভিত্তিক পাচার করিডরের সঙ্গে সমুদ্রপথের সংযোগ স্থাপন করছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, থাইল্যান্ড, চীন ও লাওস সীমান্তবর্তী শান রাজ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ চলমান থাকায় মাদক পাচার পরিস্থিতি শিগগির উন্নতির সম্ভাবনা কম।
২০২১ সালে মিয়ানমারে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে হটানোর পর থেকেই দেশটি পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মেথ উৎপাদনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। মিয়ানমারের শান রাজ্য এই মেথ উৎপাদনের প্রাণকেন্দ্র। দেশটিতে যুদ্ধ চলমান থাকায় মাদকের বিরুদ্ধে জান্তা সরকারের অভিযান খুব কমই কাজে দিয়েছে।
মিয়ানমারের সেন্ট্রাল কমিটি ফর ড্রাগ অ্যাবিউজ কন্ট্রোলের প্রধান সো হুত ২০২৩ সালের জুনে একটি প্রতিবেদনে বলেন, মাদক-বাণিজ্য ধ্বংসের প্রচেষ্টা কোনো প্রভাব ফেলছে না। তিনি বলেন, ‘অসংখ্য মাদকাসক্ত, উৎপাদক, পাচারকারী এবং চক্রগুলোর সদস্যদের গ্রেপ্তার ও বিচারের পরও মাদক উৎপাদন বা পাচার মোটেই কমেনি।’ ২০২৩ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের প্রধান প্রকাশ করেন যে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সশস্ত্র জাতিগত সংখ্যালঘু সংগঠনগুলোর একটি মাদক-বাণিজ্য থেকে লাভবান হয়েছে।
সিঙ্গাপুরের সেন্ট্রাল নারকোটিকস ব্যুরোর (সিএনবি) তথ্য অনুসারে, সিঙ্গাপুরে ২০২৩ সালে গ্রেপ্তার হওয়া মাদকসেবীদের প্রায় অর্ধেক, অর্থাৎ ১ হাজার ৬২১ জন মেথ ব্যবহারকারী। ২০২২ সালে ১ হাজার ৪৫১ জন মেথ ব্যবহারকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
সিনথেটিক এই মাদক সিঙ্গাপুরের নতুন ও তরুণ মাদকসেবীর মধ্যে ক্রমবর্ধমান হারে ব্যবহার করছেন। ২০২৩ সালে গ্রেপ্তার ৯৫২ জন নতুন মাদকসেবীর মধ্যে ৫৯৯ জনই মেটাঅ্যামফিটামিন ব্যবহার করেছিলেন। যা আগের বছরের তুলনায় ১৯ শতাংশ বেশি। ২০২৩ সালে গ্রেপ্তার হওয়া ২০ বছরের কম বয়সী মেথ ব্যবহারকারীদের সংখ্যা ২০২২ সালের তুলনায় ১১ শতাংশ বাড়ে।
সিঙ্গাপুরে আসক্তি নিয়ে কাজ করা মনোবিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রু দা রোজা আশঙ্কা করেন, মাদকের সহজলভ্যতা বেড়ে যাওয়ার কারণে গুরুতর স্বাস্থ্য সংকট তৈরি হতে পারে। তিনি বলেন, ‘সরবরাহ বাড়লে আপনি দেখবেন নতুন ব্যবহারকারীদের সংখ্যা বাড়ছে এবং বর্তমান ব্যবহারকারীরা মাদকের বাড়তি ডোজ কিনছে। এটি জনস্বাস্থ্য সংকটে পরিণত হতে পারে।’