বাশার আল-আসাদের পতনের চার দিন পর দামেস্কের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া বিদ্রোহী যোদ্ধারা বিপুল পরিমাণ ক্যাপটাগন উদ্ধার করেছেন। এই মাদকদ্রব্য দীর্ঘদিন ধরে সিরিয়ায় ব্যাপকভাবে উৎপাদিত হয়ে আসছিল। বাশার আল-আসাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার সঙ্গে এই মাদকের গভীর সম্পর্ক রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিদ্রোহীদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) শীর্ষ কমান্ডার আহমেদ আল-শারা (যিনি আল-জুলানি নামেও পরিচিত) অভিযোগ করেছেন, বাশারের সময় সিরিয়া বিশ্বে ক্যাপটাগনের ‘বৃহত্তম উৎস’ ছিল। তিনি ক্যাপটাগনের উৎপাদন ও বাণিজ্য দমন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
কিন্তু কী এই ক্যাপটাগন এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি কীভাবে সিরিয়ার প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল?
ক্যাপটাগন কী ও কোথায় এটি উদ্ভাবিত হয়েছিল?
ক্যাপটাগন হলো আসক্তিকর এক ধরনের অ্যামফেটামিন জাতীয় উত্তেজক। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি প্রধানত সিরিয়ায় উৎপাদিত এবং উপসাগরীয় দেশগুলোতে চোরাচালান হয়েছে। এর মাধ্যমে আসাদ শাসন এই মাদককে আলোচনার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে আরব লীগের সদস্যপদ পুনঃস্থাপন করে, যখন বিভিন্ন দেশ অবৈধ মাদক বাণিজ্য রোধের চেষ্টা চালায়।
২০২৩ সালের ১ মে আম্মানে অনুষ্ঠিত আরব পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে দামেস্ক জর্ডান ও ইরাকের সঙ্গে মাদক উৎপাদন ও চোরাচালানের উৎস শনাক্ত করতে একমত হয়, জর্ডানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে এ কথা জানানো হয়। এর এক সপ্তাহ পর, দক্ষিণ সিরিয়ায় এক বিমান হামলায় এক শীর্ষস্থানীয় সিরীয় মাদক চোরাকারবারি ও তার পরিবার নিহত হয়, যা জর্ডানের প্রতি ইঙ্গিত করে।
ক্যাপটাগন প্রথমে ১৯৬০-এর দশকে জার্মানির ডেগুসা ফার্মা গ্রুপে উদ্ভাবিত একটি মানসিক ওষুধের ব্র্যান্ড নাম ছিল। এটি মূলত অমনোযোগী, নারকোলেপসি এবং কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের উত্তেজক হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
ক্যাপটাগন ট্যাবলেটে ফেনাইটাইলিন নামক একটি সিনথেটিক মাদক থাকত, যা ফেনেথাইলামিন পরিবারের একটি যৌগ। অ্যামফেটামিনও এই পরিবারে অন্তর্ভুক্ত।
১৯৮৬ সালে ফেনাইটাইলিনকে জাতিসংঘের মনোস্নায়ুতন্ত্র সংক্রান্ত মাদকদ্রব্য কনভেনশন ১৯৭১-এর তালিকা-২ তে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং অধিকাংশ দেশ ক্যাপটাগনের ব্যবহার বন্ধ করে দেয়। ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক মাদক নিয়ন্ত্রণ বোর্ড জানায়, ২০০৯ সালের পর থেকে কোনো দেশ ফেনাইটাইলিন উৎপাদন করেনি।
তাহলে উৎপাদন কি একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল?
সরকারি উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলেও পূর্ব ইউরোপ, বিশেষ করে বুলগেরিয়ায় থাকা স্টকগুলো মধ্যপ্রাচ্যে চোরাচালান করা হয়।
পরবর্তী সময়ে ১৯৯০-এর দশক থেকে ২০০০-এর দশকের শুরুর দিকে বুলগেরিয়ায় নতুন জাল ক্যাপটাগন ট্যাবলেট তৈরি হয়। ইউরোপীয় মাদক ও মাদকাসক্তি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এসব মাদক বালকান ও তুর্কি অপরাধ চক্রের মাধ্যমে আরব উপদ্বীপে চোরাচালান করা হতো।
তুরস্ক ও বুলগেরিয়া কর্তৃপক্ষের কঠোর অভিযান, যার মধ্যে অ্যামফেটামিন সংশ্লেষণের সঙ্গে জড়িত ১৮টি বড় ল্যাবরেটরি বন্ধ করে দেওয়া অন্তর্ভুক্ত, বালকান থেকে মাদক বাণিজ্যের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয়।
কেন সিরিয়ায় এত ক্যাপটাগন তৈরি হচ্ছিল?
২০১১ সালে বাশার আল-আসাদবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর সরকারের কঠোর দমন-পীড়নের পর সিরিয়া গৃহযুদ্ধের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হয়ে যাওয়া এবং যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যে দেশটি অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে।
দামেস্ক মাদক বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করলেও বিশ্লেষকেরা বলছেন, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার জন্য ক্যাপটাগনের উৎপাদন ও চোরাচালানের মাধ্যমে আসাদ ও তাঁর মিত্ররা বিলিয়ন ডলার আয় করেছে।
নিউ লাইনস ইনস্টিটিউটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষমতাচ্যুত সিরীয় সরকার হিজবুল্লাহর মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে স্থানীয় জোট গড়ে ক্যাপটাগনের উৎপাদন ও চোরাচালানে কারিগরি ও লজিস্টিক সহায়তা নিয়েছিল।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বর্তমানে বিশ্বে যত ক্যাপটাগন উৎপাদন হয়, তার বেশির ভাগই সিরিয়ায় তৈরি হয়। এসব মাদকের মূল গন্তব্য ধনী উপসাগরীয় দেশগুলো।
জর্ডান ও উপসাগরীয় দেশগুলো কী পদক্ষেপ নিয়েছে?
২০২২ সাল থেকে যেসব দেশের সীমান্ত দিয়ে প্রচুর ক্যাপটাগন পাচার হতো, সেসব দেশ সিরিয়া থেকে আসা এই মাদকের চোরাচালান বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে জর্ডানের সেনাবাহিনী জানিয়েছিল, বছরের শুরু থেকে তাঁরা ৩০ জন চোরাচালানকারীকে হত্যা করেছে এবং পাচারের চেষ্টাকালে ১ কোটি ৬০ লাখ ক্যাপটাগন ট্যাবলেট আটকে দিয়েছে—যা পুরো ২০২১ সালে জব্দ করা পরিমাণের চেয়েও বেশি।
২০২২ সালের আগস্টের শেষ দিকে সৌদি কর্তৃপক্ষ ইতিহাসে ক্যাপটাগনের সবচেয়ে বড় চালান জব্দ করে। এতে ৪ কোটি ৬০ লাখ অ্যামফেটামিন ট্যাবলেট একটি ময়দার চালানের মধ্যে পাওয়া যায়।
সৌদি জেনারেল ডিরেক্টরেট অব নারকোটিক্স কন্ট্রোলের একজন মুখপাত্র একে দেশটিতে একক মাদকবিরোধী অভিযানের সবচেয়ে বড় অপারেশন বলে উল্লেখ করেন।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবি বিমানবন্দরে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি সবুজ মটরশুঁটির ক্যানের ভেতর ৪৫ লাখ ক্যাপটাগন ট্যাবলেট পাচারের চেষ্টা করছিলেন।
বিশ্বের অন্য দেশগুলো কী করছে?
মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে ক্যাপটাগন তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত হলেও যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় এর উৎপাদন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
২০২৩ সালে উভয় দেশ ক্যাপটাগন বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত সিরীয়দের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যুক্তরাজ্যের সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়, বিশ্বের ৮০ শতাংশ ক্যাপটাগন সিরিয়ায় উৎপাদিত হয়, যা আসাদ সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করে। এর মূল্য মেক্সিকোর মোট কার্টেল বাণিজ্যের তিনগুণ।
বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়, হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠী এই মাদক উৎপাদন ও চোরাচালানে সহায়তা করছে, যা আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা ও আসক্তি বাড়াচ্ছে।
২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্র ‘ক্যাপটাগন অ্যাক্ট’ চালু করে। এর মাধ্যমে অবৈধ এই মাদক বাণিজ্য বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থাকে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। কারণ আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই মাদক যুক্তরাষ্ট্রেও পৌঁছাতে পারে।
আরব লীগে সিরিয়ার প্রত্যাবর্তন ও ক্যাপটাগন
সিরিয়া থেকে ক্যাপটাগনের উৎপাদন ও বাণিজ্য বন্ধে আরব লীগের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আগ্রহ দামেস্কের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে।
২০২৩ সালের ১ মে জর্ডানের রাজধানী আম্মানে অনুষ্ঠিত আরব পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে এক জর্ডানীয় কর্মকর্তা বলেন, সিরিয়াকে অবশ্যই রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়ে আন্তরিকতা দেখাতে হবে। কারণ, এটি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে লবিংয়ের পূর্বশর্ত। এটি সিরিয়ার পুনর্গঠনের জন্য তহবিল সংগ্রহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
২০২৩ সাল পর্যন্ত ক্যাপটাগনের সবচেয়ে বড় বাজার ছিল সৌদি আরব। দেশটি দামেস্কের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আলোচনায়ও গ্যারান্টি চায়।
যুদ্ধের প্রথম দিকের বছরগুলোতে সৌদি আরব সরকারবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আঞ্চলিক কূটনীতির পরিবর্তনের অংশ হিসেবে সিরিয়া বিষয়ে অবস্থানও বদলায়। ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার ফলেই দামেস্কের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করে রিয়াদ।
আম্মানে বৈঠকের পর মিসর, ইরাক, জর্ডান, সৌদি আরব এবং সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা জানান, সিরিয়া জর্ডান ও ইরাকের সীমান্তে চোরাচালান বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে সম্মত হয়েছে।
২০২৩ সালে সিরিয়ায় নিহত মাদক সম্রাট কে ছিলেন?
২০২৩ সালের মে মাসে কায়রোতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আরব লীগের ২২টি সদস্য রাষ্ট্র সিরিয়ার সদস্যপদ ফিরিয়ে আনতে ভোট দেয়। এর পরদিনই সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে এক বিমান হামলায় সন্দেহভাজন মাদক পাচারকারী মারাই আল-রামথান এবং তাঁর পরিবার নিহত হন।
যুদ্ধ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা জানিয়েছে, এই হামলা জর্ডান চালিয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস (এসওএইচআর) বলেছে, আল-রামথানকে সবচেয়ে প্রভাবশালী মাদক পাচারকারী এবং জর্ডানে ক্যাপটাগনসহ অন্যান্য মাদক পাচারের প্রধান ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হতো।