ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫৯টি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প নিয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার এই বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো বাতিল করে। এগুলোর মধ্যে ৪০টি কেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হবে। ১০টি কেন্দ্রের জন্য গত ডিসেম্বরে দরপত্র আহ্বান করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। কিন্তু দরপত্রের শর্তের কারণে বিগত সময়ে বিদ্যুৎ খাতে সুবিধাপ্রাপ্ত ও এসব কেন্দ্র স্থাপনে অনুমতির শেষ পর্যায়ে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোই এবারও এগিয়ে।
বিদ্যুৎসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগে গুঞ্জন রয়েছে, বিগত আমলে সুবিধা পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র পাইয়ে দিতে নেপথ্যে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট আলোচনা করছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ৪৮টি নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমতি দেওয়া হয়। এগুলোর মধ্যে ১০টি উৎপাদনে এসেছে, বাকিগুলো নির্মাণাধীন। এর মধ্যে সরকারি মালিকানার কেন্দ্র ৭টি, বাকিগুলো বেসরকারি মালিকানার। এসব কেন্দ্রের মধ্যে দুটি বায়ু ও দুটি বর্জ্যভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
সূত্র জানায়, প্রতি মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ৩ একর জমি প্রয়োজন। এ হিসাবে ৩০ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্র নির্মাণে প্রয়োজন ৯০ একর বা ২৭০ বিঘা জমি। তবে এই জমির পুরোটাই হতে হবে অকৃষি। এ শর্তের কারণে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের গতি শ্লথ। বিগত সরকার ৫৯টি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমতি দেওয়ার শেষ পর্যায়ে ছিল। এসব কেন্দ্র নিতে আগ্রহী প্রতিষ্ঠান ওই সময় জমি কেনা বা সংগ্রহের কাজ শেষ করেছিল। তবে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার ওই ৫৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাতিল করে। এগুলোর মধ্যে ১০টি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র আগে নির্ধারিত স্থানে নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম গতকাল শনিবার বিকেলে মোবাইল ফোনে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যাঁরা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবসা করেন বা এই লাইনের লোক, তাঁদের সব ধরনের কাগজপত্রের প্রস্তুতি থাকে। আমরা আশাবাদী যে এই সময়ের মধ্যে ব্যবসায়ীরা দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী কাগজপত্র জমা দিতে পারবেন। যদি না পারেন, তখন বিষয়টি ভেবে দেখা যাবে।’
পিডিবির প্রকৌশলীরা বলছেন, ৫ ডিসেম্বর দেশের ৯টি স্থানে ১০টি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২০২৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী, কেন্দ্র করতে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) উপকেন্দ্র থেকে সর্বোচ্চ ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে ১০০ থেকে ১৫০ একর জমি থাকতে হবে এবং কেন্দ্র চালানোর দুই বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু ৯০ দিনের মধ্যে কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে নির্দিষ্ট এলাকায় ১০০ থেকে ১৫০ একর অকৃষি জমি সংগ্রহ করা কঠিন। দেশে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়া কোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দুই বছর এমন কেন্দ্র চালানোর অভিজ্ঞতা নেই। তাই বিগত সরকারের সময়ে কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে দেশে একটি কোম্পানি গঠন করে সেই কোম্পানির নামে কেন্দ্র নিতে আবেদন করেছিল। কিন্তু এখন এত অল্প সময়ে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠান এমন কোম্পানি করতে পারবে না।
পিডিবির সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলছেন, বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের কোম্পানি খুলতে অনেক সময় লাগবে। ৫০ মেগাওয়াটের একটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে যদি ৮০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়, এর ২০ শতাংশ বৈধ অর্থ উদ্যোক্তাদের থাকতে হবে। বিদেশি বা লিড কোম্পানিকে আবার এই ২০ শতাংশ অর্থের অর্ধেকের বেশি দিতে হবে। এই শেয়ারের মালিকানা পেতে আগ্রহী বিদেশি কোম্পানিকে বিদেশ থেকে বাংলাদেশের সরকারি বা বেসরকারি ব্যাংকে মার্কিন ডলার দিতে হবে। সেই ডলার পাওয়ার সনদ নিয়ে যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরে জমা দিতে হবে। এরপর যৌথ বিনিয়োগের কোম্পানি গঠন করা যাবে। এরপর ওই বিদেশি কোম্পানির গত পাঁচ বছরের অডিট রিপোর্ট, আর্থিক রিপোর্টসহ বিভিন্ন ধরনের তথ্য দিতে হবে নিজ নিজ দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়া করতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানবিশেষে এক বছরও লেগে যায়। ফলে এই দরপত্রে নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানের অংশ নেওয়ার সম্ভাবনা কম। বরং বিগত সরকারের সময়ে অনুমতি পাওয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোই অংশ নিতে পারবে।
শর্তপূরণে সক্ষম কেবল পুরোনোরা
যে ১০টি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে নোয়াখালীর সুধারাম উপকেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ১০ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্র। বিগত সরকারের আমলে সেখানে ১০ মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য গ্লোবাল গ্রিনজেন লিমিটেড অনুমতি পাওয়ার শেষ পর্যায়ে ছিল। শর্ত অনুযায়ী জমি থাকায় এবারও গ্লোবাল গ্রিনজেন দরপত্রে অংশ নেবে বলে জানা গেছে। সেখানে আর কোনো প্রতিষ্ঠানের হাতে এই জমি নেই।
চট্টগ্রামের রাউজানে গত সরকারের আমলে ১৫ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি চূড়ান্ত হয়েছিল, যা ছিল চীনা রিসোর্স পাওয়ার হোল্ডিংস কোম্পানি লিমিটেড ও কর্ণফুলী এনার্জি লিমিটেড বাংলাদেশের। এখন সেখানে ১৮ মেগাওয়াটের একটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এই কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় জমি ওই দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকায় দরপত্রে অংশ নিলে তারাই অনুমতি পাবে।
কক্সবাজারের টেকনাফে ৩০ মেগাওয়াটের একটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে সেখানে একই ক্ষমতার একটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতির শেষ পর্যায়ে ছিল, যেটি পেতে যাচ্ছিল প্রগতি কনসোর্টিয়াম ও পিডিএল গ্রিনি সোলার পাওয়ার লিমিটেডের কনসোর্টিয়াম। পিডিবির প্রকৌশলীরা বলছেন, দরপত্রের শর্তের কারণে এবারও ওই কনসোর্টিয়ামের পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে বিগত সরকারের আমলে একটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি প্রক্রিয়াধীন ছিল। এবারও সেখানে ২৫ মেগাওয়াটের একটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। মৌলভীবাজারে ২৫ মেগাওয়াটের একটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি বিগত সরকারের আমলে প্রায় শেষ পর্যায়ে ছিল। কেন্দ্রটি পেতে যাচ্ছিল ভিদুলঙ্কা, উইন্ড ফোর্স ও আইকোন এনার্জি নামের তিনটি কোম্পানির কনসোর্টিয়াম। এবার সেখানে একই ক্ষমতার একটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের দরপত্র ডাকা হয়েছে। এই তিনটি কোম্পানির কনসোর্টিয়ামের কাছে কেন্দ্র করার প্রয়োজনীয় জমি আছে।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য তাহজীব আলম সিদ্দিকীর প্রতিষ্ঠান ডরিন পাওয়ারের মালিক এশিয়ান এনটেক পাওয়ার করপোরেশন এবং জাপানি প্রতিষ্ঠান এক্সিয়া পাওয়ার হোল্ডিং যৌথভাবে একটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি পাওয়ার শেষ পর্যায়ে ছিল। সেখানে এবার একটি ৪৫ মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের দরপত্র ডাকা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তাহজীব আলম সিদ্দিকী একটি হত্যাসহ তিনটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ১ ডিসেম্বর তিনি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
সরকারি প্রতিষ্ঠান অংশ নিতে পারছে না
দরপত্রে অংশ নিতে দুই বছর কেন্দ্র চালানোর অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর এক থেকে দেড় বছরের অভিজ্ঞতা থাকায় সেগুলো এই দরপত্রে অংশ নিতে পারছে না। অন্যদিকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো কেন্দ্র চালানোর অভিজ্ঞতা মূলত বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে কথিত জয়েন্ট ভেঞ্চার দেখিয়ে পূরণ করে। বিগত সরকারের আমলে যে কোম্পানিগুলোকে অনুমতির জন্য প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছিল, সেগুলোও ছিল দেশি ও বিদেশি কোম্পানির জয়েন্ট ভেঞ্চার। অভিযোগ রয়েছে, এই যৌথ মালিকানা মূলত কাগজ-কলমে, বাস্তবে মালিক হয় দেশি কোম্পানি।
প্রসঙ্গত, সারা বিশ্বে যখন সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কমছে, তখন দেশে ব্যয় অনেক বেশি। ভারতে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি ইউনিটে ব্যয় পড়ছে গড়ে ৫ দশমিক ৩ সেন্ট ও পাকিস্তানে ৩ দশমিক ২ সেন্ট। দেশে সৌরবিদ্যুতের যেসব চুক্তি করা হয়েছে বেসরকারি কেন্দ্রের সঙ্গে, তাদের উৎপাদন ব্যয় ১১ সেন্ট থেকে ১৯ সেন্ট পর্যন্ত। নতুন যে ১০টি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য সরকারের সঙ্গে চুক্তি হবে সেগুলোর উৎপাদন ব্যয় ৯ থেকে ১০ সেন্টের মধ্যে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, সিন্ডিকেট মুক্ত করতে না পারলে এই পরিবর্তনের কোনো মূল্য নেই। আর দরপত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবশ্যই বিশেষ ব্যবস্থায় রাখতে হবে। এসব না করা হলে সবকিছু আগের মতোই চলছে, চলবে।