ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিবের সফর

সম্পাদকীয়

প্রকাশ : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭: ৪০

ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি আজ ঢাকা আসছেন। তাঁর এই সফর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি এমন এক সময় ঘটছে, যখন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিকপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে দুই দেশের সম্পর্ক এখন দ্বন্দ্বময় এবং কিছুটা অবিশ্বাসে ঘেরা। শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক যে উষ্ণতায় পৌঁছেছিল, সেটা ভারসাম্যপূর্ণ ছিল না বলেই মনে করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের সক্রিয় সমর্থন এবং পরবর্তী বিভিন্ন পর্যায়ে সহযোগিতা বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের কৌশলগত বন্ধুত্বের ভিত্তি গড়ে তুলেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারে না থাকলে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কে অস্বস্তি তৈরি হওয়া নতুন বিষয় নয়।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ভারতের গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক পরিসরে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা শুরু হয়েছে। সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ বারবার তুলে ধরা হচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই অভিযোগকে অতিরঞ্জিত বলা হয়েছে। এই ধরনের অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সৌহার্দ্যের পরিপন্থী।

এমন পটভূমিতে বিক্রম মিশ্রির ঢাকা সফর বহুমুখী তাৎপর্য বহন করছে। ফরেন অফিস কনসালটেশনের (এফওসি) মাধ্যমে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা দুই দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ককে একটি দৃঢ় ভিত্তি দিতে পারে। আমরা আশা করব, এফওসির বৈঠক শুধু কূটনৈতিক সৌজন্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এটি হবে সম্পর্ক পুনর্গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।

তবে এখানে আরেকটি প্রশ্ন সামনে আসে—সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগের সত্যতা এবং এর প্রচারের পেছনে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ভূমিকা কতটা। বাংলাদেশের জনগণের দৃষ্টিকোণ থেকে এই অভিযোগগুলো সরাসরি আঞ্চলিক কূটনীতির ভারসাম্যে প্রভাব ফেলছে। একই সঙ্গে, চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের মতো সংখ্যালঘু নেতাদের বিচারপ্রক্রিয়া এবং স্বচ্ছতার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশ ও ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক ঐতিহাসিক ভিত্তিতে দৃঢ় হলেও, সাম্প্রতিক অস্থিরতা দুই দেশের জন্যই খুব প্রীতিকর নয়। এ ধরনের অস্বস্তি দূর করার জন্য প্রয়োজন কূটনৈতিক পর্যায়ে গভীর আলোচনা এবং বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ।

রাজনীতিবিদেরা প্রকাশ্য বক্তৃতায় যে রকম উত্তেজক কথাবার্তা বলতে পারেন, কূটনীতিকেরা তা পারেন না। কূটনীতিকদের কথা ধারে নয়, ভারে কাটে। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে ভারতীয় প্রতিনিধিদের কাছে নিজেদের অবস্থান স্পষ্টভাবে তুলে ধরা। একই সঙ্গে ভারতকেও আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কোনো বিশেষ দল বা ব্যক্তিবিশেষের ওপর নয়, দৃষ্টি দিতে হবে দেশের মানুষের বৃহত্তর স্বার্থের দিকে।

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক শুধু ভৌগোলিক প্রতিবেশের কারণে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ভিত্তিও। বিক্রম মিশ্রির সফর এ সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে, নাকি চলমান অস্বস্তি আরও গভীর করবে, তা নির্ভর করবে আলোচনার পরিণতির ওপর। আমরা আশা করি, এ সফর দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সমতার ভিত্তিতে একটি দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সব ধরনের দ্বৈত নীতির অবসান ঘটাতে সহায়ক হবে।