ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বাবা মারা গেলে কষ্টের জীবন শুরু হয় খাদিজা খানমের। তিন বোন, এক ভাইয়ের মধ্যে খাদিজা বড়। অনেক কষ্টে ১৯৯৫ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেন তিনি। ২০০০ সালে একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি নেন তিনি। এরপর ২০১৫ সালে উচ্চমাধ্যমিক এবং ২০২০ সালে ডিগ্রি পাস করেন। দুই ছেলে ও স্বামীর সঙ্গে কাপাসিয়া থানা সদরের বরুণ গ্রামে বাস করেন খাদিজা খানম। তাঁর দুই ছেলে রিজওয়ান মাহমুদ রাফি ও রিদওয়ান আহমেদ রিফান ২০২৫ সালে কাপাসিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষার্থী।
প্রশিক্ষণ পথ দেখায়
সেলাইয়ের কাজ করে টিকে থাকা যাবে—এমন ভাবনা থেকে ২০১১ সালে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে ২১ দিনের সেলাই প্রশিক্ষণ নেন খাদিজা খানম। এরপর যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে ৩৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে একটি সেলাই মেশিন এবং কিছু কাপড় কিনে শুরু করেন নিজের ছোট ব্যবসা। দক্ষ হলে কাজের অভাব হবে না—এ ভাবনা থেকে কাজের ফাঁকে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর এবং এসএমই ফাউন্ডেশনের ফ্যাশন ডিজাইন প্রশিক্ষণ নেন। এ ছাড়া বিভিন্ন অকুপেশনে দক্ষতা বাড়ানোর জন্য এনএসডিএ থেকে লেভেল টু এবং থ্রি অর্জন করে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, জেলা পরিষদ, সমবায় অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করে থাকেন।
এ সময় খাদিজা নারীদের হাতেকলমে শিখিয়েছেন ব্লক-বাটিক, সূচি শিল্প, গয়না তৈরি, বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী নকশি সেলাইয়ের শাড়ি থ্রিপিস ফতুয়া পাঞ্জাবি এবং পাট পণ্য তৈরির কাজ।
খাদিজার কার্যক্রম
ব্লক-বাটিকসহ, কাপড়ে নকশা করা, হাতের সেলাই বিষয়ক কাজ, পাটজাত নানান পণ্য তৈরির ওপর গ্রামের নারীদের প্রশিক্ষণ দেন খাদিজা। এরপর তাঁদের তৈরি পণ্য বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করেন তিনি। সাড়ে তিন শতাধিক নারী তাঁর সঙ্গে কাজ করে এখন স্বাবলম্বী। গ্রামীণ ঐতিহ্য ধরে রাখতে তালপাতা, নারকেল পাতা, কচুরিপানা ও কলাপাতা দিয়ে হরেক রকম হস্তশিল্প তৈরি করে তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করেন। এসব কাজের সূত্র ধরে খাদিজা খানমের বিনিয়োগকৃত ৩৫ হাজার টাকা থেকে এখন ৮ লাখ ছাড়িয়েছে। এসব কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ২০১৫ সালে জয়িতা অ্যাওয়ার্ড, সমবায় থেকে সম্মাননা অ্যাওয়ার্ডসহ ২০১৮ সালে জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ যুব পুরস্কার পান। ২০২৩ সালে চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র থেকে পর্যটন মেলায় প্রথম পুরস্কার হিসেবে জাপানের টিকিট ফ্যামিলি টুরের জন্য আপ-ডাউন টিকিট পান। তা ছাড়া ছোট-বড় অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি।
বর্তমানে খাদিজা গাজীপুর উইমেন্স চেম্বার অব কমার্সের পরিচালনা পরিষদের একজন পরিচালক। এ ছাড়া ‘নারীর সাজ হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান ও প্রশিক্ষণ সেন্টার’ নামে একটি হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান এবং ইয়াম্মি অ্যাগ্রো অ্যান্ড ফুডস ওয়ার্ল্ডের মালিক তিনি।
তাঁরা ভালো আছেন
শাহিনুর, জেসমিন, নাছিমা, শিলা, ময়নাসহ শত নারীর জীবনে আলো হয়ে দেখা দিয়েছেন খাদিজা খানম। তাঁর দেওয়া প্রশিক্ষণ আর সহায়তায় তাঁরা অনেকেই এখন প্রতিষ্ঠিত। ময়না নামের একজন বলেন, ‘খাদিজা খানম আপার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এবং তাঁর দেওয়া হাতের কাজ করে টাকা আয় করতে পারি। সংসারের বিভিন্ন চাহিদা পূরণ করতে পারি। এখন কাজ করে ভালো আছি।’
আছে অন্য ব্যবসা
খাদিজা খানমের একটি প্রতিষ্ঠান ইয়াম্মি এগ্রো অ্যান্ড ফুডস। এখানে তৈরি হয় কাঁঠালের আচার, চিপস, বার্গার, পাকোড়া, পিৎজা, বিরিয়ানি, কাবাব, পিঠাসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার। তা ছাড়া বিভিন্ন মৌসুমি ফল ও সবজির আচার। খাদিজা খানমের উদ্যোগ গ্রামের নারীদের দক্ষ করে এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করছে।
সমাজ পরিবর্তনের আশা
গ্রামের পিছিয়ে পড়া নারীদের এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে সমাজের মূল স্রোতে তাদের ফিরিয়ে নিতে গঠন করেন উদ্যোগী নারী উন্নয়ন সংগঠন নামের একটি সংগঠন। সংগঠনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় জমা করে তা দিয়ে যেন আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনা যায়, সেই প্রচেষ্টা খাদিজা খানমেন।
ভবিষ্যতের ভাবনা
দেশের নারীদের আরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে চান খাদিজা খানম। তাঁর হাত ধরে কয়েক শ উদ্যোক্তা তৈরি হয় গাজীপুর জেলাসহ নরসিংদী ও ময়মনসিংহ এলাকায়। উদ্যোক্তা তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের দক্ষ করে গড়ে তোলা হয়। যাতে তাঁরা আরও অনেক নারীর জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন।