ইমরান খান
১৮ মাস পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুয়ার খোলায় লাখো শিক্ষার্থীর স্বস্তি ফিরেছে। এর মাঝে দেশ দেখল কুড়িগ্রামের নার্গিস নাহারের বিষণ্ন চোখের এক আতঙ্কিত চাহনি। এই আতঙ্ক আট বান্ধবীর বিয়েতে ক্লাসে একমাত্র ছাত্রী হয়ে যাওয়ার, একাকিত্বের। এর আগে অবশ্য তাকে সংগ্রামও করতে হয়েছে। হুড়মুড় করে বান্ধবীদের বিয়ের মধ্যেই সে পরিবারকে বলেছে, ‘পড়াশোনা শেষে একটি চাকরি করে নিজের অবস্থা তৈরি করে, তবেই বিয়ে করব। এর আগে নয়। নিজে স্বাবলম্বী না হয়ে অন্যের কাঁধে বোঝা হয়ে থাকতে চাই না।’
নার্গিস সাহস দেখিয়েছে, পরিবারকে মানাতে পেরেছে। কিন্তু নূরবানু, নাজমা, স্বপ্না ও হেলেনার মতো অনেকে তা পারেনি। তাদের মনের এতটা জোর ছিল না। তাদের ঠিকই বলতে হয়েছে—‘আপনেরা যেটা ভালো মনে করেন, তাই করেন।’ এই ভেলায় চড়ে এখন অনেক কচি হাতে খড়ি উঠেছে, কাঁধে চেপেছে হেঁশেলের ভার। ‘আপনাদের পছন্দই আমার পছন্দ’ না বলে জীবনসঙ্গী পছন্দের সাহসটিও দেখাতে পারেনি অনেকে। পরিবারের জোরাজুরিতে ইচ্ছের বিরুদ্ধেও অনেকে বসেছে বিয়ের পিঁড়িতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশের ৫০ শতাংশ স্ত্রী যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। এই কোমলমতিদের অনেকের ওপরও হয়তো উঠে এসেছে যৌতুকসহ নানা কারণে নির্যাতনের খড়্গ।
আজ জাতীয় কন্যাশিশু দিবসে এসে এই আলোচনা তোলা প্রাথমিকভাবে অযৌক্তিক মনে হতে পারে। তবে সারা দেশের বাল্যবিয়ের চিত্র দেখলে স্পষ্ট হবে এই আলোচনা কেন জরুরি। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলায় ৫৯ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৩৮ মাদ্রাসার ৫৭৭ জন শিক্ষার্থীর হাতে লেগেছে মেহেদির রং। যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বল্লা বিএনকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ১২৩ জন ছাত্রীর মধ্যে ৩০ ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ১০৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার দেড় শতাধিক ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। বয়স না হওয়ায় কাবিননামা ছাড়াই তারা এখন কারও না কারও স্ত্রী।
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার কলাবাড়ি ইউনিয়নের কুমারী রেখা রানী গার্লস হাইস্কুলের ৯ ছাত্রী এসএসসি পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন করার কথা থাকলেও করেনি ৫ জন; তাঁরা এখন স্বামীর ঘরে। টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে চানতার গণ-উচ্চবিদ্যালয়ে অষ্টম ও দশম শ্রেণিতে ৪৬ ও ৫৩ ছাত্রীর রেজিস্ট্রেশন করার কথা থাকলেও করেনি ৭ ও ১৫ জন। একই জেলার নাগরপুরের মামুদনগর উচ্চবিদ্যালয়ের কমপক্ষে ২০ শিক্ষার্থীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। পটুয়াখালীসহ উপকূলীয় এলাকায়ও আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে বাল্যবিবাহ। পটুয়াখালীর মোট ২৯৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ২৬১টি মাদ্রাসার মধ্যে বহু প্রতিষ্ঠানের প্রতিটিতে অন্তত ৩০ থেকে ৪০ জনের বিয়ে হয়েছে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক জরিপে দেখা গেছে, করোনাকালে বরগুনায় রেকর্ড ১ হাজার ৫১২টি বাল্যবিবাহ হয়েছে। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম ১ হাজার ২৭২, নীলফামারীতে ১ হাজার ২২২, লক্ষ্মীপুরে ১ হাজার ৪১ এবং কুষ্টিয়ায় ৮৮৪টি বাল্যবিবাহ হয়েছে। নমুনায়ন বিবেচনায় দেশের বাকি জেলার অবস্থা যে মোটামুটি একই রকম, তা বলাই যায়। সারা দেশের নিখুঁত হিসাব না থাকলেও এ জরিপ হিসাবে বাল্যবিয়ের সংখ্যা অন্তত ৭০ থেকে ৮০ হাজারে ঠেকাও অস্বাভাবিক নয়। আন্তর্জাতিক সংগঠন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের জরিপ বলছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত কুড়িগ্রামে ধারাবাহিকভাবে বাল্যবিয়ের হার বেড়েছে। এ সময়ে নিবন্ধিত বিয়ের সংখ্যা কমেছে, বেড়েছে অনিবন্ধিত বিয়ে, যা এক বড় ঝুঁকি তৈরি করছে।
বাল্যবিবাহের শিকার ছাত্রীদের বেশির ভাগই ঝরে পড়েছে। বিয়ের সিদ্ধান্তে পরিবারকে ‘না’ বলতে না পারা কয়জনই-বা রংপুরের বদরগঞ্জের স্বপ্নার (ছদ্ম নাম) মতো বলতে পারে—‘স্বামী পড়াতে না চাইলে সংসার ছেড়ে দেব।’ আর কয়জনই-বা ভোলা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রী সোমার (ছদ্ম নাম) মতো স্বামী পায়, যে স্ত্রীকে স্কুল গেটে পৌঁছে দেয়। বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সমাজের কটূক্তির শঙ্কায় অসহ্য-অকথ্য নির্যাতন সহ্য করে স্বামীর সংসারে একটা মর্মান্তিক জীবন কাটিয়ে দেওয়ার ভাগ্য বরণ করে নিতে হয়।
বিয়ের মতো জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে এই কোমলমতিদের মতামত কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। ব্র্যাকের এক গবেষণায় বলা হয়, ৮৫ শতাংশ বাল্যবিবাহ হয়েছে মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তার কারণে। ৭১ শতাংশ হয়েছে মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য। প্রবাসী ছেলে হাতের কাছে পাওয়ায় ৬২ শতাংশ শিক্ষার্থীকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। অভিভাবকদের মন্তব্যে প্রকটভাবে দেখা যায়, ‘মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি’-এর প্রবণতা, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের ওপর বিয়ে চাপিয়ে দেওয়ার শামিল।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) সর্বশেষ জরিপ মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯ (এমআইসিএস) অনুসারে দেশে ১৫ বছরের কম বয়সী ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ শিশুর এমন বাল্যবিবাহ হয়।
এসব সিদ্ধান্তের পেছনে নিজস্ব কিছু যুক্তিও দাঁড় করিয়েছেন অভিভাবকেরা। বরগুনার সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের পোটকাখালী গ্রামের অভিভাবকের বক্তব্য, ‘দুইডা বচ্ছর ইশকুল বন্ধ। মাইয়া ডাঙ্গর অইছে, হেই চিন্তায় ঘুম আয়না। পোলাপানে জ্বালায়। একটা বিপদ ঘডাইয়া হালাইলে, ইজ্জাত থাকপে না। হের চাইতে পোলা পাইছি, বিয়া দিয়া দিছি।’ অর্থাৎ, নিরাপত্তার অভাবই এখানে বাল্যবিয়ের নিয়ামক হয়ে উঠেছে।
কুড়িগ্রামের নাজিম আলীর বয়ানে অবশ্য যৌতুকের বিষয়টিই মুখ্য। তাঁর ভাষ্য, ‘মেয়ে লোকের ফুট ভাসলে বিয়ে দিতে হয়। ২১,২২, ২৩ বছর হলে কে নিবে মেয়েকে? কেউ নেবেন নয়। মেয়ে যত বড় হবে—দু, আড়াই, তিন, পাঁচ লাখ ডিমান্ড হবে। মেয়ের একটু বয়স হলেই কয়—এক লাখে হবার নয়, হাত-পায়ের সোনা দেওয়া নাগবে।’ আর কুমিল্লার হারাধন এত এত প্রচার সত্ত্বেও এখনো বুঝতেই পারেননি পড়ালেখা করে কী হবে। তাঁর প্রশ্ন—‘পড়ালেখা করে কী করবে? পাত্র ভালো, সাউথ আফ্রিকা থাকে। তাই বিয়ে দিয়েছি।’
অর্থাৎ, উত্তর কিংবা দক্ষিণ যেদিকেই যাওয়া যাক না কেন, বাল্যবিয়ে নিরোধে নেওয়া এত এত প্রচার কোনো কাজেই আসেনি। একটি ঘোষণার মধ্যেই কেবল বিষয়টি আটকে থেকেছে। না হলে এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হতো। পড়ালেখার প্রয়োজনীয়তা থেকে শুরু করে যৌতুক নিরোধ বা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নানা সংকটের আশঙ্কাগুলো নিয়ে যথেষ্ট প্রচারের ব্যবস্থা করা হতো। নেওয়া হতো এসব প্রচারকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পদক্ষেপ। কিন্তু এসব কিছু করা হয়নি। শুধু মুখে বলা হয়েছে—বাল্যবিবাহ আর নয়। টিভিতে হাসিখুশি বিজ্ঞাপন হয়েছে। উপজেলা বা স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে বাল্যবিয়ে নিরোধে প্রশাসনিক অভিযান হয়েছে ও হচ্ছে। কিন্তু এরপর আর কেউ খোঁজ রাখছে না যে, যে কারণে ওই মেয়ে শিশুর অভিভাবক সন্তানকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তার সমাধান হয়েছে কি-না।
এভাবে হওয়া বিয়ে মেনে নেওয়ার জন্য শিশুদের মানসিকতা প্রস্তুত হওয়ার কথা নয়। স্বামীর পরিবারের সবার সঙ্গে ‘মানিয়ে নেওয়ার’ কাজটাও তাঁদের জন্য সহজ নয়। এতে সংসারে দেখা দিতে পারে দ্বন্দ্ব। সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রেও দেখা দিতে পারে নানা জটিলতা। শিক্ষার অধিকারবঞ্চিত এ মেয়েরা মা হয়ে সন্তানদের কতটা সুষমভাবে গড়ে তুলতে পারবে, তা নিয়েও সংশয় আছে।
তবে বাল্যবিবাহ ঠেকাতে প্রশাসন টুকটাক কিছু পদক্ষেপ নিলেও তা যথেষ্ট নয়। আবার ইউএনওদের বাধায় বিয়ে ভেঙে গেলে বর-কনে দুই পরিবারই আর্থিক-সামাজিক ক্ষতির মুখে পড়ে। এদিকে গোপনেও বিয়ে হয়েছে অনেকের। সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে বাল্যবিবাহমুক্ত করতে চায় বলে লন্ডনে অনুষ্ঠিত গার্ল সামিটে বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ লক্ষ্য এখন পর্যন্ত মুখে এবং প্রশাসনিক কিছু তাৎক্ষণিক ব্যবস্থার মধ্যে সীমায়িত হয়ে আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যত দিন অভিভাবক শুধু নয় বাল্যবিয়ের আলোচনার মাঝখানেই সবাইকে থামিয়ে দিয়ে ‘না’ শব্দটি দৃঢ়তার সঙ্গে মেয়ে শিশুরা উচ্চারণ করতে না পারবে, তত দিন পর্যন্ত এ সংকটের সমাধান হবে না। আর এই দৃঢ়তাটি এমনি এমনি আসবে না, আসে না। এর জন্য অনেকগুলো বিষয় নিশ্চিত করতে হয়। এর সঙ্গে জড়িত পরিবারের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, সামাজিক নিরাপত্তা, নারী অধিকার শব্দবন্ধের যথাযথ অনুধাবন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সত্যিকারের শূন্য সহনশীলতার নীতিসহ বহু বিষয়। এর একটিও যদি বাদ যায়, তবে এই কোমলমতি শিশুদের মধ্যে ‘না’ বলার দৃঢ়তাটি আসবে না। আর তত দিন পর্যন্ত কন্যা শিশু দিবস পালন নিছক আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কিছু নয়।
১৮ মাস পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুয়ার খোলায় লাখো শিক্ষার্থীর স্বস্তি ফিরেছে। এর মাঝে দেশ দেখল কুড়িগ্রামের নার্গিস নাহারের বিষণ্ন চোখের এক আতঙ্কিত চাহনি। এই আতঙ্ক আট বান্ধবীর বিয়েতে ক্লাসে একমাত্র ছাত্রী হয়ে যাওয়ার, একাকিত্বের। এর আগে অবশ্য তাকে সংগ্রামও করতে হয়েছে। হুড়মুড় করে বান্ধবীদের বিয়ের মধ্যেই সে পরিবারকে বলেছে, ‘পড়াশোনা শেষে একটি চাকরি করে নিজের অবস্থা তৈরি করে, তবেই বিয়ে করব। এর আগে নয়। নিজে স্বাবলম্বী না হয়ে অন্যের কাঁধে বোঝা হয়ে থাকতে চাই না।’
নার্গিস সাহস দেখিয়েছে, পরিবারকে মানাতে পেরেছে। কিন্তু নূরবানু, নাজমা, স্বপ্না ও হেলেনার মতো অনেকে তা পারেনি। তাদের মনের এতটা জোর ছিল না। তাদের ঠিকই বলতে হয়েছে—‘আপনেরা যেটা ভালো মনে করেন, তাই করেন।’ এই ভেলায় চড়ে এখন অনেক কচি হাতে খড়ি উঠেছে, কাঁধে চেপেছে হেঁশেলের ভার। ‘আপনাদের পছন্দই আমার পছন্দ’ না বলে জীবনসঙ্গী পছন্দের সাহসটিও দেখাতে পারেনি অনেকে। পরিবারের জোরাজুরিতে ইচ্ছের বিরুদ্ধেও অনেকে বসেছে বিয়ের পিঁড়িতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশের ৫০ শতাংশ স্ত্রী যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। এই কোমলমতিদের অনেকের ওপরও হয়তো উঠে এসেছে যৌতুকসহ নানা কারণে নির্যাতনের খড়্গ।
আজ জাতীয় কন্যাশিশু দিবসে এসে এই আলোচনা তোলা প্রাথমিকভাবে অযৌক্তিক মনে হতে পারে। তবে সারা দেশের বাল্যবিয়ের চিত্র দেখলে স্পষ্ট হবে এই আলোচনা কেন জরুরি। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলায় ৫৯ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৩৮ মাদ্রাসার ৫৭৭ জন শিক্ষার্থীর হাতে লেগেছে মেহেদির রং। যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বল্লা বিএনকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ১২৩ জন ছাত্রীর মধ্যে ৩০ ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ১০৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসার দেড় শতাধিক ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। বয়স না হওয়ায় কাবিননামা ছাড়াই তারা এখন কারও না কারও স্ত্রী।
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার কলাবাড়ি ইউনিয়নের কুমারী রেখা রানী গার্লস হাইস্কুলের ৯ ছাত্রী এসএসসি পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন করার কথা থাকলেও করেনি ৫ জন; তাঁরা এখন স্বামীর ঘরে। টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে চানতার গণ-উচ্চবিদ্যালয়ে অষ্টম ও দশম শ্রেণিতে ৪৬ ও ৫৩ ছাত্রীর রেজিস্ট্রেশন করার কথা থাকলেও করেনি ৭ ও ১৫ জন। একই জেলার নাগরপুরের মামুদনগর উচ্চবিদ্যালয়ের কমপক্ষে ২০ শিক্ষার্থীর বাল্যবিবাহ হয়েছে। পটুয়াখালীসহ উপকূলীয় এলাকায়ও আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে বাল্যবিবাহ। পটুয়াখালীর মোট ২৯৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ২৬১টি মাদ্রাসার মধ্যে বহু প্রতিষ্ঠানের প্রতিটিতে অন্তত ৩০ থেকে ৪০ জনের বিয়ে হয়েছে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক জরিপে দেখা গেছে, করোনাকালে বরগুনায় রেকর্ড ১ হাজার ৫১২টি বাল্যবিবাহ হয়েছে। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম ১ হাজার ২৭২, নীলফামারীতে ১ হাজার ২২২, লক্ষ্মীপুরে ১ হাজার ৪১ এবং কুষ্টিয়ায় ৮৮৪টি বাল্যবিবাহ হয়েছে। নমুনায়ন বিবেচনায় দেশের বাকি জেলার অবস্থা যে মোটামুটি একই রকম, তা বলাই যায়। সারা দেশের নিখুঁত হিসাব না থাকলেও এ জরিপ হিসাবে বাল্যবিয়ের সংখ্যা অন্তত ৭০ থেকে ৮০ হাজারে ঠেকাও অস্বাভাবিক নয়। আন্তর্জাতিক সংগঠন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের জরিপ বলছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত কুড়িগ্রামে ধারাবাহিকভাবে বাল্যবিয়ের হার বেড়েছে। এ সময়ে নিবন্ধিত বিয়ের সংখ্যা কমেছে, বেড়েছে অনিবন্ধিত বিয়ে, যা এক বড় ঝুঁকি তৈরি করছে।
বাল্যবিবাহের শিকার ছাত্রীদের বেশির ভাগই ঝরে পড়েছে। বিয়ের সিদ্ধান্তে পরিবারকে ‘না’ বলতে না পারা কয়জনই-বা রংপুরের বদরগঞ্জের স্বপ্নার (ছদ্ম নাম) মতো বলতে পারে—‘স্বামী পড়াতে না চাইলে সংসার ছেড়ে দেব।’ আর কয়জনই-বা ভোলা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রী সোমার (ছদ্ম নাম) মতো স্বামী পায়, যে স্ত্রীকে স্কুল গেটে পৌঁছে দেয়। বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সমাজের কটূক্তির শঙ্কায় অসহ্য-অকথ্য নির্যাতন সহ্য করে স্বামীর সংসারে একটা মর্মান্তিক জীবন কাটিয়ে দেওয়ার ভাগ্য বরণ করে নিতে হয়।
বিয়ের মতো জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে এই কোমলমতিদের মতামত কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। ব্র্যাকের এক গবেষণায় বলা হয়, ৮৫ শতাংশ বাল্যবিবাহ হয়েছে মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তার কারণে। ৭১ শতাংশ হয়েছে মেয়েদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য। প্রবাসী ছেলে হাতের কাছে পাওয়ায় ৬২ শতাংশ শিক্ষার্থীকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। অভিভাবকদের মন্তব্যে প্রকটভাবে দেখা যায়, ‘মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি’-এর প্রবণতা, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুদের ওপর বিয়ে চাপিয়ে দেওয়ার শামিল।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) সর্বশেষ জরিপ মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯ (এমআইসিএস) অনুসারে দেশে ১৫ বছরের কম বয়সী ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ শিশুর এমন বাল্যবিবাহ হয়।
এসব সিদ্ধান্তের পেছনে নিজস্ব কিছু যুক্তিও দাঁড় করিয়েছেন অভিভাবকেরা। বরগুনার সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের পোটকাখালী গ্রামের অভিভাবকের বক্তব্য, ‘দুইডা বচ্ছর ইশকুল বন্ধ। মাইয়া ডাঙ্গর অইছে, হেই চিন্তায় ঘুম আয়না। পোলাপানে জ্বালায়। একটা বিপদ ঘডাইয়া হালাইলে, ইজ্জাত থাকপে না। হের চাইতে পোলা পাইছি, বিয়া দিয়া দিছি।’ অর্থাৎ, নিরাপত্তার অভাবই এখানে বাল্যবিয়ের নিয়ামক হয়ে উঠেছে।
কুড়িগ্রামের নাজিম আলীর বয়ানে অবশ্য যৌতুকের বিষয়টিই মুখ্য। তাঁর ভাষ্য, ‘মেয়ে লোকের ফুট ভাসলে বিয়ে দিতে হয়। ২১,২২, ২৩ বছর হলে কে নিবে মেয়েকে? কেউ নেবেন নয়। মেয়ে যত বড় হবে—দু, আড়াই, তিন, পাঁচ লাখ ডিমান্ড হবে। মেয়ের একটু বয়স হলেই কয়—এক লাখে হবার নয়, হাত-পায়ের সোনা দেওয়া নাগবে।’ আর কুমিল্লার হারাধন এত এত প্রচার সত্ত্বেও এখনো বুঝতেই পারেননি পড়ালেখা করে কী হবে। তাঁর প্রশ্ন—‘পড়ালেখা করে কী করবে? পাত্র ভালো, সাউথ আফ্রিকা থাকে। তাই বিয়ে দিয়েছি।’
অর্থাৎ, উত্তর কিংবা দক্ষিণ যেদিকেই যাওয়া যাক না কেন, বাল্যবিয়ে নিরোধে নেওয়া এত এত প্রচার কোনো কাজেই আসেনি। একটি ঘোষণার মধ্যেই কেবল বিষয়টি আটকে থেকেছে। না হলে এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হতো। পড়ালেখার প্রয়োজনীয়তা থেকে শুরু করে যৌতুক নিরোধ বা স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নানা সংকটের আশঙ্কাগুলো নিয়ে যথেষ্ট প্রচারের ব্যবস্থা করা হতো। নেওয়া হতো এসব প্রচারকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পদক্ষেপ। কিন্তু এসব কিছু করা হয়নি। শুধু মুখে বলা হয়েছে—বাল্যবিবাহ আর নয়। টিভিতে হাসিখুশি বিজ্ঞাপন হয়েছে। উপজেলা বা স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে বাল্যবিয়ে নিরোধে প্রশাসনিক অভিযান হয়েছে ও হচ্ছে। কিন্তু এরপর আর কেউ খোঁজ রাখছে না যে, যে কারণে ওই মেয়ে শিশুর অভিভাবক সন্তানকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তার সমাধান হয়েছে কি-না।
এভাবে হওয়া বিয়ে মেনে নেওয়ার জন্য শিশুদের মানসিকতা প্রস্তুত হওয়ার কথা নয়। স্বামীর পরিবারের সবার সঙ্গে ‘মানিয়ে নেওয়ার’ কাজটাও তাঁদের জন্য সহজ নয়। এতে সংসারে দেখা দিতে পারে দ্বন্দ্ব। সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রেও দেখা দিতে পারে নানা জটিলতা। শিক্ষার অধিকারবঞ্চিত এ মেয়েরা মা হয়ে সন্তানদের কতটা সুষমভাবে গড়ে তুলতে পারবে, তা নিয়েও সংশয় আছে।
তবে বাল্যবিবাহ ঠেকাতে প্রশাসন টুকটাক কিছু পদক্ষেপ নিলেও তা যথেষ্ট নয়। আবার ইউএনওদের বাধায় বিয়ে ভেঙে গেলে বর-কনে দুই পরিবারই আর্থিক-সামাজিক ক্ষতির মুখে পড়ে। এদিকে গোপনেও বিয়ে হয়েছে অনেকের। সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে বাল্যবিবাহমুক্ত করতে চায় বলে লন্ডনে অনুষ্ঠিত গার্ল সামিটে বলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ লক্ষ্য এখন পর্যন্ত মুখে এবং প্রশাসনিক কিছু তাৎক্ষণিক ব্যবস্থার মধ্যে সীমায়িত হয়ে আছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যত দিন অভিভাবক শুধু নয় বাল্যবিয়ের আলোচনার মাঝখানেই সবাইকে থামিয়ে দিয়ে ‘না’ শব্দটি দৃঢ়তার সঙ্গে মেয়ে শিশুরা উচ্চারণ করতে না পারবে, তত দিন পর্যন্ত এ সংকটের সমাধান হবে না। আর এই দৃঢ়তাটি এমনি এমনি আসবে না, আসে না। এর জন্য অনেকগুলো বিষয় নিশ্চিত করতে হয়। এর সঙ্গে জড়িত পরিবারের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, সামাজিক নিরাপত্তা, নারী অধিকার শব্দবন্ধের যথাযথ অনুধাবন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সত্যিকারের শূন্য সহনশীলতার নীতিসহ বহু বিষয়। এর একটিও যদি বাদ যায়, তবে এই কোমলমতি শিশুদের মধ্যে ‘না’ বলার দৃঢ়তাটি আসবে না। আর তত দিন পর্যন্ত কন্যা শিশু দিবস পালন নিছক আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কিছু নয়।
ড. ইউনূস যখন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন পুরো জাতি তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিল। তবে তাঁকে পরিষ্কারভাবে এই পরিকল্পনা প্রকাশ করতে হবে যে, তিনি কীভাবে দেশ শাসন করবেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
৭ ঘণ্টা আগেসম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন ডলারনির্ভর বন্ড বিক্রি করেছে চীন। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেশটি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন।
১ দিন আগেএকটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলো
১ দিন আগেট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রূপ এবং যুদ্ধ ও বাণিজ্য সম্পর্কের পরিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ। চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের সাথে নতুন কৌশল এবং মার্কিন আধিপত্যের ভবিষ্যৎ।
৩ দিন আগে