হুসাইন আহমদ, ঢাকা
যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে প্রায় এক শতকের পুরোনো মিত্র সৌদি আরব। ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে তেলের উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্তের পর দুই দেশের মধ্যে বৈরিতা জটিল রূপ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে গৌণ করে এর মধ্যে মস্কোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশটি। রাশিয়ার সঙ্গে সৌদি রাজতন্ত্রের বাড়তে থাকা সম্পর্ক ভাবিয়ে তুলছে যুক্তরাষ্ট্রকে। দেশটির ‘স্পর্শকাতর প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি’ সৌদি আরবের মাধ্যমে রাশিয়া হস্তগত করতে পারে বলে সতর্ক করেছেন ক্ষমতাসীন দল ডেমোক্র্যাট পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতা রিচার্ড ব্লুমেন্থাল।
ওপেক প্লাসের দেশগুলোর তেলের উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্তের জের ধরে সিনেট আর্মড সার্ভিসেস কমিটির এই সদস্যই সৌদি আরবের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি একবছরের জন্য বন্ধ রাখার প্রস্তাব দেন। পেন্টাগনের সঙ্গে আলোচনার সময় এক্ষেত্রে যেসব ‘ঝুঁকি আছে তা নিয়ে গভীরে খোঁজখবর’ করবেন বলে তিনি জানান। গত সোমবার গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সবকিছু যে তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে সে বিষয়ে ‘আমি নিশ্চিত হতে চাই। ঝুঁকি যদি থাকেই, তা যেন শিগগির নিরসন করা হয় তাও নিশ্চিত করতে চাই।’
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে তেলের উৎপাদন নভেম্বর থেকে প্রতিদিন ২০ লাখ ব্যারেল বা ২ শতাংশ হারে কমানোর ওপেকের সিদ্ধান্ত চরম ক্ষুব্ধ যুক্তরাষ্ট্র। এর জের ধরে দুই পুরোনো মিত্রের মধ্যে সম্পর্কের ফাটল কতটা বিস্তৃত হয়েছে, তা ব্লুমেন্থালের উক্তিতে স্পষ্ট। ওপেকের সিদ্ধান্তটিকে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে রিয়াদের অবস্থান নেওয়ার ইঙ্গিত হিসেবে এবং পেট্রোলের দাম বাড়ানোর মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করে মধ্যবর্তী নির্বাচনে জো বাইডেন ও ডেমোক্র্যাটদের আঘাত করার সম্ভাব্য প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র।
এবিষয়ে হোয়াইট হাউজ থেকে যে সব ‘টকিং পয়েন্টস’ বা আলোচ্য বিষয় ইউএস ট্রেজারির কাছে পাঠানো হয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রচার মাধ্যম সিএনএনের হাতে এসেছে। তাতে ওপেক প্লাসের সিদ্ধান্তকে ‘সম্পূর্ণ বিপর্যয়কর’ এবং ‘বৈরী কাজ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। হোয়াইট হাউজের প্রেস সচিব কারিন জ্যঁ-পিয়েরে সাংবাদিকদের বলেছেন, ওপেক প্লাস যে রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে তা স্পষ্ট। আবার সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠদের নেতা ডেমোক্র্যাট চার্লস শুমার এক বিবৃতিতে বলেন, ওপেক প্লাস যা করেছে, তা ‘অত্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ’।
এমন পদক্ষেপের জন্য সৌদি আরবকে ‘পরিণতি’ ভোগ করতে হবে বলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হুঁশিয়ার করেছেন। এর মধ্যেই সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে বাইডেন ও কংগ্রেসে তার মিত্ররা। হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছেন, সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়নে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ‘পদ্ধতিগতভাবে’ কাজ করবেন। শীর্ষ তেল উৎপাদক দেশটির নিরাপত্তা সহায়তায় পরিবর্তন আসতে পারে।
ওপেক প্লাসের সিদ্ধান্ত নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের মতো ততটা সোচ্চার নয় রিপাবলিকানরা। তবে ব্লুমেন্থাল বলছেন, অস্ত্র বিক্রি বন্ধের পদক্ষেপের জন্য ক্যাপিটল হিলে উভয় দলীয় সমর্থন মিলবে বলে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা থেকে তিনি ইঙ্গিত পেয়েছেন। প্রস্তাবটি আগামী সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবে তোলা হতে পারে।
২০১৭ সালের ২০ মে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কেনার জন্য সৌদি বাদশাহ ও রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বেশ কয়েকটি সম্মতিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। তার আওতায় তখন ১ লাখ ১০ হাজার কোটি ডলারের এবং ১০ বছরে মোট ৩ লাখ ৫০ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র কেনার কথা সৌদি আরবের। ক্ষমতার পালাবদল হলেও এবং সম্পর্ক তীক্ত হলেও অস্ত্র বিক্রির চুক্তি থেকে সরেনি বাইডেন প্রশাসন। তার আমলে প্রথম সৌদি আরবের কাছে ৬৫ কোটি ডলারের ২৮০টি এয়ার-টু-এয়ার ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রির বড় চুক্তি সম্পন্ন হয় গত বছর নভেম্বরে। এরপর চলতি বছরের অগাস্টে আরও ৩০৫ কোটি ডলারের ‘প্যাট্রিয়ট’ ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রির সম্ভাব্য প্রস্তাব অনুমোদন দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সর্বশেষ অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে ‘উপসাগরীয় অঞ্চলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য প্রভাবশালী’ অংশীদার দেশের ‘নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার লক্ষ্য’ অর্জনে সহায়তা মিলবে বলে প্রস্তাবের যৌক্তিকতা তুলে ধরে তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছিল। কিন্তু দুই মাসও পেরোয়নি, তাতেই যুক্তরাষ্ট্রের সেই ‘জাতীয় নিরাপত্তা লক্ষ্য’ উল্টো দিকে মোড় নিচ্ছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই ওপেকের ‘তেল নিয়ে তেলেসমাতি’ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিকে ‘ইউ টার্ন’ নিতে বাধ্য করছে বলেই মনে হচ্ছে।
গার্ডিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ব্লুমেন্থাল যা বলছেন, তাতে সেরকমই ইঙ্গিত মিলছে। তার প্রধান উদ্বেগের বিষয় হলো- রিয়াদের সঙ্গে বিনিময় করা যুক্তরাষ্ট্রের স্পর্শকাতর প্রযুক্তি থেকে রাশিয়া যাতে কোনোভাবেই উপকৃত হতে না পারে তা নিশ্চিত করা। তিনি বলছেন, ‘আমি এ বিষয়ে হুট করে কোনো সিদ্ধান্তে আসছি না। কিন্তু, ঝুঁকি যে বাড়ছে তা বিবেচনা করা দরকার।’
সৌদি আরবে থাকা এবং সে দেশে পাঠানো অস্ত্রের চালানের গতিমুখ বদলে ইউক্রেনে মিত্রদের কাছে সরবরাহের প্রস্তাবে তিনি সমর্থন দিয়েছিলেন বলে জানান এই সিনেটর। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেনে অস্ত্র স্থানান্তরের বিষয়টি জটিল। কারণ সেগুলো চালাতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের উপস্থিতি লাগবে, যা থেকে অপ্রতিরোধ্য উত্তেজনা তৈরি হতে পারে। তবে ব্লুমেন্থাল বলছেন, ইউক্রেনের বাইরে তাদের বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা।
ইয়েল স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক জেফরি সোনেনফেল্ড সৌদি আরবে অস্ত্র বিক্রি নিয়ে গবেষণা করছেন। তার এই গবেষণা তিনি সিনেটের ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গেও বিনিময় করেন। তার হিসেবে, গত পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সর্বোচ্চ স্পর্শকাতর অস্ত্র যে পরিমাণে কিনেছে সৌদি আরব, তার আশে পাশে অন্য কোনো দেশ নেই। তিনি বলেন, নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবে সৌদি আরবকে যুক্তরাষ্ট্রের মতো করে সর্বোচ্চ স্পর্শকাতর কৌশলগত অস্ত্রের মালিকানা ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের সক্ষমতা আর কোনো মিত্র দেশ দেয়নি। এটা শুরু হয়েছিল ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে।
আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের জ্যেষ্ঠ ফেলো জেফ আব্রাহসন বলেন, কয়েক দশক ধরে সবচেয়ে সুক্ষ্ম অস্ত্রসহ যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সরঞ্জামের বড় ক্রেতা সৌদি আরব। স্বাভাবিকভাবেই, সৌদি আরবের কাছে থাকা সেসব অস্ত্রের তথ্য রাশিয়ার কাছে যাক তা যুক্তরাষ্ট্র চাইবে না। ডেমোক্র্যাটদের এই রাজনৈতিক ভাষ্য বাস্তবে রূপ নেবে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়। কারণ, বাইডেন ক্ষমতা নেওয়ার পর সৌদি যুবরাজকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে তিনি সৌদিদের চমকে দিয়ে হঠাৎ জেদ্দা সফর করেন।
ডেমোক্র্যাটদের উদ্দেশ্য নিয়ে জানতে চাইলে ব্লুমেন্থাল বলেন, অনুভূতি এখন ভিন্ন এক অবস্থানে চলে গেছে। পুরো কূটনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক এতটাই একপেশে হয়ে পড়েছে যে এখানে নতুন করে ভারসাম্য আনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ‘সৌদি আরবের এভাবে রাশিয়ার পক্ষে যাওয়া এতোটাই নাটকীয়, আমি মনে করি এর একটা জবাব দেওয়া প্রয়োজন।’
ব্লুমেন্থাল আরও বলেন, ‘সৌদি আরবে মানবাধিকার লঙ্ঘন, ইয়েমেনে গুহযুদ্ধে লিপ্ত হওয়া, বিচারপ্রার্থী ৯/১১ এর শিকার পরিবারগুলোর প্রতি অশ্রদ্ধা- সব মিলিয়ে অপমান ও আঘাতের পাহাড় জমেছে। এবং এখন অন্য দিক থেকেও সৌদি আরব সীমা লঙ্ঘন করেছে।’
তবে ওপেক প্লাসের তেলের উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্তের বহু আগে রাশিয়ার সঙ্গে সৌদি আরবের উষ্ণতার শুরু হয়েছে বলে করেন যুক্তরাষ্ট্রের কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের রাশিয়া ও ইউরেশিয়া বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রু এস উইজ।
তার মতে, তেলের উৎপাদন নিয়ে ২০১৬ সালে ওপেক প্লাসের নতুন ব্যবস্থাপনা এবং পরের বছর অক্টোবরে সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজ আল সৌদের প্রথম মস্কো সফরের পর শুধু সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিলের (জিসিসি) অপর সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্ক ব্যাপক বিস্তৃত হয়েছে।
সম্প্রতি এক নিবন্ধে তিনি বলেন, এর মধ্যে তেলের দাম নিয়ন্ত্রণের নতুন প্রচেষ্টা এবং সেপ্টেম্বরে ইউক্রেনের রণক্ষেত্র থেকে আটক যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কয়েকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তাসহ বিদেশি বন্দীদের মুক্তির জন্য যুবরাজ মোহাম্মদের চমকপ্রদ মধ্যস্ততা আবারও সৌদি-রাশিয়ার উষ্ণ সম্পর্ককে দৃশ্যপটে ফিরিয়েছে।
অন্যদিকে ২০১৮ সালে ভিন্নমতাবলম্বী সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশুগজি হত্যার ঘটনা যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটিয়েছে। সৌদি আরবের ‘ডি ফ্যাক্টো’ বা ‘কার্যত’ শাসক যুবরাজ মোহাম্মদের ইশারায় ওই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে।
এই নিয়ে কয়েক বছর ধরে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক শীতলতা চলছিল। সেই সম্পর্ক তেলের রাজনীতির কারণে বোধ হয় কঠিন বরফে রূপ নিচ্ছে। যদিও সৌদি আরবের পক্ষ থেকে এটাকে নিতান্ত অর্থনৈতিক কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। একইসঙ্গে এই পদক্ষেপ সৌদি পররাষ্ট্র নীতিতে ‘ইউ-টার্ন’ হিসেবে যে দেখা হচ্ছে তাও খারিজ করা হয়েছে।
কিন্তু, ভাষ্য যাই হোক, বাস্তবতা বলে দিচ্ছে, বৈশ্বিক রাজনীতিতে নানা সমীকরণের মধ্যে সৌদি আরব-রাশিয়ার সম্পর্ক ক্রমশ গভীর হচ্ছে। আর তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি’ মনে করা অমূলক নয়। তবে বাস্তবে কী ঘটবে তা দেখার জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।
(দ্য গার্ডিয়ান, সিএনএন, রয়টার্স ও ডয়চে ভেলের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি নিবন্ধ।)
যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে প্রায় এক শতকের পুরোনো মিত্র সৌদি আরব। ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে তেলের উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্তের পর দুই দেশের মধ্যে বৈরিতা জটিল রূপ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে গৌণ করে এর মধ্যে মস্কোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশটি। রাশিয়ার সঙ্গে সৌদি রাজতন্ত্রের বাড়তে থাকা সম্পর্ক ভাবিয়ে তুলছে যুক্তরাষ্ট্রকে। দেশটির ‘স্পর্শকাতর প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি’ সৌদি আরবের মাধ্যমে রাশিয়া হস্তগত করতে পারে বলে সতর্ক করেছেন ক্ষমতাসীন দল ডেমোক্র্যাট পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতা রিচার্ড ব্লুমেন্থাল।
ওপেক প্লাসের দেশগুলোর তেলের উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্তের জের ধরে সিনেট আর্মড সার্ভিসেস কমিটির এই সদস্যই সৌদি আরবের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি একবছরের জন্য বন্ধ রাখার প্রস্তাব দেন। পেন্টাগনের সঙ্গে আলোচনার সময় এক্ষেত্রে যেসব ‘ঝুঁকি আছে তা নিয়ে গভীরে খোঁজখবর’ করবেন বলে তিনি জানান। গত সোমবার গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সবকিছু যে তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে সে বিষয়ে ‘আমি নিশ্চিত হতে চাই। ঝুঁকি যদি থাকেই, তা যেন শিগগির নিরসন করা হয় তাও নিশ্চিত করতে চাই।’
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে তেলের উৎপাদন নভেম্বর থেকে প্রতিদিন ২০ লাখ ব্যারেল বা ২ শতাংশ হারে কমানোর ওপেকের সিদ্ধান্ত চরম ক্ষুব্ধ যুক্তরাষ্ট্র। এর জের ধরে দুই পুরোনো মিত্রের মধ্যে সম্পর্কের ফাটল কতটা বিস্তৃত হয়েছে, তা ব্লুমেন্থালের উক্তিতে স্পষ্ট। ওপেকের সিদ্ধান্তটিকে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে রিয়াদের অবস্থান নেওয়ার ইঙ্গিত হিসেবে এবং পেট্রোলের দাম বাড়ানোর মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করে মধ্যবর্তী নির্বাচনে জো বাইডেন ও ডেমোক্র্যাটদের আঘাত করার সম্ভাব্য প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র।
এবিষয়ে হোয়াইট হাউজ থেকে যে সব ‘টকিং পয়েন্টস’ বা আলোচ্য বিষয় ইউএস ট্রেজারির কাছে পাঠানো হয়েছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রচার মাধ্যম সিএনএনের হাতে এসেছে। তাতে ওপেক প্লাসের সিদ্ধান্তকে ‘সম্পূর্ণ বিপর্যয়কর’ এবং ‘বৈরী কাজ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। হোয়াইট হাউজের প্রেস সচিব কারিন জ্যঁ-পিয়েরে সাংবাদিকদের বলেছেন, ওপেক প্লাস যে রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে তা স্পষ্ট। আবার সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠদের নেতা ডেমোক্র্যাট চার্লস শুমার এক বিবৃতিতে বলেন, ওপেক প্লাস যা করেছে, তা ‘অত্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ’।
এমন পদক্ষেপের জন্য সৌদি আরবকে ‘পরিণতি’ ভোগ করতে হবে বলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হুঁশিয়ার করেছেন। এর মধ্যেই সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছে বাইডেন ও কংগ্রেসে তার মিত্ররা। হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছেন, সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়নে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ‘পদ্ধতিগতভাবে’ কাজ করবেন। শীর্ষ তেল উৎপাদক দেশটির নিরাপত্তা সহায়তায় পরিবর্তন আসতে পারে।
ওপেক প্লাসের সিদ্ধান্ত নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের মতো ততটা সোচ্চার নয় রিপাবলিকানরা। তবে ব্লুমেন্থাল বলছেন, অস্ত্র বিক্রি বন্ধের পদক্ষেপের জন্য ক্যাপিটল হিলে উভয় দলীয় সমর্থন মিলবে বলে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা থেকে তিনি ইঙ্গিত পেয়েছেন। প্রস্তাবটি আগামী সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবে তোলা হতে পারে।
২০১৭ সালের ২০ মে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কেনার জন্য সৌদি বাদশাহ ও রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বেশ কয়েকটি সম্মতিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। তার আওতায় তখন ১ লাখ ১০ হাজার কোটি ডলারের এবং ১০ বছরে মোট ৩ লাখ ৫০ হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র কেনার কথা সৌদি আরবের। ক্ষমতার পালাবদল হলেও এবং সম্পর্ক তীক্ত হলেও অস্ত্র বিক্রির চুক্তি থেকে সরেনি বাইডেন প্রশাসন। তার আমলে প্রথম সৌদি আরবের কাছে ৬৫ কোটি ডলারের ২৮০টি এয়ার-টু-এয়ার ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রির বড় চুক্তি সম্পন্ন হয় গত বছর নভেম্বরে। এরপর চলতি বছরের অগাস্টে আরও ৩০৫ কোটি ডলারের ‘প্যাট্রিয়ট’ ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রির সম্ভাব্য প্রস্তাব অনুমোদন দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সর্বশেষ অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে ‘উপসাগরীয় অঞ্চলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য প্রভাবশালী’ অংশীদার দেশের ‘নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি ও জাতীয় নিরাপত্তার লক্ষ্য’ অর্জনে সহায়তা মিলবে বলে প্রস্তাবের যৌক্তিকতা তুলে ধরে তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছিল। কিন্তু দুই মাসও পেরোয়নি, তাতেই যুক্তরাষ্ট্রের সেই ‘জাতীয় নিরাপত্তা লক্ষ্য’ উল্টো দিকে মোড় নিচ্ছে। স্বল্প সময়ের মধ্যেই ওপেকের ‘তেল নিয়ে তেলেসমাতি’ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিকে ‘ইউ টার্ন’ নিতে বাধ্য করছে বলেই মনে হচ্ছে।
গার্ডিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ব্লুমেন্থাল যা বলছেন, তাতে সেরকমই ইঙ্গিত মিলছে। তার প্রধান উদ্বেগের বিষয় হলো- রিয়াদের সঙ্গে বিনিময় করা যুক্তরাষ্ট্রের স্পর্শকাতর প্রযুক্তি থেকে রাশিয়া যাতে কোনোভাবেই উপকৃত হতে না পারে তা নিশ্চিত করা। তিনি বলছেন, ‘আমি এ বিষয়ে হুট করে কোনো সিদ্ধান্তে আসছি না। কিন্তু, ঝুঁকি যে বাড়ছে তা বিবেচনা করা দরকার।’
সৌদি আরবে থাকা এবং সে দেশে পাঠানো অস্ত্রের চালানের গতিমুখ বদলে ইউক্রেনে মিত্রদের কাছে সরবরাহের প্রস্তাবে তিনি সমর্থন দিয়েছিলেন বলে জানান এই সিনেটর। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেনে অস্ত্র স্থানান্তরের বিষয়টি জটিল। কারণ সেগুলো চালাতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের উপস্থিতি লাগবে, যা থেকে অপ্রতিরোধ্য উত্তেজনা তৈরি হতে পারে। তবে ব্লুমেন্থাল বলছেন, ইউক্রেনের বাইরে তাদের বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা।
ইয়েল স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক জেফরি সোনেনফেল্ড সৌদি আরবে অস্ত্র বিক্রি নিয়ে গবেষণা করছেন। তার এই গবেষণা তিনি সিনেটের ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গেও বিনিময় করেন। তার হিসেবে, গত পাঁচ বছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সর্বোচ্চ স্পর্শকাতর অস্ত্র যে পরিমাণে কিনেছে সৌদি আরব, তার আশে পাশে অন্য কোনো দেশ নেই। তিনি বলেন, নিরাপত্তা অংশীদার হিসেবে সৌদি আরবকে যুক্তরাষ্ট্রের মতো করে সর্বোচ্চ স্পর্শকাতর কৌশলগত অস্ত্রের মালিকানা ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের সক্ষমতা আর কোনো মিত্র দেশ দেয়নি। এটা শুরু হয়েছিল ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে।
আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের জ্যেষ্ঠ ফেলো জেফ আব্রাহসন বলেন, কয়েক দশক ধরে সবচেয়ে সুক্ষ্ম অস্ত্রসহ যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সরঞ্জামের বড় ক্রেতা সৌদি আরব। স্বাভাবিকভাবেই, সৌদি আরবের কাছে থাকা সেসব অস্ত্রের তথ্য রাশিয়ার কাছে যাক তা যুক্তরাষ্ট্র চাইবে না। ডেমোক্র্যাটদের এই রাজনৈতিক ভাষ্য বাস্তবে রূপ নেবে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়। কারণ, বাইডেন ক্ষমতা নেওয়ার পর সৌদি যুবরাজকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে তিনি সৌদিদের চমকে দিয়ে হঠাৎ জেদ্দা সফর করেন।
ডেমোক্র্যাটদের উদ্দেশ্য নিয়ে জানতে চাইলে ব্লুমেন্থাল বলেন, অনুভূতি এখন ভিন্ন এক অবস্থানে চলে গেছে। পুরো কূটনৈতিক ও সামরিক সম্পর্ক এতটাই একপেশে হয়ে পড়েছে যে এখানে নতুন করে ভারসাম্য আনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ‘সৌদি আরবের এভাবে রাশিয়ার পক্ষে যাওয়া এতোটাই নাটকীয়, আমি মনে করি এর একটা জবাব দেওয়া প্রয়োজন।’
ব্লুমেন্থাল আরও বলেন, ‘সৌদি আরবে মানবাধিকার লঙ্ঘন, ইয়েমেনে গুহযুদ্ধে লিপ্ত হওয়া, বিচারপ্রার্থী ৯/১১ এর শিকার পরিবারগুলোর প্রতি অশ্রদ্ধা- সব মিলিয়ে অপমান ও আঘাতের পাহাড় জমেছে। এবং এখন অন্য দিক থেকেও সৌদি আরব সীমা লঙ্ঘন করেছে।’
তবে ওপেক প্লাসের তেলের উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্তের বহু আগে রাশিয়ার সঙ্গে সৌদি আরবের উষ্ণতার শুরু হয়েছে বলে করেন যুক্তরাষ্ট্রের কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের রাশিয়া ও ইউরেশিয়া বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রু এস উইজ।
তার মতে, তেলের উৎপাদন নিয়ে ২০১৬ সালে ওপেক প্লাসের নতুন ব্যবস্থাপনা এবং পরের বছর অক্টোবরে সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজ আল সৌদের প্রথম মস্কো সফরের পর শুধু সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিলের (জিসিসি) অপর সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্ক ব্যাপক বিস্তৃত হয়েছে।
সম্প্রতি এক নিবন্ধে তিনি বলেন, এর মধ্যে তেলের দাম নিয়ন্ত্রণের নতুন প্রচেষ্টা এবং সেপ্টেম্বরে ইউক্রেনের রণক্ষেত্র থেকে আটক যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কয়েকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তাসহ বিদেশি বন্দীদের মুক্তির জন্য যুবরাজ মোহাম্মদের চমকপ্রদ মধ্যস্ততা আবারও সৌদি-রাশিয়ার উষ্ণ সম্পর্ককে দৃশ্যপটে ফিরিয়েছে।
অন্যদিকে ২০১৮ সালে ভিন্নমতাবলম্বী সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশুগজি হত্যার ঘটনা যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটিয়েছে। সৌদি আরবের ‘ডি ফ্যাক্টো’ বা ‘কার্যত’ শাসক যুবরাজ মোহাম্মদের ইশারায় ওই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে।
এই নিয়ে কয়েক বছর ধরে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক শীতলতা চলছিল। সেই সম্পর্ক তেলের রাজনীতির কারণে বোধ হয় কঠিন বরফে রূপ নিচ্ছে। যদিও সৌদি আরবের পক্ষ থেকে এটাকে নিতান্ত অর্থনৈতিক কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। একইসঙ্গে এই পদক্ষেপ সৌদি পররাষ্ট্র নীতিতে ‘ইউ-টার্ন’ হিসেবে যে দেখা হচ্ছে তাও খারিজ করা হয়েছে।
কিন্তু, ভাষ্য যাই হোক, বাস্তবতা বলে দিচ্ছে, বৈশ্বিক রাজনীতিতে নানা সমীকরণের মধ্যে সৌদি আরব-রাশিয়ার সম্পর্ক ক্রমশ গভীর হচ্ছে। আর তাতে যুক্তরাষ্ট্রের ‘জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি’ মনে করা অমূলক নয়। তবে বাস্তবে কী ঘটবে তা দেখার জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।
(দ্য গার্ডিয়ান, সিএনএন, রয়টার্স ও ডয়চে ভেলের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি নিবন্ধ।)
সম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন ডলারনির্ভর বন্ড বিক্রি করেছে চীন। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেশটি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন।
১৭ ঘণ্টা আগেএকটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলো
১ দিন আগেট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রূপ এবং যুদ্ধ ও বাণিজ্য সম্পর্কের পরিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ। চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের সাথে নতুন কৌশল এবং মার্কিন আধিপত্যের ভবিষ্যৎ।
৩ দিন আগেকোভিড-১৯ মহামারির পর সোশ্যাল মিডিয়া ফাস্ট ফ্যাশন শিল্পকে ভঙ্গুর করে তুলেছে। জায়গা করে নিচ্ছে ভয়াবহ মানবাধিকার সংকট সৃস্টিকারী ‘আলট্রা-ফাস্ট ফ্যাশন’। সেই শিল্পে তৈরি মানুষেরই ‘রক্তে’ রঞ্জিত পোশাক সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করে কিনছে অনবরত। আর রক্তের বেসাতি থেকে মালিক শ্রেণি মুনাফা কামিয়েই যাচ্ছে।
৫ দিন আগে