ইয়াসিন আরাফাত
ধর্মীয় গোঁড়ামি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সামরিক বাহিনীর প্রভাব ইত্যাদি পাকিস্তানের পরিচয় হয়ে আছে অনেক দিন ধরেই। ইমরান খান সরকারের সময় এ দুই পরিচয় আরও প্রকট হয়েছে। সঙ্গে মার্কিন মিত্র থেকে চীনের মিত্র হিসেবে নতুন পরিচয়ও যুক্ত হয়েছে দেশটির নামের সঙ্গে। আর ভারতের সঙ্গে সীমান্ত লড়াইয়ের বিষয়টি তো আছেই। এই সবগুলো পরিচয়ের দিকেই এখন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা কড়া নজর রাখছেন। কারণ প্রতিবেশী আফগানিস্তান এবং এর ক্ষমতায় সদ্য বসা তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের ক্ষমতা কেন্দ্রের সম্পর্ক। একদিকে চীনের সঙ্গে মৈত্রী, অন্যদিকে তালেবানের উৎস ও বিস্তারভূমি হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজের পরিচয়; একদিকে ধর্মীয় লেবাস, অন্যদিকে সেনাবাহিনীর ছদ্ম শাসন—সব মিলিয়ে ইমরান খান সরকারের অধীনে পাকিস্তান ঠিক কোন দিকে হাঁটছে, তা এক বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।
পাকিস্তানে এখনো ধর্ম অবমাননার দায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া কারও শাস্তি কার্যকর না হলেও এই শাস্তি কিন্তু প্রায়ই শোনানো হয়। আশির দশকে ধর্ম অবমাননার আইন সংশোধনের পর প্রায় ২ হাজার মানুষকে এই মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। ধর্ম অবমাননার দায়ে এ পর্যন্ত ১২৮ জন গণপিটুনিতে মারা গেছেন।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, পরমাণু শক্তিসমৃদ্ধ পাকিস্তান এমন একটি দেশ, যেখানে বিজ্ঞানচর্চা কাগজে-কলমে থাকলেও গোঁড়ামিটা ঠিকই রয়ে গেছে। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যা-ই আসুক না কেন, ধর্মের প্রসঙ্গ এলে আর কোনো কিছু টেকে না। তখন শুধু সংস্কারই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।
এই পাকিস্তানের প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তান। দেশটির সঙ্গে ২ হাজার ৬৪০ কিলোমিটার স্থলসীমান্ত রয়েছে পাকিস্তানের। সম্প্রতি আফগানিস্তানের ক্ষমতায় এসেছে তালেবান। সেখানে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত সরকারের পতন ঘটেছে। অভিযোগ রয়েছে, পাকিস্তানের সমর্থনে ক্ষমতায় এসেছে তালেবান। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে পাকিস্তান। যদিও সাম্প্রতিক এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, পাকিস্তানের ৫৫ শতাংশ মানুষই তালেবান ক্ষমতায় আসায় খুশি।
পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী চামান শহরের কোমল পানীয় বিক্রেতা জয়নুল্লাহ আচাকজাইও রয়েছেন এই দলে। দ্য ইকোনমিস্টকে তিনি বলেন, ‘এটি এক মহান অর্জন।’
আবার অনেক পাকিস্তানি কাবুলে তালেবানের ক্ষমতায় আসাকে অমঙ্গল হিসেবেই দেখছে। তাদের শঙ্কা, আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর তা সন্ত্রাসীদের উর্বর ভূমিতে পরিণত হবে। এর প্রভাব পড়বে পাকিস্তানের ওপরও। এরই মধ্যে তালেবানের পতাকা ইসলামাবাদের মসজিদে টানানো হয়েছে। এমন আরও অনেক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, যা এই শঙ্কাকে ক্রমশ দৃঢ় করছে।
পর্যবেক্ষক সংস্থা সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টালের পক্ষ থেকে সম্প্রতি বলা হয়, পাকিস্তানে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ৩২৯ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে গত দুই মাসে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে আফগান সীমান্তে।
পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে বড় শঙ্কা হলো, তালেবান ক্ষমতায় আসার পর অনেক বন্দীকে তারা ছেড়ে দিয়েছে। এঁদের মধ্যে পাকিস্তানের তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) নেতা ফকির মোহাম্মাদও রয়েছেন। তিনি পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি গণহত্যার সঙ্গে জড়িত। ধারণা করা হয়, টিটিপির প্রায় ৫ হাজার সদস্য আফগানিস্তানে লুকিয়ে রয়েছে। ফকির মোহাম্মদের মুক্তির মধ্য দিয়ে এই ধারা ক্রমেই শক্তিশালী হবে। আর তাদের লক্ষ্য যে পাকিস্তানকেও আফগানিস্তানের ধারায় নেওয়া, তা তো বলা অবান্তর। মুক্তি পাওয়ার পরই ফকির মোহাম্মাদ বলেছেন, তালেবানের নিয়মই পাকিস্তানে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন তিনি।
বর্তমানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। একসময়কার বিখ্যাত এই ক্রিকেট অলরাউন্ডারের বেশির ভাগ সময় কেটেছে বিলেতে। তাঁর গায়ে প্লেবয়ের তকমাও রয়েছে। তবে এখন নৈতিকতাবাদী ধর্মীয় রক্ষণশীল, অর্থনৈতিক অবস্থানে একজন লোকরঞ্জনবাদী এবং পাকিস্তানে গুলি চালানো জেনারেলদের একজন আজ্ঞাবহ সেবক হিসেবেই পরিচিত তিনি। সম্প্রতি তাঁর সরকার একটি আইন প্রস্তাব করেছে। সেখানে বলা হয়, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবমাননাজনক কোনো কিছু বললে দুই বছরের জেল হতে পারে।
ধর্মের ক্ষেত্রেও একই ধরনের অবস্থান নিয়েছেন ইমরান। গত সপ্তাহে ইসলামিক নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে ইমরান খান বলেন, ধর্মের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো আইন তাঁর সরকার করবে না।
ইমরান খানের সঙ্গে তালেবানের সখ্য দেখে কেউ কেউ তাঁকে ‘তালেবান খান’ বলে আখ্যায়িত করেছেন আগেই। তালেবান ক্ষমতায় আসার পর তিনি এখনো পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে কোনো ফোনালাপ করেননি। তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্য তাঁর এই নতুন নামকে আরও শক্ত ভিত দিচ্ছে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ইমরান খান তাঁর দেশে আফগান পরিস্থিতির প্রভাব নিয়ে লিখেছেন। তাঁর মতে, পশ্চিমা বাহিনী আফগান জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। সোভিয়েত বাহিনী, যারা আফগানিস্তানে লড়াই করেছিল, তাদের সঙ্গে পশ্চিমা বাহিনীর কোনো পার্থক্য দেখেন না ইমরান খান। তিনি ওই মতামতধর্মী নিবন্ধে লিখেছেন, ৩ লাখ সুসজ্জিত আফগান সেনাবাহিনীর তালেবানের সঙ্গে না পারার কারণ অবশ্যই পাকিস্তান নয়।
তবে নিজের সেই লেখায় মুদ্রার আরেক পিঠ দেখাননি ইমরান খান। তিনি উল্লেখ করেননি যে পাকিস্তানি ইসলামপন্থী দল ও গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে তালেবান নেতাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রয়েছে। ইমরান খান বলেছেন, ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তাঁর দেশে ১৬ হাজার সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। আর এগুলোর জন্য ভারতকে দুষেছেন তিনি। তবে আফগানিস্তানের সীমান্ত অঞ্চলে জঙ্গি তৎপরতার বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন ইমরান খান। এ ছাড়া ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তানের গুপ্তচরেরা তালেবানকে সমর্থন দিয়ে আসছে। পাকিস্তানের জাতিগত গোষ্ঠী পশতুনদের ঐক্য নিয়ে তারা কখনোই কিছু বলে না এবং পাকিস্তানের কোনো অঞ্চল তালেবান নিজেদের বলে দাবি করে না। এ ছাড়া পাকিস্তান যে আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকেও আশ্রয় দিয়েছিল, সে বিষয়টিও ইমরান খানের লেখায় ঊহ্য ছিল।
২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন ইমরান খান। অনেক পাকিস্তানি মনে করেন, পাকিস্তানে প্রকৃত ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতে। পাকিস্তানের কথিত দুর্নীতিবাজ সাবেক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ইমরান খানের নিরলস যুদ্ধের নামে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে নির্বাসনে পাঠানোসহ নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইমরান খান বিরোধী দলগুলোকে দুর্বল করতে সফল হয়েছেন। তিনি জনপ্রিয়তার চেয়ে বেশি বিভাজনের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। এ ছাড়া সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের মালিকদের হুমকি দিয়ে এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়ে পাকিস্তান সরকার সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের আনাড়ি প্রচেষ্টা করছে। এমনকি সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সরকার সম্পর্কে জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস ছড়ানো হচ্ছে দাবি করে এমন চর্চা প্রতিহতের কথা বলে রাষ্ট্র-নিযুক্ত পর্যবেক্ষণ বোর্ড তৈরির একটি আইনের প্রস্তাবও করা হয়েছে।
ইমরান খান এখন তালেবানের বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার এবং পাকিস্তানের দরিদ্র ‘ভাইদের’ জন্য সাহায্য পাঠানোর জন্য বিশ্বের কাছে যুক্তি উত্থাপন করছেন। পাকিস্তানে করোনার প্রকোপ তার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় কম ছিল। ইরানে করোনায় পাকিস্তানের চেয়ে দশগুণ বেশি মৃত্যু হয়েছে। গত বছর করোনা শুরুর পর ভারতের মতো পুরোপুরি লকডাউন জারি করেননি ইমরান খান। এ জন্য অবশ্য ভারতের মতো ভুগতে হয়নি পাকিস্তানকে। এ ক্ষেত্রে ইমরান খান সফলই বলা যায়। গত আগস্টে হওয়া জনমত জরিপে দেখা গেছে, ইমরান খানের জনপ্রিয়তা প্রায় ৪৮ শতাংশ, যা তাঁর শাসনামলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ২০২৩ সালে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই সময় পর্যন্ত ইমরান খান ক্ষমতায় থাকতে পারলে তিনি হবেন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় ছিলেন। এখন পর্যন্ত তাঁর জনপ্রিয়তার গ্রাফ যা, তাতে তিনি টানা দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হলেও বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।
ইমরানের এই জনপ্রিয়তায় পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্টই সবচেয়ে বেশি খুশি বলে মনে করেন মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্রুকিং ইনস্টিটিউশনের মাধিয়া আফযান। তাঁর মতে, নওয়াজ শরিফ সেনাদের আজ্ঞার বাইরে চলতেন। ফলে তারা ইমরান খানকেই সমর্থন দেয়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দেশটির ক্ষমতার অন্যতম বড় ভাগীদার; নিয়ন্ত্রক বললেও ভুল হবে না। বহুবার তারা অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখল করেছে। তবে ক্রমেই তারা বুঝেছে, সময় বদলেছে। সরাসরি শাসনের চেয়ে রাজনৈতিক পন্থায় শাসনই শ্রেয়। আফগানিস্তানে যে ফল এসেছে, তা নিয়েও সন্তুষ্ট তারা। কারণ, তারা এর জন্য দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেছে।
ধারণা করা হয়, পাকিস্তানি গোয়েন্দারা দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় গুপ্তচরদের অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছে আফগানিস্তানকে বিভিন্ন নাশকতার কাজে ব্যবহার করে। নরেন্দ্র মোদির হিন্দু-জাতীয়তাবাদী সরকারের অধীনে পাকিস্তান আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে ভারতের বিরুদ্ধে। গত আগস্টে কাবুলের দ্রুত পতন পাকিস্তানের খাতায় বোনাস পয়েন্ট হিসেবে যুক্ত হয়েছে। পাকিস্তানের জন্য আরেকটি বাড়তি সুবিধা হলো এটি চীনকে বুঝিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে টিকবে না। ফলে এই খেলায় বেইজিংয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়ার কারণে তারা চীনকেও পাশে পাচ্ছে।
তালেবানের সব পক্ষই হয়তো পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পক্ষে নয়। তবে গত সেপ্টেম্বরে তালেবান যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেছে, সেখানে হাক্কানি নেটওয়ার্কের জ্যেষ্ঠ সদস্যরা রয়েছেন। এটি পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই সমর্থিত অংশ। এ ছাড়া তালেবান প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম মোল্লা ওমরের ছেলে আফগানিস্তানের নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ ইয়াকুবের পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব রয়েছে। তালেবানের সরকার গঠনের আগমুহূর্তে কাবুলে ছুটে গিয়েছিলেন আইএসআইয়ের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফাইজ হামিদ। বিশ্লেষকদের ধারণা, আফগানিস্তানের তালেবান সরকারে আইএসআই তথা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও ইমরান খান সরকারের প্রভাব নিশ্চিত করতেই কাবুল সফরে গিয়েছিলেন তিনি।
পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক কর্তারা যদি কাবুলের সরকার পরিবর্তন থেকে লাভবান হন, তবে অন্য সবার কী হবে? দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বিভিন্ন সূচকে পিছিয়ে রয়েছে পাকিস্তান। পাকিস্তানে মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ১১ শতাংশ। ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তানে রুপির দাম ডলারের তুলনায় এক-চতুর্থাংশ কমেছে। দেশটির ইংরেজি সংবাদমাধ্যম দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশ আর্থিক সংকটে ভুগছে। বর্তমানে প্রায় ৫২ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি আর্থিক সাহায্য দরকার দেশটির। ওই টাকা দিয়ে ২০২১ থেকে ২০২৩ আর্থিক বছরে পাকিস্তান তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে।
আর্থিক এই সংকটের চিত্র উঠে এসেছে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও। সেখানে বলা হয়, বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার মামলায় পাকিস্তান শীর্ষ ১০ দেশের তালিকার একটি।
কল্যাণমূলক ইসলামি রাষ্ট্র গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন ইমরান খান। কিন্তু বাদ সাধে ভঙ্গুর অর্থনীতি। অর্থনীতির পতন ঠেকাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হন তিনি। সংস্থাটি ২০১৯ সালে পাকিস্তানকে ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে রাজি হয়। এই অর্থের পুরোটা এখনো ছাড় করেনি আইএমএফ। এর মধ্যেই গত জুলাইয়ে পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২২ বিলিয়ন ডলার।
ঘনিষ্ঠ মিত্র চীনের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে পাকিস্তান। এর বিনিময়ে বেইজিং পাকিস্তানের সঙ্গে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগ এগিয়ে নিচ্ছে। গড়ে তোলা হয়েছে চীন ও পাকিস্তানের মধ্যকার বিশেষ অর্থনৈতিক করিডর (ইপিইসি)। পাকিস্তানের ভূখণ্ডে এসব প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ৬৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে চীন। তবে সমালোচকেরা বলছেন, ইসলামাবাদ চীনা ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে গেছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান এইডডেটা জানিয়েছে, ২০০০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে পাকিস্তানকে ৩৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বেইজিং। এর মধ্যে ২৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার শর্তযুক্ত ঋণ।
সামরিক খাতেও ইসলামাবাদের চীনা নির্ভরশীলতা আগের তুলনায় বাড়ছে। ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে চীন যে পরিমাণ অস্ত্র রপ্তানি করেছে, তার ৩৮ শতাংশের গন্তব্য ছিল পাকিস্তান—এমনটা জানিয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট। তবে চীন-পাকিস্তান মৈত্রীতে চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাগুলো। পাকিস্তানের মাটিতে চীনা প্রকল্পগুলোয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর এসব হামলা ঠেকাতে সফল হয়নি পাকিস্তান। এ অবস্থায় চীনকে খুশি রাখতে জিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমদের ওপর চীনা সরকারের নির্যাতনের অভিযোগের বিষয়ে মুখ বন্ধ রেখেছে পাকিস্তান সরকার।
মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টার মনে করে, পাকিস্তান নিজেদের পুনর্বাসনের জন্য আফগানিস্তানকে ব্যবহারের চেষ্টা করছে। পাকিস্তান এখন আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষার একমাত্র উপায় হিসেবে তালেবান সরকারের পাশাপাশি অন্য দেশগুলোকে সাহায্য করতে চায়। ইমরান খানের সামনে এখন মোটাদাগে তিনটি চ্যালেঞ্জ—পতনশীল অর্থনীতিকে দ্রুত টেনে তোলা, চীনের সঙ্গে মৈত্রী ধরে রেখে জিনজিয়াং নিয়ে রাষ্ট্রীয় নীতি স্পষ্ট করা এবং আফগানিস্তানে সম্ভাব্য মানবিক সংকট কার্যকর উপায়ে সামাল দেওয়া। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাঁকে কৌশলী হতে হবে। একই সঙ্গে দেশে-বিদেশে তাঁর ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে হবে। তাহলে সফলভাবে টিকে যাবে ইমরান খানের রাজনৈতিক জীবন।
ধর্মীয় গোঁড়ামি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সামরিক বাহিনীর প্রভাব ইত্যাদি পাকিস্তানের পরিচয় হয়ে আছে অনেক দিন ধরেই। ইমরান খান সরকারের সময় এ দুই পরিচয় আরও প্রকট হয়েছে। সঙ্গে মার্কিন মিত্র থেকে চীনের মিত্র হিসেবে নতুন পরিচয়ও যুক্ত হয়েছে দেশটির নামের সঙ্গে। আর ভারতের সঙ্গে সীমান্ত লড়াইয়ের বিষয়টি তো আছেই। এই সবগুলো পরিচয়ের দিকেই এখন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা কড়া নজর রাখছেন। কারণ প্রতিবেশী আফগানিস্তান এবং এর ক্ষমতায় সদ্য বসা তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের ক্ষমতা কেন্দ্রের সম্পর্ক। একদিকে চীনের সঙ্গে মৈত্রী, অন্যদিকে তালেবানের উৎস ও বিস্তারভূমি হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজের পরিচয়; একদিকে ধর্মীয় লেবাস, অন্যদিকে সেনাবাহিনীর ছদ্ম শাসন—সব মিলিয়ে ইমরান খান সরকারের অধীনে পাকিস্তান ঠিক কোন দিকে হাঁটছে, তা এক বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।
পাকিস্তানে এখনো ধর্ম অবমাননার দায়ে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া কারও শাস্তি কার্যকর না হলেও এই শাস্তি কিন্তু প্রায়ই শোনানো হয়। আশির দশকে ধর্ম অবমাননার আইন সংশোধনের পর প্রায় ২ হাজার মানুষকে এই মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। ধর্ম অবমাননার দায়ে এ পর্যন্ত ১২৮ জন গণপিটুনিতে মারা গেছেন।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, পরমাণু শক্তিসমৃদ্ধ পাকিস্তান এমন একটি দেশ, যেখানে বিজ্ঞানচর্চা কাগজে-কলমে থাকলেও গোঁড়ামিটা ঠিকই রয়ে গেছে। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যা-ই আসুক না কেন, ধর্মের প্রসঙ্গ এলে আর কোনো কিছু টেকে না। তখন শুধু সংস্কারই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।
এই পাকিস্তানের প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তান। দেশটির সঙ্গে ২ হাজার ৬৪০ কিলোমিটার স্থলসীমান্ত রয়েছে পাকিস্তানের। সম্প্রতি আফগানিস্তানের ক্ষমতায় এসেছে তালেবান। সেখানে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত সরকারের পতন ঘটেছে। অভিযোগ রয়েছে, পাকিস্তানের সমর্থনে ক্ষমতায় এসেছে তালেবান। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে পাকিস্তান। যদিও সাম্প্রতিক এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, পাকিস্তানের ৫৫ শতাংশ মানুষই তালেবান ক্ষমতায় আসায় খুশি।
পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী চামান শহরের কোমল পানীয় বিক্রেতা জয়নুল্লাহ আচাকজাইও রয়েছেন এই দলে। দ্য ইকোনমিস্টকে তিনি বলেন, ‘এটি এক মহান অর্জন।’
আবার অনেক পাকিস্তানি কাবুলে তালেবানের ক্ষমতায় আসাকে অমঙ্গল হিসেবেই দেখছে। তাদের শঙ্কা, আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর তা সন্ত্রাসীদের উর্বর ভূমিতে পরিণত হবে। এর প্রভাব পড়বে পাকিস্তানের ওপরও। এরই মধ্যে তালেবানের পতাকা ইসলামাবাদের মসজিদে টানানো হয়েছে। এমন আরও অনেক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, যা এই শঙ্কাকে ক্রমশ দৃঢ় করছে।
পর্যবেক্ষক সংস্থা সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টালের পক্ষ থেকে সম্প্রতি বলা হয়, পাকিস্তানে চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ৩২৯ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে গত দুই মাসে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে আফগান সীমান্তে।
পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে বড় শঙ্কা হলো, তালেবান ক্ষমতায় আসার পর অনেক বন্দীকে তারা ছেড়ে দিয়েছে। এঁদের মধ্যে পাকিস্তানের তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) নেতা ফকির মোহাম্মাদও রয়েছেন। তিনি পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি গণহত্যার সঙ্গে জড়িত। ধারণা করা হয়, টিটিপির প্রায় ৫ হাজার সদস্য আফগানিস্তানে লুকিয়ে রয়েছে। ফকির মোহাম্মদের মুক্তির মধ্য দিয়ে এই ধারা ক্রমেই শক্তিশালী হবে। আর তাদের লক্ষ্য যে পাকিস্তানকেও আফগানিস্তানের ধারায় নেওয়া, তা তো বলা অবান্তর। মুক্তি পাওয়ার পরই ফকির মোহাম্মাদ বলেছেন, তালেবানের নিয়মই পাকিস্তানে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন তিনি।
বর্তমানে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। একসময়কার বিখ্যাত এই ক্রিকেট অলরাউন্ডারের বেশির ভাগ সময় কেটেছে বিলেতে। তাঁর গায়ে প্লেবয়ের তকমাও রয়েছে। তবে এখন নৈতিকতাবাদী ধর্মীয় রক্ষণশীল, অর্থনৈতিক অবস্থানে একজন লোকরঞ্জনবাদী এবং পাকিস্তানে গুলি চালানো জেনারেলদের একজন আজ্ঞাবহ সেবক হিসেবেই পরিচিত তিনি। সম্প্রতি তাঁর সরকার একটি আইন প্রস্তাব করেছে। সেখানে বলা হয়, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবমাননাজনক কোনো কিছু বললে দুই বছরের জেল হতে পারে।
ধর্মের ক্ষেত্রেও একই ধরনের অবস্থান নিয়েছেন ইমরান। গত সপ্তাহে ইসলামিক নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে ইমরান খান বলেন, ধর্মের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো আইন তাঁর সরকার করবে না।
ইমরান খানের সঙ্গে তালেবানের সখ্য দেখে কেউ কেউ তাঁকে ‘তালেবান খান’ বলে আখ্যায়িত করেছেন আগেই। তালেবান ক্ষমতায় আসার পর তিনি এখনো পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে কোনো ফোনালাপ করেননি। তাঁর সাম্প্রতিক বক্তব্য তাঁর এই নতুন নামকে আরও শক্ত ভিত দিচ্ছে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ইমরান খান তাঁর দেশে আফগান পরিস্থিতির প্রভাব নিয়ে লিখেছেন। তাঁর মতে, পশ্চিমা বাহিনী আফগান জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। সোভিয়েত বাহিনী, যারা আফগানিস্তানে লড়াই করেছিল, তাদের সঙ্গে পশ্চিমা বাহিনীর কোনো পার্থক্য দেখেন না ইমরান খান। তিনি ওই মতামতধর্মী নিবন্ধে লিখেছেন, ৩ লাখ সুসজ্জিত আফগান সেনাবাহিনীর তালেবানের সঙ্গে না পারার কারণ অবশ্যই পাকিস্তান নয়।
তবে নিজের সেই লেখায় মুদ্রার আরেক পিঠ দেখাননি ইমরান খান। তিনি উল্লেখ করেননি যে পাকিস্তানি ইসলামপন্থী দল ও গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সঙ্গে তালেবান নেতাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রয়েছে। ইমরান খান বলেছেন, ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তাঁর দেশে ১৬ হাজার সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। আর এগুলোর জন্য ভারতকে দুষেছেন তিনি। তবে আফগানিস্তানের সীমান্ত অঞ্চলে জঙ্গি তৎপরতার বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন ইমরান খান। এ ছাড়া ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তানের গুপ্তচরেরা তালেবানকে সমর্থন দিয়ে আসছে। পাকিস্তানের জাতিগত গোষ্ঠী পশতুনদের ঐক্য নিয়ে তারা কখনোই কিছু বলে না এবং পাকিস্তানের কোনো অঞ্চল তালেবান নিজেদের বলে দাবি করে না। এ ছাড়া পাকিস্তান যে আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকেও আশ্রয় দিয়েছিল, সে বিষয়টিও ইমরান খানের লেখায় ঊহ্য ছিল।
২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন ইমরান খান। অনেক পাকিস্তানি মনে করেন, পাকিস্তানে প্রকৃত ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতে। পাকিস্তানের কথিত দুর্নীতিবাজ সাবেক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ইমরান খানের নিরলস যুদ্ধের নামে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে নির্বাসনে পাঠানোসহ নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ইমরান খান বিরোধী দলগুলোকে দুর্বল করতে সফল হয়েছেন। তিনি জনপ্রিয়তার চেয়ে বেশি বিভাজনের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। এ ছাড়া সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের মালিকদের হুমকি দিয়ে এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট বন্ধ করে দিয়ে পাকিস্তান সরকার সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের আনাড়ি প্রচেষ্টা করছে। এমনকি সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সরকার সম্পর্কে জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস ছড়ানো হচ্ছে দাবি করে এমন চর্চা প্রতিহতের কথা বলে রাষ্ট্র-নিযুক্ত পর্যবেক্ষণ বোর্ড তৈরির একটি আইনের প্রস্তাবও করা হয়েছে।
ইমরান খান এখন তালেবানের বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার এবং পাকিস্তানের দরিদ্র ‘ভাইদের’ জন্য সাহায্য পাঠানোর জন্য বিশ্বের কাছে যুক্তি উত্থাপন করছেন। পাকিস্তানে করোনার প্রকোপ তার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় কম ছিল। ইরানে করোনায় পাকিস্তানের চেয়ে দশগুণ বেশি মৃত্যু হয়েছে। গত বছর করোনা শুরুর পর ভারতের মতো পুরোপুরি লকডাউন জারি করেননি ইমরান খান। এ জন্য অবশ্য ভারতের মতো ভুগতে হয়নি পাকিস্তানকে। এ ক্ষেত্রে ইমরান খান সফলই বলা যায়। গত আগস্টে হওয়া জনমত জরিপে দেখা গেছে, ইমরান খানের জনপ্রিয়তা প্রায় ৪৮ শতাংশ, যা তাঁর শাসনামলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ২০২৩ সালে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই সময় পর্যন্ত ইমরান খান ক্ষমতায় থাকতে পারলে তিনি হবেন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় ছিলেন। এখন পর্যন্ত তাঁর জনপ্রিয়তার গ্রাফ যা, তাতে তিনি টানা দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হলেও বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।
ইমরানের এই জনপ্রিয়তায় পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্টই সবচেয়ে বেশি খুশি বলে মনে করেন মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্রুকিং ইনস্টিটিউশনের মাধিয়া আফযান। তাঁর মতে, নওয়াজ শরিফ সেনাদের আজ্ঞার বাইরে চলতেন। ফলে তারা ইমরান খানকেই সমর্থন দেয়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দেশটির ক্ষমতার অন্যতম বড় ভাগীদার; নিয়ন্ত্রক বললেও ভুল হবে না। বহুবার তারা অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা দখল করেছে। তবে ক্রমেই তারা বুঝেছে, সময় বদলেছে। সরাসরি শাসনের চেয়ে রাজনৈতিক পন্থায় শাসনই শ্রেয়। আফগানিস্তানে যে ফল এসেছে, তা নিয়েও সন্তুষ্ট তারা। কারণ, তারা এর জন্য দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেছে।
ধারণা করা হয়, পাকিস্তানি গোয়েন্দারা দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় গুপ্তচরদের অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছে আফগানিস্তানকে বিভিন্ন নাশকতার কাজে ব্যবহার করে। নরেন্দ্র মোদির হিন্দু-জাতীয়তাবাদী সরকারের অধীনে পাকিস্তান আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে ভারতের বিরুদ্ধে। গত আগস্টে কাবুলের দ্রুত পতন পাকিস্তানের খাতায় বোনাস পয়েন্ট হিসেবে যুক্ত হয়েছে। পাকিস্তানের জন্য আরেকটি বাড়তি সুবিধা হলো এটি চীনকে বুঝিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে টিকবে না। ফলে এই খেলায় বেইজিংয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়ার কারণে তারা চীনকেও পাশে পাচ্ছে।
তালেবানের সব পক্ষই হয়তো পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পক্ষে নয়। তবে গত সেপ্টেম্বরে তালেবান যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেছে, সেখানে হাক্কানি নেটওয়ার্কের জ্যেষ্ঠ সদস্যরা রয়েছেন। এটি পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই সমর্থিত অংশ। এ ছাড়া তালেবান প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম মোল্লা ওমরের ছেলে আফগানিস্তানের নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ ইয়াকুবের পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্ব রয়েছে। তালেবানের সরকার গঠনের আগমুহূর্তে কাবুলে ছুটে গিয়েছিলেন আইএসআইয়ের প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফাইজ হামিদ। বিশ্লেষকদের ধারণা, আফগানিস্তানের তালেবান সরকারে আইএসআই তথা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও ইমরান খান সরকারের প্রভাব নিশ্চিত করতেই কাবুল সফরে গিয়েছিলেন তিনি।
পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক কর্তারা যদি কাবুলের সরকার পরিবর্তন থেকে লাভবান হন, তবে অন্য সবার কী হবে? দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বিভিন্ন সূচকে পিছিয়ে রয়েছে পাকিস্তান। পাকিস্তানে মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ১১ শতাংশ। ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তানে রুপির দাম ডলারের তুলনায় এক-চতুর্থাংশ কমেছে। দেশটির ইংরেজি সংবাদমাধ্যম দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশ আর্থিক সংকটে ভুগছে। বর্তমানে প্রায় ৫২ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি আর্থিক সাহায্য দরকার দেশটির। ওই টাকা দিয়ে ২০২১ থেকে ২০২৩ আর্থিক বছরে পাকিস্তান তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে।
আর্থিক এই সংকটের চিত্র উঠে এসেছে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও। সেখানে বলা হয়, বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার মামলায় পাকিস্তান শীর্ষ ১০ দেশের তালিকার একটি।
কল্যাণমূলক ইসলামি রাষ্ট্র গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন ইমরান খান। কিন্তু বাদ সাধে ভঙ্গুর অর্থনীতি। অর্থনীতির পতন ঠেকাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হন তিনি। সংস্থাটি ২০১৯ সালে পাকিস্তানকে ৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে রাজি হয়। এই অর্থের পুরোটা এখনো ছাড় করেনি আইএমএফ। এর মধ্যেই গত জুলাইয়ে পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২২ বিলিয়ন ডলার।
ঘনিষ্ঠ মিত্র চীনের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছে পাকিস্তান। এর বিনিময়ে বেইজিং পাকিস্তানের সঙ্গে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগ এগিয়ে নিচ্ছে। গড়ে তোলা হয়েছে চীন ও পাকিস্তানের মধ্যকার বিশেষ অর্থনৈতিক করিডর (ইপিইসি)। পাকিস্তানের ভূখণ্ডে এসব প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ৬৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে চীন। তবে সমালোচকেরা বলছেন, ইসলামাবাদ চীনা ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে গেছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান এইডডেটা জানিয়েছে, ২০০০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে পাকিস্তানকে ৩৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বেইজিং। এর মধ্যে ২৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার শর্তযুক্ত ঋণ।
সামরিক খাতেও ইসলামাবাদের চীনা নির্ভরশীলতা আগের তুলনায় বাড়ছে। ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে চীন যে পরিমাণ অস্ত্র রপ্তানি করেছে, তার ৩৮ শতাংশের গন্তব্য ছিল পাকিস্তান—এমনটা জানিয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট। তবে চীন-পাকিস্তান মৈত্রীতে চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাগুলো। পাকিস্তানের মাটিতে চীনা প্রকল্পগুলোয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর এসব হামলা ঠেকাতে সফল হয়নি পাকিস্তান। এ অবস্থায় চীনকে খুশি রাখতে জিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমদের ওপর চীনা সরকারের নির্যাতনের অভিযোগের বিষয়ে মুখ বন্ধ রেখেছে পাকিস্তান সরকার।
মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টার মনে করে, পাকিস্তান নিজেদের পুনর্বাসনের জন্য আফগানিস্তানকে ব্যবহারের চেষ্টা করছে। পাকিস্তান এখন আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষার একমাত্র উপায় হিসেবে তালেবান সরকারের পাশাপাশি অন্য দেশগুলোকে সাহায্য করতে চায়। ইমরান খানের সামনে এখন মোটাদাগে তিনটি চ্যালেঞ্জ—পতনশীল অর্থনীতিকে দ্রুত টেনে তোলা, চীনের সঙ্গে মৈত্রী ধরে রেখে জিনজিয়াং নিয়ে রাষ্ট্রীয় নীতি স্পষ্ট করা এবং আফগানিস্তানে সম্ভাব্য মানবিক সংকট কার্যকর উপায়ে সামাল দেওয়া। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তাঁকে কৌশলী হতে হবে। একই সঙ্গে দেশে-বিদেশে তাঁর ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে হবে। তাহলে সফলভাবে টিকে যাবে ইমরান খানের রাজনৈতিক জীবন।
ড. ইউনূস যখন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন পুরো জাতি তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিল। তবে তাঁকে পরিষ্কারভাবে এই পরিকল্পনা প্রকাশ করতে হবে যে, তিনি কীভাবে দেশ শাসন করবেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
৮ ঘণ্টা আগেসম্প্রতি দুই বিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্কিন ডলারনির্ভর বন্ড বিক্রি করেছে চীন। গত তিন বছরের মধ্যে এবারই প্রথম দেশটি এমন উদ্যোগ নিয়েছে। ঘটনাটি বিশ্লেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তাঁরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একটি বার্তা দিয়েছে চীন।
১ দিন আগেএকটা সময় ইসরায়েলের ছোট ও সুসংহত সমাজকে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে প্রায় অপ্রতিরোধ্য বলে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু এখন বিষয়টি কার্যত বদলে গেছে। বর্তমান সংঘাত, ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থার উত্থান এবং নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের বিচার বিভাগ সংস্কারের মতো বিষয়গুলো দেশটির সমাজে বিদ্যমান সূক্ষ্ম বিভাজনগুলো
১ দিন আগেট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রূপ এবং যুদ্ধ ও বাণিজ্য সম্পর্কের পরিবর্তন নিয়ে বিশ্লেষণ। চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের সাথে নতুন কৌশল এবং মার্কিন আধিপত্যের ভবিষ্যৎ।
৩ দিন আগে