প্রতারণার অর্থে বাড়ি-গাড়ি, করেন নির্বাচনও

শাহরিয়ার হাসান, ঢাকা
প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১০: ০০
আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১২: ৪২

কখনো ভূমি অফিসের কর্মকর্তা, কখনো জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা আবার কখনো সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ব্যক্তি। আসলে এসবের কোনোটাই নন, তিনি মূলত একজন প্রতারক। প্রতারণার কৌশল হিসেবে একেক সময় একেক পরিচয় দেন। কেউ সমস্যায় পড়েছে শুনলে ছুটে যান তাঁর কাছে। নিজেকে জাহির করেন মুশকিল আসান হিসেবে। আর সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়ে ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নেন বড় অঙ্কের অর্থ।

গত বুধবার পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া প্রতারক এই ব্যক্তির নাম আবুল কালাম আজাদ। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে। আট বছর ধরে নানা পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করে আসছেন তিনি। মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন ৩০-৪০ কোটি টাকা। কিনেছেন ঢাকায় বাড়ি, গাড়ি ও ফ্ল্যাট। শুধু তাই নয়, এলাকায় জনপ্রতিনিধি হতে নির্বাচনও করেছেন একাধিকবার।

গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জালিয়াতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সংস্থার কাগজ তৈরি করে অনেক মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে আসছিল একটি প্রতারক চক্র। আর চক্রটির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আবুল কালাম আজাদ।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)-এর অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) তৌহিদুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রতারক চক্রটিতে চার-পাঁচজন সদস্য রয়েছেন। যেখানে ঝামেলা হয়, মুশকিল আসানের মতো সামনে গিয়ে দাঁড়ান তাঁরা। তাঁদের নামে বিভিন্ন থানায় চার-পাঁচটি প্রতারণার মামলা রয়েছে। সবশেষ হ্যাপি হোমস লিমিটেডের (আবাসন কোম্পানি) কাছ থেকে কোটি টাকার বেশি আত্মসাতের ঘটনায় বুধবার রাজধানী থেকে দুই সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে আবুল কালাম আজাদকে।

কে এই আবুল কালাম আজাদ?

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নবীনগর উপজেলার লাউর ফতেহপুর ইউনিয়নের বাড়িখলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আজাদ। এইচএসসি পাস করা এই যুবক ২০০০ সালে ঢাকায় চলে আসেন। তখন থেকেই প্রতারণায় হাতেখড়ি তাঁর। নীলক্ষেত থেকে ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার নামে প্রতারণা করেন তিনি। একজনের জমির ভুয়া কাগজ করে অন্যজনের কাছে বিক্রি করেন। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে আটকে যাওয়া টাকা তুলে দেওয়ার নামে চুক্তি করে কৌশলে টাকা নেন।

পুলিশের খাতায় প্রতারক হলেও এলাকায় একজন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত আবুল কালাম আজাদ। স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এলাকায় সবাই জানেন, তিনি ক্ষমতাধর ব্যক্তি। সমাজের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত ওঠাবসা। সুযোগটা কাজে লাগিয়ে গত কয়েক বছরে নবীনগর ও মুরাদনগর উপজেলার অর্ধশতাধিক ছেলের কাছ থেকে সেনাবাহিনীতে চাকরি দেওয়ার নামে কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় আরেক ব্যক্তি বলেন, এলাকার মিজান সওদাগর, সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নাজমুল করিম, মোহাম্মদ জুয়েল, মো. শফিকুল ইসলাম, পরান মিয়াসহ বহু মানুষের কাছে একই জমি তিন-চারবার বিক্রি করেও টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রতারক আবুল কালাম আজাদ। জানতে চাইলে নবীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমিনুর রশীদ বলেন, আবুল কালামের বিরুদ্ধে নবীনগর থানায় তিনটি প্রতারণা মামলা ও একটি ওয়ারেন্ট রয়েছে।

নবীনগর উপজেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বাঙ্গরা গ্রামের শফিকুল ইসলাম জানান, তাঁর কাছ থেকে সাভারের আশুলিয়ায় জায়গা কিনে দেওয়ার কথা বলে ১৫ লাখ টাকা নিয়েছেন এই প্রতারক। লাউর ফতেপুর গ্রামের মিজান সওদাগরের কাছ থেকে নিয়েছেন ৬ লাখ টাকা। নবীনগর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ভদ্রগাছা গ্রামের নাজমুল করিমের কাছ থেকেও অনেক টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।

শুধু প্রতারণা নয়, রাজনীতিতেও হাত পাকাতে চান আবুল কালাম আজাদ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১১ ও ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার লাউর ফতেহপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির হয়ে নির্বাচন করেছিলেন তিনি। এ ছাড়া আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে নির্বাচন করবেন বলেও এলাকায় ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন।

যে ঘটনায় ধরা পড়লেন
রাজধানীর বাংলামোটরে ২৫-২৭ কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ ঠিকানায় ৫৪ কাঠা জমির ওপরে একটি বিল্ডিং করে হ্যাপি হোমস লিমিটেড। পরবর্তী সময়ে ২০০৫ সালে সড়কটি সম্প্রসারণের জন্য ভবনের কিছু অংশ ও জমির ক্ষতিপূরণের টাকা গ্রহণের নোটিশ দেয় জেলা প্রশাসন। কিন্তু সেই টাকা আদায়ে টালবাহানা করে প্রশাসন। পরে উচ্চ আদালত জমির ক্ষতিপূরণের ১৭ কোটি ৫২ লাখ ৫৩ হাজার ৩৯৭ টাকা দিতে নির্দেশ দেন। তবু দীর্ঘ ১৩ বছরেও টাকা পায়নি ডেভেলপার কোম্পানিটি। সমস্যা সমাধানে হাজির হন প্রতারক আবুল কালাম আজাদ। দামি গাড়িতে চড়ে বড় বড় রেস্টুরেন্টে মিটিং করেন সমস্যার সমাধানে। বিনিময়ে চান আট কোটি টাকা। অবশ্য তার আগে খরচ ও দৌড়াদৌড়ির জন্য কয়েক কোটি টাকা চান। বিশ্বাস করাতে নীলক্ষেত থেকে ক্ষতিপূরণের পে-অর্ডার, চেক, জেলা প্রশাসকের ছাড়পত্র বানিয়ে নিয়ে আসেন। তাঁকে বিশ্বাস করে ২০১৯ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত ১ কোটি ১২ লাখ টাকা দেন ভুক্তভোগী। তারপরই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেন এই প্রতারক। টাকা চাইলে ভয়ভীতি ও হুমকি দেন। এ ঘটনায় রাজধানীর শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেন হ্যাপি হোমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফ হোসেন চৌধুরী। অবশেষে সেই মামলায় গত বুধবার তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) তৌহিদুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ৯২ লাখ টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন এই প্রতারক। তবে তাঁর কাছ থেকে নগদ মাত্র ৫৭ হাজার টাকা উদ্ধার করা গেছে। গ্রেপ্তার তিনজনের ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে। আগামী সপ্তাহে শুনানির তারিখ দিয়েছেন আদালত।

প্রতিবেদনে সহযোগিতা করেছেন নবীনগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি মো. সাইদুল আলম।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি চাকরিজীবীরা সম্পদের হিসাব না দিলে যেসব শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন

শেখ হাসিনাকে নিয়ে যুক্তরাজ্যে এম সাখাওয়াতের বিস্ফোরক মন্তব্য, কী বলেছেন এই উপদেষ্টা

শিক্ষকের নতুন ২০ হাজার পদ, প্রাথমিকে আসছে বড় পরিবর্তন

লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতাকে অতিথি করায় মাহফিল বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ

শ্রীপুরে পিকনিকের বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ শিক্ষার্থীর মৃত্যু, আহত ৩

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত