প্রাধান্য পাক নারায়ণগঞ্জের উন্নয়ন

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
প্রকাশ : ০৭ জানুয়ারি ২০২২, ০৭: ১০
আপডেট : ০৭ জানুয়ারি ২০২২, ০৮: ৩০

১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ইউপি, পৌর নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা যখন তুঙ্গে, তখন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনের এই সময়ে দেশের রাজনৈতিক আলোচনার মূল ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। গণমাধ্যমগুলোয় অন্তত সে ধরনের খবরাখবর প্রতিদিন স্থান পাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ঢাকার অদূরে হওয়ায় গণমাধ্যমগুলোর দৃষ্টি বিশেষভাবে পাওয়ার সুযোগ নিয়েছে। তা ছাড়া, বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে নারায়ণগঞ্জ একটি আলাদা অবস্থানে রয়েছে। নানা ঘটনাই শুধু এর প্রধান কারণ নয়। অর্থনীতি, রাজনীতি, নদীবন্দর, ঢাকার সংলগ্নতা, শিল্পনগরীর ঐতিহ্য ইত্যাদি বিবেচনায় নারায়ণগঞ্জ সব সময়ই দেশের রাজনীতি ও গণমাধ্যমের দৃষ্টিতে বিশেষ অবস্থানে ছিল এবং আছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন অতীতেও ঢাকা সিটি করপোরেশনের মতোই গণমাধ্যমে যেমন বাড়তি গুরুত্ব পেয়েছে। এবারও করোনা সংক্রমণের একটি নাজুক পরিস্থিতিতে থাকা সত্ত্বেও বিশেষ নজর এরই মধ্যে কেড়ে নিতে পেরেছে। তা ছাড়া, নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরেও এমন কিছু ঘটনা অতীতে এবং এবারও ঘটার লক্ষণ বিরাজমান, যা নিয়ে সব মহলই নির্বাচনটিকে পর্যবেক্ষণে রাখছে। প্রতিদিনই নাসিক নিয়ে নানা রকম চমকপ্রদ ঘটনা ঘটার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। নির্বাচন পর্যন্ত পরিস্থিতির নানা উত্থান-পতন ঘটার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে বিএনপি কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। তারপরও ইউপি ও পৌর নির্বাচনে বিএনপির বেশ কিছু নেতা-কর্মী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। বিএনপি বিজয়ী প্রার্থীদের বিজয়কে স্বাগতই জানিয়েছে, দলীয় সিদ্ধান্ত ভঙ্গ করে যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, তাঁদের দল থেকে বহিষ্কার করেনি। ফলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির দ্বিচারিতা সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিএনপির মহাসচিব কখনো নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার পক্ষে কথা বলেছেন, আবার কখনো নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত না নেওয়ার কথাও জানিয়েছেন। বোঝা যাচ্ছে বিএনপি এই সব নির্বাচনে অংশ নেওয়া না-নেওয়া নিয়ে দোলাচলে দুলছে। এরই মধ্যে নাসিক নির্বাচন ঘনিয়ে এলে মহাসচিব দলীয়ভাবে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার পক্ষে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করার পরও কেউ যদি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে, সেটি তাঁর ব্যক্তিগত ইচ্ছা বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন।

দলের এমন অবস্থান জেনেই নারায়ণগঞ্জ বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার মেয়র পদে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন। এরই মধ্যে তিনি নির্বাচন কমিশন থেকে প্রতীক নিয়ে প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিতেও শুরু করেছেন। তৈমূর আলম নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে বিএনপির দীর্ঘদিনের নেতা। ২০১১ সালের নাসিক নির্বাচনের আগের রাতে দলীয় চেয়ারপারসনের নির্দেশে তাঁকে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত বিমর্ষ চেহারায় বাকরুদ্ধ কণ্ঠে জানাতে হয়েছে। চেয়ারপারসন ও দলের ওই সিদ্ধান্ত নেতা-কর্মীদের মধ্যেও হতাশা তৈরি করেছিল। তখনো হয়তো তিনি জয়লাভ করতে পারবেন না জেনেই দলের হাইকমান্ড এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বলে সব মহল তখন ধরে নিয়েছিল। তবে নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি শেষ পর্যন্ত অবস্থান করলে বিএনপির ভোটের চিত্রটি পাওয়া যেত। কিন্তু বিএনপির হাইকমান্ড সেই সময় অন্য সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও দ্বিমুখী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনেও তৈমূর আলম খন্দকারকে শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে তিনিও তখন গণমাধ্যমে তাঁর বেদনার কথা জানিয়েছিলেন। এখন নাসিকে মেয়র পদে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কাজে মন দেওয়ার পর আকস্মিকভাবে বিএনপির পক্ষ থেকে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদ এবং ২৫ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জ জেলা আহ্বায়কের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাঁকে অব্যাহতি দেওয়ার এই দুই সিদ্ধান্ত বেশ রহস্যাবৃত, কোথাও বলা নেই তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাঁর অব্যাহতির কারণও কোথাও উল্লেখ করা নেই। তিনি দলের সিদ্ধান্ত ভঙ্গ করার অপরাধে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে–সেটিরও উল্লেখ নেই। সুতরাং তাঁর দুই পদ থেকে অব্যাহতির উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন রাজনৈতিক মহলে সৃষ্টি হয়েছে।

এটি কি দলের নতুন কোনো কৌশল, তাঁকে সাধারণ ভোটারদের কাছে নির্দলীয় প্রার্থী হিসেবে পরিচিত করানো, সেই পরিচয়ে বিএনপির বাইরের ভোটারদেরও ভোট টানার হিসাব-নিকাশ এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে কি, তেমন বাড়তি ভোট তৈমূর আলমের হাতির পেটে ঢুকবে কি? পুরো বিষয়টি নিয়েই এখন রাজনৈতিক মহলে নানা ধরনের বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। অন্যদিকে তৈমূর আলম তাঁর অব্যাহতির খবরে প্রথমে আলহামদুলিল্লাহ পড়েছেন, পরে ‘খুশি হয়েছি’ বলেছেন। আবার ‘বিএনপির অবস্থান বিএনপি ভালো জানে। বিএনপি কি নৌকার পক্ষে ভোট চায়? স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা সবাই সরকারের হাতে নির্যাতিত। তাঁরা সবাই মাঠে আছেন। এর আগেও আমাকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে’ বলেছেন। সুতরাং মেয়র পদে তৈমূর আলমের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে ২০১১ সালের নাটকীয়তা, ২০১৮ সালের সংসদ সদস্যপদে প্রার্থী না পাওয়া, এবারের ঘটনাবলির নানা রূপের নানা চরিত্র নিয়ে বোঝা বড়ই জটিল হয়ে উঠেছে। রাজনীতির বিশ্লেষক মহল বিএনপি এবং তৈমূর আলমকে নিয়ে কখনো হতবাক হয়, কখনো বিস্মিত হয়, কখনোবা এর কোনো সারবত্তা খুঁজে পাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করে না। এবার মেয়র পদে তিনি শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবেন কি না? গেলেও তাঁর পেছনে বিএনপির স্থানীয় নেতাদের কজন থাকবেন, কর্মীদেরও কজনকে দেখা যাবে–সেটি আগামী দিনগুলোই কেবল বলে দিতে পারে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী ২০১১ সালেও বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে মেয়র হয়েছিলেন।

২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর তিনি বিএনপির প্রার্থী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেনকে পরাজিত করে দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র নির্বাচিত হন। বিএনপি তখন সাখাওয়াত হোসেনকে মনোনয়ন দেওয়ার পেছনে কারণ সাত খুনের হত্যা মামলায় সাখাওয়াত আসামিদের বিরুদ্ধে প্রধান আইনজীবী ছিলেন। বিএনপি ধারণা করেছিল, এই মামলায় নারায়ণগঞ্জবাসী সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপির পক্ষে সাখাওয়াতকে ভোটে বিজয়ী করবে। কিন্তু সেই মামলা নিয়ে সরকারের কোনো পক্ষপাতিত্বের আচরণ ভোটারদের কাছে দৃশ্যমান হয়নি। সুতরাং নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা আইভীকে উন্নয়নে পরীক্ষিত একজন মেয়র হিসেবে নির্বাচিত করেছেন। মেয়র পদে সেলিনা হায়াৎ আইভীর প্রার্থিতা দলের একজন সাংসদ আগাগোড়াই বিরোধিতা করেছিলেন। সেই সাংসদের বিশেষ কিছু সমর্থক থাকলেও নারায়ণগঞ্জবাসী সেলিনা হায়াৎকে শুধু আওয়ামী লীগের দলীয় নেতার গুণেই যোগ্য মনে করছে না। তাঁর ব্যক্তিগত আচরণ, সততা এবং জনগণের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বিশেষভাবে বিবেচিত হয়েছে। সে কারণেই তিনি পরপর দুবার সুষ্ঠু, অবাধ, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়লাভ করেছিলেন। এবারও তিনি দলের মনোনয়ন লাভ করেছেন। গণমাধ্যমে তাঁর প্রতীককে বিশেষ ওই সাংসদ এবং তাঁর কিছু অনুগত সমর্থক ব্যতীত আর কারও কোনো বিরোধিতার কথা আলোচিত হচ্ছে না। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে নারায়ণগঞ্জে কাজ করছেন বলে জানা যাচ্ছে। বিশেষ ওই সাংসদ ও তাঁর সমর্থকেরা প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন না বলেও প্রচার রয়েছে। এই অংশের সমর্থন নির্বাচন পর্যন্ত নৌকার দিকে গড়াবে কি না, সেটি নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ করছেন। ১৬ তারিখের পর ফলাফল ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেই নারায়ণগঞ্জের ভবিষ্যৎ দলীয় রাজনীতির সিদ্ধান্ত কেন্দ্র নেবে, সেটি সবাই অনুমান করছে। বিষয়টি স্থানীয় নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বোঝেন না, সেটি ভাবার কোনো কারণ নেই। তা ছাড়া, আওয়ামী লীগের একজন নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির যে ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে তা সেলিনা হায়াৎ বিরোধীদের বিপক্ষে এবং তাঁর পক্ষেই ভোটারদের সমর্থন বাড়ানোর মতো ঘটনা ঘটেছে। তারপরও সেলিনা হায়াতের ১০ বছরের মেয়র পদের কাজের মূল্যায়ন ভোটাররা করবেন–এতে কোনো সন্দেহ নেই।

নারায়ণগঞ্জের সচেতন মহল মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে কার প্রয়োজনীয়তা নারায়ণগঞ্জের জন্য বেশি, সেটি সম্পর্কেও যথেষ্ট ধারণা রাখেন। ৭ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে আলোচনায় আছেন কেবল আইভী ও তৈমূরই। আইভী মেয়র পদে পরীক্ষিত, তৈমূর আলম সেই পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগই দলের কারণে পাননি। দল তাঁকে কেন এত হেলাফেলা করে, সেটি বোধগম্য নয়। নারায়ণগঞ্জের মেয়রকে অনেক দৃঢ়ভাবে কাজ করতে হয়। এখানে কাজে নানা প্রতিবন্ধকতা, জটিলতা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হয়। সে কারণেই নারায়ণগঞ্জের সাধারণ ভোটাররা আবেগের বশবর্তী হয়ে নয়; বরং নারায়ণগঞ্জের জটিল বাস্তবতার অভিজ্ঞতা বিবেচনায় রেখে মেয়র পদে তাঁকেই বসাবেন, যিনি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন, নাগরিক সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা, নানা ধরনের সমস্যা দূরীকরণে যোগ্যতা প্রদর্শন করতে পারবেন।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি চাকরিজীবীরা সম্পদের হিসাব না দিলে যেসব শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন

শেখ হাসিনাকে নিয়ে যুক্তরাজ্যে এম সাখাওয়াতের বিস্ফোরক মন্তব্য, কী বলেছেন এই উপদেষ্টা

শিক্ষকের নতুন ২০ হাজার পদ, প্রাথমিকে আসছে বড় পরিবর্তন

লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতাকে অতিথি করায় মাহফিল বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ

শ্রীপুরে পিকনিকের বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ শিক্ষার্থীর মৃত্যু, আহত ৩

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত