অরুণ কর্মকার
দেশের চলমান জ্বালানি ঘাটতি শিগগিরই না মিটে, বরং তা দীর্ঘস্থায়ী হবে–এ বিষয়টি এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। একই সঙ্গে জ্বালানি ও বিদ্যুতের দামও যতটা বাড়ানো হয়েছে এবং হবে, কখনোই ততটা কমানো হবে না। তা সরকারের পক্ষ থেকে যতই বলা হোক না কেন যে বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশেও কমানো হবে।
শঙ্কার কারণ কী
আমাদের গ্যাসসংকট অনেক আগে থেকে চলে এসেছে। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশে গ্যাস সরবরাহ ছিল দৈনিক ১ হাজার ৭৫০ মিলিয়ন বা ১৭৫ কোটি ঘনফুট, যা ওই সময়ের চাহিদার তুলনায়ও কম ছিল। এরপর দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম বৃদ্ধির কারণে গ্যাসের চাহিদা বাড়তে থাকলে সরকার দেশে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়। ফলে ২০১৩-১৪ সাল নাগাদ গ্যাস উত্তোলন দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট বৃদ্ধি পায়। ফলে তখন দৈনিক গ্যাস সরবরাহ বেড়ে হয় ২৭৫ কোটি ঘনফুট। কিন্তু তত দিনে গ্যাসের চাহিদা হয় দৈনিক ৩০০ কোটি ঘনফুট। ঘাটতি তখন সহনীয় ছিল।
তবে এরপর আর দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি। তবে বাপেক্স ওয়ার্কওভার (বিদ্যমান কূপ সংস্কার) করে এবং কয়েকটি নতুন কূপ খনন করে মাঝেমধ্যে ৫০ লাখ থেকে দুই-আড়াই কোটি ঘনফুট পর্যন্ত উৎপাদন বাড়িয়েছে। কিন্তু তা ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে যথেষ্ট ছিল না। পাশাপাশি দেশের ক্ষেত্রগুলোতে গ্যাসের চাপ কমে আসা এবং আরও কিছু কারিগরি কারণে প্রতিবছর উৎপাদন কমতে কমতে এখন তা দৈনিক ২১৫ কোটি ঘনফুটে দাঁড়িয়েছে।
গ্যাসের ঘাটতি পূরণ এবং সংকট মোকাবিলায় সরকার ২০১০ সাল থেকেই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির উদ্যোগ নেয়। কারণ সরকারের নীতিনির্ধারক মহলে কী কারণে যেন এই ধারণা বদ্ধমূল ছিল (এখনো যে নেই তা নয়) যে দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের আর কোনো বড় মজুত নেই। অথচ দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও পেশাজীবীরা এখনো বলছেন, দেশে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে তার চেয়ে বেশি অনাবিষ্কৃত রয়েছে। কিন্তু সরকার সেসব কথা বিশেষ একটা আমলে নেয়নি।
শেষ পর্যন্ত ২০১৮ সালের শেষ দিকে শুরু হয় এলএনজি আমদানি। প্রথমে সরকারি মালিকানার একটি ভাসমান টার্মিনালের (‘ফ্লোটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রি-গ্যাসিফিকেশন ইউনিট’ সংক্ষেপে এফএসআরইউ) মাধ্যমে। পরে বেসরকারি মালিকানাধীন আরেকটি এফএসআরইউর মাধ্যমে। মহেশখালীতে বঙ্গোপসাগরে স্থাপিত এই এফএসআরইউ দুটির মাধ্যমে দৈনিক সর্বোচ্চ মোট এক হাজার মিলিয়ন (১০০ কোটি) ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে দেওয়া সম্ভব।
কাতার এবং ওমান থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে এই এলএনজি আমদানি করা হয়। তাতে বিশ্ববাজারে স্বাভাবিক মূল্য পরিস্থিতিতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম পড়ে সর্বনিম্ন ৬ মার্কিন ডলার। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে ট্যাগ করা থাকে। ফলে বিশ্ববাজারে যখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকল, তখন এই এলএনজির দামও বাড়তে থাকে।
দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির বাইরেও সরকার খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে কিছু এলএনজি আমদানির ব্যবস্থা রেখেছে। কারণ স্বাভাবিক বাজার পরিস্থিতিতে খোলাবাজারে আরও কম দামে পাওয়া যায় এবং গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত রাখা যায়। কিন্তু এবার খোলাবাজারে এলএনজির দাম ওঠে ৬০ ডলারের ওপরে। ফলে সরকার এলএনজি আমদানি কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়। উল্লেখ্য, দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে তোলা গ্যাসের দাম পড়ে যেকোনো পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ ৩ ডলার।
এখন আমাদের দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪০০ কোটি ঘনফুটের বেশি। সরবরাহ করা যাচ্ছে ৩০০ কোটির মতো। এর মধ্যে প্রায় ৯০ কোটি ঘনফুট পাওয়া যাচ্ছে এলএনজি থেকে। আর ২১০ কোটি ঘনফুটের মতো পাওয়া যাচ্ছে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে। বিশ্ববাজারে দাম এখন যথেষ্ট কমেছে। কিন্তু আমরা কোনোভাবেই দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুটের বেশি এলএনজি আমদানি করতে পারব না। কারণ আমাদের দুটি এফএসআরইউর সর্বোচ্চ ক্ষমতাই দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট।
অবশ্য এই ১০০ কোটি ঘনফুট নিয়মিত আমদানি অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রেও ডলারের প্রাপ্যতার প্রশ্ন রয়েছে। এ কারণে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ১২ কার্গো এলএনজি আমদানি করা হলেও পরবর্তী ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) তা ৮টিতে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আবার একই সঙ্গে সরকার এলএনজি আমদানি বাড়ানোর জন্য আরও এফএসআরইউ এবং স্থলভিত্তিক অবকাঠামো স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে তা বাস্তবায়নে তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লাগবে। সুতরাং চলমান ঘাটতি মোকাবিলায় সরকারের এই উদ্যোগ কোনো কাজে আসবে না।
পাশাপাশি সরকার রাষ্ট্রীয় মালিকানার এফএসআরইউটির ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এর অপারেটর কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জিকে বলেছে। তারা হয়তো এই ক্ষমতা দৈনিক ২০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত বাড়াতে পারবে। কিন্তু তাতেও বছর দুয়েক সময় লাগবে। এর বাইরে সরকার দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে দৈনিক ৬১-৬২ কোটি ঘনফুট (৬১৮ মিলিয়ন) গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর জন্য কাজ শুরু করেছে।
যদি ধরে নেওয়া যায় যে এই ৬২ কোটি ঘনফুট উত্তোলন বাড়বে। বিশ্ববাজার স্বাভাবিক হবে। আমাদের ডলারসংকট কেটে যাবে।এক্সিলারেট এনার্জিও এফএসআরইউর ক্ষমতা ২০ কোটি ঘনফুট বাড়াবে। এই সব মিলে ২০২৫ সালে আমাদের মোট সর্বোচ্চ গ্যাস সরবরাহ হতে পারে ৩৮০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু ২০২৫ সালে আমাদের দৈনিক প্রকৃত চাহিদা ৫০০ কোটি ঘনফুট ছাড়িয়ে যাবে।
এই ঘাটতি পূরণে আরও সময় লাগবে এবং তা পূরণ হতে হতে আরও চাহিদা বাড়বে। আমাদের গ্যাস সরবরাহ এই চক্রের মধ্যে আটকে পড়েছে। আগেভাগে দেশের গ্যাস উত্তোলন সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হলে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না। এমনকি, বর্তমান সংকটের সময়ও দেশের গ্যাস বেশি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ ও শিল্প উৎপাদন এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কার্যক্রম অপেক্ষাকৃত কম খরচে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো।
জ্বালানি তেলের বিষয়টি অবশ্য আলাদা। জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে ঘাটতি কিংবা সরবরাহ-সংকট—এর কোনোটাই বলা ঠিক নয়। এটি আসলে কোভিড-১৯-পরবর্তী পৃথিবীতে একযোগে চাহিদা বৃদ্ধি এবং প্রায় একই সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে উচ্চমূল্য এবং ডলারসংকটের কারণে আমাদের ক্রয়ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা। এই সীমাবদ্ধতা না কাটলে জ্বালানি তেল আমদানিও স্বাভাবিক রাখা কঠিন হবে। একই কথা প্রযোজ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিপুল পরিমাণ কয়লা আমদানির ক্ষেত্রেও। মনে রাখা দরকার, জ্বালানির ঘাটতি অব্যাহত থাকলে বিদ্যুৎ ও শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হবে। রপ্তানি বিঘ্নিত হবে।
দামের প্রসঙ্গ
বিশ্ববাজারে কয়েক মাস ধরে সব ধরনের জ্বালানির দাম কমছে। সে কারণে দেশেও দাম কমানোর দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দাম কমানোর বিষয়ে সরকারি বক্তব্যে কিছুটা সংশোধন বা পরিবর্তন লক্ষ করার মতো। প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী বীর বিক্রম সম্প্রতি বলেছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কমা স্থিতিশীল হলে দেশে কমানো হবে। এই স্থিতিশীলতার মাপকাঠি কী, তা অবশ্য আমাদের কারও জানা নেই। তবে আমরা এটা জানি যে জ্বালানির দাম শিগিগরই কমানো হবে না।
আমাদের মনে আছে, গত বছর আগস্ট মাসে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম যখন নিম্নমুখী, তখন সরকার তড়িঘড়ি করে দেশে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আর সেই বৃদ্ধি ছিল আক্ষরিক অর্থেই বিশ্ব রেকর্ড করা। ৪৫ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত। জ্বালানি তেলের মতো একটি অত্যাবশ্যকীয় ও কৌশলগত পণ্যের (স্ট্র্যাটেজিক কমোডিটি) দাম একবারে এতটা বৃদ্ধির নজির কোথাও নেই। সরকারের পক্ষ থেকে যদিও তখন বলা হয়েছিল, জনগণের কথা মাথায় রেখে সহনীয় পর্যায়ে দাম বাড়ানোর কথা সরকারের ভাবনায় আছে।
বিশ্ববাজারে নিম্নমুখী প্রবণতা সত্ত্বেও সরকার তখন দাম বাড়িয়েছিল, কারণ সরকার অর্থসংকটে ছিল। সরকারের আর্থিক হিসাব (যা ডলারসংকটের কারণে সৃষ্ট) এবং চলতি ব্যয় নির্বাহ (যার কারণ আয়ের তুলনায় বেশি সরকারি ব্যয়) দুই ক্ষেত্রেই ঘাটতি ছিল; অর্থাৎ সরকারের হাতে বাজেট বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা ছিল না। এই দুই হিসাবেই ঘাটতি এখনো অব্যাহত আছে। এর মধ্যে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি বরং বেড়েছে। কাজেই মুখে যা-ই বলা হোক জ্বালানির দাম শিগগিরই কমানো হচ্ছে না।
ওই পরিস্থিতিতে সরকার ‘বাজেটারি সাপোর্ট’ হিসেবে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল। ওই ঋণের বহু শর্তের মধ্যে প্রথম শর্ত হচ্ছে—ভর্তুকি বন্ধ করা ও সরকারের ব্যয় কমানো। জ্বালানি তেলের রেকর্ড পরিমাণ দাম বাড়িয়ে সরকার এই খাতের ভর্তুকি কার্যত তুলে দিয়েছে। উপরন্তু তেল বিপণনকে লাভজনক করে জ্বালানি তেল থেকে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব আয়ের পথ পরিষ্কার করে নিয়েছে। উল্লেখ্য, জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণন থেকে সরকার প্রায় ৩৫ শতাংশ শুল্ক ও কর নেয়। কাজেই এই পণ্যের দাম যত বেশি রাখা যায়, বিপিসির তত বেশি লাভ হয়। সরকারের শুল্ক ও করের অঙ্কও ততই বড় হয়। এ রকম একটি স্বস্তিকর অবস্থান সরকার কেন বদলাবে? বিশেষ করে যখন সরকারের আর্থিক সংকট প্রকটতর হচ্ছে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
দেশের চলমান জ্বালানি ঘাটতি শিগগিরই না মিটে, বরং তা দীর্ঘস্থায়ী হবে–এ বিষয়টি এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। একই সঙ্গে জ্বালানি ও বিদ্যুতের দামও যতটা বাড়ানো হয়েছে এবং হবে, কখনোই ততটা কমানো হবে না। তা সরকারের পক্ষ থেকে যতই বলা হোক না কেন যে বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশেও কমানো হবে।
শঙ্কার কারণ কী
আমাদের গ্যাসসংকট অনেক আগে থেকে চলে এসেছে। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন দেশে গ্যাস সরবরাহ ছিল দৈনিক ১ হাজার ৭৫০ মিলিয়ন বা ১৭৫ কোটি ঘনফুট, যা ওই সময়ের চাহিদার তুলনায়ও কম ছিল। এরপর দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম বৃদ্ধির কারণে গ্যাসের চাহিদা বাড়তে থাকলে সরকার দেশে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়। ফলে ২০১৩-১৪ সাল নাগাদ গ্যাস উত্তোলন দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট বৃদ্ধি পায়। ফলে তখন দৈনিক গ্যাস সরবরাহ বেড়ে হয় ২৭৫ কোটি ঘনফুট। কিন্তু তত দিনে গ্যাসের চাহিদা হয় দৈনিক ৩০০ কোটি ঘনফুট। ঘাটতি তখন সহনীয় ছিল।
তবে এরপর আর দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি। তবে বাপেক্স ওয়ার্কওভার (বিদ্যমান কূপ সংস্কার) করে এবং কয়েকটি নতুন কূপ খনন করে মাঝেমধ্যে ৫০ লাখ থেকে দুই-আড়াই কোটি ঘনফুট পর্যন্ত উৎপাদন বাড়িয়েছে। কিন্তু তা ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে যথেষ্ট ছিল না। পাশাপাশি দেশের ক্ষেত্রগুলোতে গ্যাসের চাপ কমে আসা এবং আরও কিছু কারিগরি কারণে প্রতিবছর উৎপাদন কমতে কমতে এখন তা দৈনিক ২১৫ কোটি ঘনফুটে দাঁড়িয়েছে।
গ্যাসের ঘাটতি পূরণ এবং সংকট মোকাবিলায় সরকার ২০১০ সাল থেকেই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির উদ্যোগ নেয়। কারণ সরকারের নীতিনির্ধারক মহলে কী কারণে যেন এই ধারণা বদ্ধমূল ছিল (এখনো যে নেই তা নয়) যে দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের আর কোনো বড় মজুত নেই। অথচ দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও পেশাজীবীরা এখনো বলছেন, দেশে এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে তার চেয়ে বেশি অনাবিষ্কৃত রয়েছে। কিন্তু সরকার সেসব কথা বিশেষ একটা আমলে নেয়নি।
শেষ পর্যন্ত ২০১৮ সালের শেষ দিকে শুরু হয় এলএনজি আমদানি। প্রথমে সরকারি মালিকানার একটি ভাসমান টার্মিনালের (‘ফ্লোটিং স্টোরেজ অ্যান্ড রি-গ্যাসিফিকেশন ইউনিট’ সংক্ষেপে এফএসআরইউ) মাধ্যমে। পরে বেসরকারি মালিকানাধীন আরেকটি এফএসআরইউর মাধ্যমে। মহেশখালীতে বঙ্গোপসাগরে স্থাপিত এই এফএসআরইউ দুটির মাধ্যমে দৈনিক সর্বোচ্চ মোট এক হাজার মিলিয়ন (১০০ কোটি) ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে দেওয়া সম্ভব।
কাতার এবং ওমান থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে এই এলএনজি আমদানি করা হয়। তাতে বিশ্ববাজারে স্বাভাবিক মূল্য পরিস্থিতিতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম পড়ে সর্বনিম্ন ৬ মার্কিন ডলার। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে ট্যাগ করা থাকে। ফলে বিশ্ববাজারে যখন জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে থাকল, তখন এই এলএনজির দামও বাড়তে থাকে।
দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির বাইরেও সরকার খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে কিছু এলএনজি আমদানির ব্যবস্থা রেখেছে। কারণ স্বাভাবিক বাজার পরিস্থিতিতে খোলাবাজারে আরও কম দামে পাওয়া যায় এবং গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত রাখা যায়। কিন্তু এবার খোলাবাজারে এলএনজির দাম ওঠে ৬০ ডলারের ওপরে। ফলে সরকার এলএনজি আমদানি কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়। উল্লেখ্য, দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে তোলা গ্যাসের দাম পড়ে যেকোনো পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ ৩ ডলার।
এখন আমাদের দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪০০ কোটি ঘনফুটের বেশি। সরবরাহ করা যাচ্ছে ৩০০ কোটির মতো। এর মধ্যে প্রায় ৯০ কোটি ঘনফুট পাওয়া যাচ্ছে এলএনজি থেকে। আর ২১০ কোটি ঘনফুটের মতো পাওয়া যাচ্ছে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে। বিশ্ববাজারে দাম এখন যথেষ্ট কমেছে। কিন্তু আমরা কোনোভাবেই দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুটের বেশি এলএনজি আমদানি করতে পারব না। কারণ আমাদের দুটি এফএসআরইউর সর্বোচ্চ ক্ষমতাই দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট।
অবশ্য এই ১০০ কোটি ঘনফুট নিয়মিত আমদানি অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রেও ডলারের প্রাপ্যতার প্রশ্ন রয়েছে। এ কারণে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ১২ কার্গো এলএনজি আমদানি করা হলেও পরবর্তী ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) তা ৮টিতে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আবার একই সঙ্গে সরকার এলএনজি আমদানি বাড়ানোর জন্য আরও এফএসআরইউ এবং স্থলভিত্তিক অবকাঠামো স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে তা বাস্তবায়নে তিন থেকে পাঁচ বছর সময় লাগবে। সুতরাং চলমান ঘাটতি মোকাবিলায় সরকারের এই উদ্যোগ কোনো কাজে আসবে না।
পাশাপাশি সরকার রাষ্ট্রীয় মালিকানার এফএসআরইউটির ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এর অপারেটর কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জিকে বলেছে। তারা হয়তো এই ক্ষমতা দৈনিক ২০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত বাড়াতে পারবে। কিন্তু তাতেও বছর দুয়েক সময় লাগবে। এর বাইরে সরকার দেশের ক্ষেত্রগুলো থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে দৈনিক ৬১-৬২ কোটি ঘনফুট (৬১৮ মিলিয়ন) গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর জন্য কাজ শুরু করেছে।
যদি ধরে নেওয়া যায় যে এই ৬২ কোটি ঘনফুট উত্তোলন বাড়বে। বিশ্ববাজার স্বাভাবিক হবে। আমাদের ডলারসংকট কেটে যাবে।এক্সিলারেট এনার্জিও এফএসআরইউর ক্ষমতা ২০ কোটি ঘনফুট বাড়াবে। এই সব মিলে ২০২৫ সালে আমাদের মোট সর্বোচ্চ গ্যাস সরবরাহ হতে পারে ৩৮০ কোটি ঘনফুট। কিন্তু ২০২৫ সালে আমাদের দৈনিক প্রকৃত চাহিদা ৫০০ কোটি ঘনফুট ছাড়িয়ে যাবে।
এই ঘাটতি পূরণে আরও সময় লাগবে এবং তা পূরণ হতে হতে আরও চাহিদা বাড়বে। আমাদের গ্যাস সরবরাহ এই চক্রের মধ্যে আটকে পড়েছে। আগেভাগে দেশের গ্যাস উত্তোলন সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হলে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না। এমনকি, বর্তমান সংকটের সময়ও দেশের গ্যাস বেশি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ ও শিল্প উৎপাদন এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কার্যক্রম অপেক্ষাকৃত কম খরচে চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো।
জ্বালানি তেলের বিষয়টি অবশ্য আলাদা। জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে ঘাটতি কিংবা সরবরাহ-সংকট—এর কোনোটাই বলা ঠিক নয়। এটি আসলে কোভিড-১৯-পরবর্তী পৃথিবীতে একযোগে চাহিদা বৃদ্ধি এবং প্রায় একই সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে উচ্চমূল্য এবং ডলারসংকটের কারণে আমাদের ক্রয়ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা। এই সীমাবদ্ধতা না কাটলে জ্বালানি তেল আমদানিও স্বাভাবিক রাখা কঠিন হবে। একই কথা প্রযোজ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিপুল পরিমাণ কয়লা আমদানির ক্ষেত্রেও। মনে রাখা দরকার, জ্বালানির ঘাটতি অব্যাহত থাকলে বিদ্যুৎ ও শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হবে। রপ্তানি বিঘ্নিত হবে।
দামের প্রসঙ্গ
বিশ্ববাজারে কয়েক মাস ধরে সব ধরনের জ্বালানির দাম কমছে। সে কারণে দেশেও দাম কমানোর দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দাম কমানোর বিষয়ে সরকারি বক্তব্যে কিছুটা সংশোধন বা পরিবর্তন লক্ষ করার মতো। প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী বীর বিক্রম সম্প্রতি বলেছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কমা স্থিতিশীল হলে দেশে কমানো হবে। এই স্থিতিশীলতার মাপকাঠি কী, তা অবশ্য আমাদের কারও জানা নেই। তবে আমরা এটা জানি যে জ্বালানির দাম শিগিগরই কমানো হবে না।
আমাদের মনে আছে, গত বছর আগস্ট মাসে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম যখন নিম্নমুখী, তখন সরকার তড়িঘড়ি করে দেশে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। আর সেই বৃদ্ধি ছিল আক্ষরিক অর্থেই বিশ্ব রেকর্ড করা। ৪৫ থেকে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত। জ্বালানি তেলের মতো একটি অত্যাবশ্যকীয় ও কৌশলগত পণ্যের (স্ট্র্যাটেজিক কমোডিটি) দাম একবারে এতটা বৃদ্ধির নজির কোথাও নেই। সরকারের পক্ষ থেকে যদিও তখন বলা হয়েছিল, জনগণের কথা মাথায় রেখে সহনীয় পর্যায়ে দাম বাড়ানোর কথা সরকারের ভাবনায় আছে।
বিশ্ববাজারে নিম্নমুখী প্রবণতা সত্ত্বেও সরকার তখন দাম বাড়িয়েছিল, কারণ সরকার অর্থসংকটে ছিল। সরকারের আর্থিক হিসাব (যা ডলারসংকটের কারণে সৃষ্ট) এবং চলতি ব্যয় নির্বাহ (যার কারণ আয়ের তুলনায় বেশি সরকারি ব্যয়) দুই ক্ষেত্রেই ঘাটতি ছিল; অর্থাৎ সরকারের হাতে বাজেট বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা ছিল না। এই দুই হিসাবেই ঘাটতি এখনো অব্যাহত আছে। এর মধ্যে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি বরং বেড়েছে। কাজেই মুখে যা-ই বলা হোক জ্বালানির দাম শিগগিরই কমানো হচ্ছে না।
ওই পরিস্থিতিতে সরকার ‘বাজেটারি সাপোর্ট’ হিসেবে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল। ওই ঋণের বহু শর্তের মধ্যে প্রথম শর্ত হচ্ছে—ভর্তুকি বন্ধ করা ও সরকারের ব্যয় কমানো। জ্বালানি তেলের রেকর্ড পরিমাণ দাম বাড়িয়ে সরকার এই খাতের ভর্তুকি কার্যত তুলে দিয়েছে। উপরন্তু তেল বিপণনকে লাভজনক করে জ্বালানি তেল থেকে বিপুল অঙ্কের রাজস্ব আয়ের পথ পরিষ্কার করে নিয়েছে। উল্লেখ্য, জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণন থেকে সরকার প্রায় ৩৫ শতাংশ শুল্ক ও কর নেয়। কাজেই এই পণ্যের দাম যত বেশি রাখা যায়, বিপিসির তত বেশি লাভ হয়। সরকারের শুল্ক ও করের অঙ্কও ততই বড় হয়। এ রকম একটি স্বস্তিকর অবস্থান সরকার কেন বদলাবে? বিশেষ করে যখন সরকারের আর্থিক সংকট প্রকটতর হচ্ছে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৪ দিন আগে