এ কে এম শামসুদ্দিন
বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো তিনটি স্তরে বিভক্ত, যার সর্বনিম্ন স্তর হলো উপজেলা। উপজেলা প্রশাসনিক প্রধান হলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার বা ইউএনও।
একজন ইউএনও বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোর মাঠপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কিন্তু ইদানীং কিছু কিছু ইউএনওর উগ্র আচরণে মানুষের মনে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনার ঝড় তুলেছে।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মেহরুবা ইসলাম ফুটবল টুর্নামেন্টের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ট্রফি আছাড় দিয়ে ভেঙে আলোচনায় আসেন। এ ঘটনার একটি ভিডিও যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এ ঘটনার ঠিক আগের দিন রাতে, বগুড়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সমর কুমার পালের বিরুদ্ধে আলমগীর হোসেন শেখ নামের এলজিইডির চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারীকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। মারধরের একপর্যায়ে আলমগীর সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। তাঁর এই অচেতন হয়ে পড়ে থাকার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখনো ঘুরছে। এর আগে গত ২১ জুলাই কক্সবাজারের টেকনাফে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নির্মাণকাজের কোয়ালিটি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কায়সার খসরু স্থানীয় সাংবাদিক সাইদুল ফরহাদকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন, যার অডিও রেকর্ড প্রকাশ হয়ে পড়লে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ হয়। যোগাযোগমাধ্যমে দেশের সাধারণ মানুষের শুধু তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশই নয়, বিভিন্ন সময়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের ক্ষমতার আস্ফালন দেখানো ও তাঁদের মুখের অকথ্য ভাষার ব্যবহারকে ‘মাস্তানদের চেয়েও খারাপ ভাষা’ বলে দেশের উচ্চ আদালত মন্তব্য করেছেন।
তারও আগে গত ৯ জুলাই মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুনা লায়লাকে ‘ম্যাডাম’ না বলে আপা সম্বোধন করায় তাঁর সঙ্গে থাকা পুলিশ স্থানীয় এক ব্যবসায়ী তপন চন্দ্র দাসকে লাঠিপেটা করে। গত বছরের ৪ জানুয়ারি নওগাঁর বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলপনা ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। তিনি কোনো রাখঢাক না করে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটূক্তি করেন। একই বছরের আগস্ট মাসে লালমনিরহাট জেলার আদিতমারীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনসুর উদ্দিন আরও বেশি গর্হিত কাজ করেছেন। তিনি হিন্দুসম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছেন। ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে নালা তৈরি করতে নিষেধ করায় মুনসুর উদ্দিন হিন্দুসম্প্রদায়ের স্থানীয় দুজন মানুষকে ‘থাপ্পড়’ দিয়ে দাঁত ফেলে দেবেন বলে ধমক দেন। শুধু তাই-ই নয়, তাঁদের জমি ‘খাস’ করে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়ারও হুমকি দেন ওই ইউএনও। এতৎসংক্রান্ত একটি অভিযোগপত্র ডেপুটি কালেক্টর (ডিসি) অফিসে জমাও পড়েছে।
দেশে এখন সিনিয়র থেকে শুরু করে সহকারী সচিব পর্যন্ত প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আছেন ৫ হাজার ৯৭৩ জন। মাঠপর্যায়ের প্রশাসনের পদগুলোর মধ্যে ডিসি ও ইউএনওর পদ দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দেশে মোট উপজেলা ৪৯২টি। প্রতিটি উপজেলায় একজন করে ইউএনও নিয়োগ করা আছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইউএনওসহ প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের কিছু কিছু কর্মকর্তার অসভ্য আচরণে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। সরকারি আচরণ বিধিমালায় ৩৪টি নির্দেশনা রয়েছে। এসব নির্দেশনায় আচরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কার্যক্রম কেমন হবে, তা উল্লেখ থাকলেও নাগরিকদের সঙ্গে আচরণ বিষয়ে আলাদা কোনো বিধান নেই। অবশ্য ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী বিধিমালায়, নাগরিকদের সঙ্গে যেকোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য হবে—এমন একটি বিধির উল্লেখ আছে। এখানে অসদাচরণ বলতে ‘অসংগত আচরণ, চাকরি শৃঙ্খলাহানিকর আচরণ বা শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণকে বোঝানো হয়েছে। গত ১০ বছরে প্রশাসনের প্রায় ৩ হাজার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, নারীঘটিত সমস্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জমা আছে। বিভিন্ন অভিযোগে পাঁচ শর মতো বিভাগীয় মামলা হলেও এর মধ্যে মাত্র এক শর মতো কর্মকর্তাকে লঘু ও গুরুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে সর্বোচ্চ শাস্তি চাকরিচ্যুতির নজির নেই বললেই চলে।
শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করে বলে প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। এমন ঘটনাও ঘটেছে, শাস্তি দেওয়ার পরও শাস্তি মওকুফ করে নেওয়ার উদাহরণ আছে। আমাদের অনেকেরই হয়তো মনে আছে, কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনের বিরুদ্ধে একটি সংবাদ প্রকাশিত হলে মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে কারাদণ্ড দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে চারদিকে বেশ হইচই পড়ে গিয়েছিল। ফলে সুলতানা পারভীন ও রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) নাজিম উদ্দিন বিভাগীয় শাস্তির মুখে পড়েছিলেন। পরে তাঁরা উভয়ই পৃথকভাবে আবেদন করে শাস্তি মওকুফ করে নিয়েছিলেন। এ ঘটনায় কী প্রমাণিত হয়?
এটা কি প্রমাণিত হয় না যে যত বড় ঘটনাই হোক বা যত গর্হিত অপরাধই করুক না কেন, এর পরিণতি বেশি হলে বিভাগীয় শাস্তি মাত্র, যা আবার আবেদন করে মওকুফও করা যায়। সুলতানা পারভীনের এ ঘটনা প্রশাসনিক ক্যাডারের ইতিহাসে অন্যতম কলঙ্কজনক উদাহরণ হয়ে থাকবে অনেক দিন।
বর্তমানে উপজেলাগুলোতে উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও ও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ের কারণে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা তেমনভাবে কার্যকরি ভূমিকা পালন করতে পারছে না। তাঁদের কাজে বাধা তৈরি করছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সামন্তবাদী আচরণ। তাঁদের এমন ক্ষমতায়ন করা হয়েছে যে তাঁরা এখন আর সেই ভার সামাল দিতে পারছেন না। এ কারণেই তরুণ বয়সী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা মাঝেমধ্যেই ক্ষমতার এমন অপব্যবহার করেন, যা পুরো প্রশাসনিক ক্যাডারের জন্য লজ্জা বয়ে আনে। তাঁদের এই কার্যকলাপ নিয়ে উপজেলা পরিষদেরও অনেক অভিযোগ আছে। ‘বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশন’-এর ব্যানারে উপজেলা চেয়ারম্যানরা অনেক আগে থেকেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছেন। তাঁরা বলেন, ‘জনপ্রতিনিধিহীন জনপ্রশাসন সংবিধানবহির্ভূত ও ভয়ংকর।’ তাঁদের অভিযোগ, উপজেলা পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা থাকলেও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা সবকিছু উপেক্ষা করে উপজেলায় শাসকের দায়িত্ব পালন করছেন। উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের পাশ কাটিয়ে সরকারের নানা উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে তাঁরা এককভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা উপজেলা পরিষদের বদলে নাম ব্যবহার করছেন উপজেলা প্রশাসন। চেয়ারম্যানের অনুমোদন ছাড়াই সব কাজ পরিচালনা করছেন। অথচ উপজেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে তাঁদের সচিবের দায়িত্ব পালন করার কথা। উল্লেখ্য, উপজেলা পরিষদ আইন (সংশোধিত) ২০১১ অনুযায়ী, সব উপজেলাকে প্রশাসনিক একাংশ ঘোষণা করা হয়েছে। আইনটির তৃতীয় তফসিলে ১২টি মন্ত্রণালয়ের উপজেলাভিত্তিক ১৭টি বিভাগকে উপজেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অথচ উপজেলা চেয়ারম্যানকে উপদেষ্টা করে ইউএনওরা এই ১৭টি বিভাগের সভাপতি হয়ে বসে আছেন। উপজেলা পরিষদ আইন পুরোপুরি বাস্তবায়ন না করে বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আদেশ, পরিপত্র জারি করে উপজেলা চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে। আমতান্ত্রিক এই কূটচালে উপজেলার জনপ্রতিনিধিরা স্বাধীনভাবে কাজ করতেও পারছেন না।
এ জন্য অবশ্য ইউএনওদের পুরোপুরি দোষও দেওয়া যাচ্ছে না। সরকার থেকে এই আইন যত দিন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হচ্ছে না, তত দিন এ সমস্যার সমাধান হবে না। সরকারের অতিমাত্রায় আমলানির্ভরতা স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের কোণঠাসা করে ফেলছে। এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ২০১৪ সালের একতরফা সাধারণ নির্বাচনের পর থেকেই।
২০১৮ সালের নির্বাচনের পর সরকারের এই আমলানির্ভরতা আরও বেড়ে গেছে। এই দুটো নির্বাচনে বর্তমান সরকারের ক্ষমতাসীন হওয়ার পেছনে ইউএনওদের কী ভূমিকা ছিল, তা নতুন করে উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগেই আমলাতন্ত্রনির্ভরতা বেড়েছে। এ কারণেই বর্তমানে দেশে যে বিধিব্যবস্থা চালু আছে তাতে জনগণের সার্বভৌমত্ব পুরো নিশ্চিত করে না। নির্বাহী বিভাগের কাছে একচেটিয়া ক্ষমতা চলে গেছে। দেশের শাসনব্যবস্থা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে তাতে ডিসি, ইউএনওসহ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা নিজেদের প্রভু এবং জনগণকে প্রজা মনে করেন। একটা কথা মনে রাখতে হবে, গণতান্ত্রিক দুর্বলতা ও জনবিচ্ছিন্নতা বাড়লে একচেটিয়া ব্যবস্থা কায়েম হয়। আর একচেটিয়া ব্যবস্থা যখন চালু হয়, তখন ক্ষমতার অপপ্রয়োগও হয় বেশি। ফলে প্রশাসনের শৃঙ্খলাতেও ঘাটতি দেখা দেয়। কেউ কাউকে মানতে চান না। ক্ষমতার দাপট দেখাতে তাঁরা একধরনের তৃপ্তি খুঁজে পান। তারই যেন বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে আলীকদম উপজেলার ইউএনও মেহরুবা ইসলাম, বগুড়া সদর উপজেলা ইউএনও সমর কুমার পাল এবং আদিতমারীর ইউএনও মুনসুর উদ্দিনের বেপরোয়া আচরণের মধ্য দিয়ে।
এ দেশের মানুষ প্রজা নয়, নাগরিক। নাগরিকদের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যেকোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি পেতেই
হবে। প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে। কুড়িগ্রামের ডিসি সুলতানা পারভীনের মতো বিভাগীয় শাস্তি দিয়ে পরে মাফ করে দেওয়ার মতো ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে মেহরুবা ইসলাম ও সমর কুমার পালের মতো ইউএনওর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ঠেকানো যাবে না।
বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো তিনটি স্তরে বিভক্ত, যার সর্বনিম্ন স্তর হলো উপজেলা। উপজেলা প্রশাসনিক প্রধান হলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার বা ইউএনও।
একজন ইউএনও বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামোর মাঠপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কিন্তু ইদানীং কিছু কিছু ইউএনওর উগ্র আচরণে মানুষের মনে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনার ঝড় তুলেছে।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মেহরুবা ইসলাম ফুটবল টুর্নামেন্টের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ট্রফি আছাড় দিয়ে ভেঙে আলোচনায় আসেন। এ ঘটনার একটি ভিডিও যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এ ঘটনার ঠিক আগের দিন রাতে, বগুড়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সমর কুমার পালের বিরুদ্ধে আলমগীর হোসেন শেখ নামের এলজিইডির চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারীকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। মারধরের একপর্যায়ে আলমগীর সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। তাঁর এই অচেতন হয়ে পড়ে থাকার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখনো ঘুরছে। এর আগে গত ২১ জুলাই কক্সবাজারের টেকনাফে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নির্মাণকাজের কোয়ালিটি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ কায়সার খসরু স্থানীয় সাংবাদিক সাইদুল ফরহাদকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন, যার অডিও রেকর্ড প্রকাশ হয়ে পড়লে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ হয়। যোগাযোগমাধ্যমে দেশের সাধারণ মানুষের শুধু তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশই নয়, বিভিন্ন সময়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের ক্ষমতার আস্ফালন দেখানো ও তাঁদের মুখের অকথ্য ভাষার ব্যবহারকে ‘মাস্তানদের চেয়েও খারাপ ভাষা’ বলে দেশের উচ্চ আদালত মন্তব্য করেছেন।
তারও আগে গত ৯ জুলাই মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুনা লায়লাকে ‘ম্যাডাম’ না বলে আপা সম্বোধন করায় তাঁর সঙ্গে থাকা পুলিশ স্থানীয় এক ব্যবসায়ী তপন চন্দ্র দাসকে লাঠিপেটা করে। গত বছরের ৪ জানুয়ারি নওগাঁর বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলপনা ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। তিনি কোনো রাখঢাক না করে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কটূক্তি করেন। একই বছরের আগস্ট মাসে লালমনিরহাট জেলার আদিতমারীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনসুর উদ্দিন আরও বেশি গর্হিত কাজ করেছেন। তিনি হিন্দুসম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছেন। ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে নালা তৈরি করতে নিষেধ করায় মুনসুর উদ্দিন হিন্দুসম্প্রদায়ের স্থানীয় দুজন মানুষকে ‘থাপ্পড়’ দিয়ে দাঁত ফেলে দেবেন বলে ধমক দেন। শুধু তাই-ই নয়, তাঁদের জমি ‘খাস’ করে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়ারও হুমকি দেন ওই ইউএনও। এতৎসংক্রান্ত একটি অভিযোগপত্র ডেপুটি কালেক্টর (ডিসি) অফিসে জমাও পড়েছে।
দেশে এখন সিনিয়র থেকে শুরু করে সহকারী সচিব পর্যন্ত প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আছেন ৫ হাজার ৯৭৩ জন। মাঠপর্যায়ের প্রশাসনের পদগুলোর মধ্যে ডিসি ও ইউএনওর পদ দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দেশে মোট উপজেলা ৪৯২টি। প্রতিটি উপজেলায় একজন করে ইউএনও নিয়োগ করা আছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইউএনওসহ প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের কিছু কিছু কর্মকর্তার অসভ্য আচরণে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। সরকারি আচরণ বিধিমালায় ৩৪টি নির্দেশনা রয়েছে। এসব নির্দেশনায় আচরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কার্যক্রম কেমন হবে, তা উল্লেখ থাকলেও নাগরিকদের সঙ্গে আচরণ বিষয়ে আলাদা কোনো বিধান নেই। অবশ্য ২০১৮ সালের সরকারি কর্মচারী বিধিমালায়, নাগরিকদের সঙ্গে যেকোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য হবে—এমন একটি বিধির উল্লেখ আছে। এখানে অসদাচরণ বলতে ‘অসংগত আচরণ, চাকরি শৃঙ্খলাহানিকর আচরণ বা শিষ্টাচারবহির্ভূত আচরণকে বোঝানো হয়েছে। গত ১০ বছরে প্রশাসনের প্রায় ৩ হাজার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, নারীঘটিত সমস্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জমা আছে। বিভিন্ন অভিযোগে পাঁচ শর মতো বিভাগীয় মামলা হলেও এর মধ্যে মাত্র এক শর মতো কর্মকর্তাকে লঘু ও গুরুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে সর্বোচ্চ শাস্তি চাকরিচ্যুতির নজির নেই বললেই চলে।
শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করে বলে প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। এমন ঘটনাও ঘটেছে, শাস্তি দেওয়ার পরও শাস্তি মওকুফ করে নেওয়ার উদাহরণ আছে। আমাদের অনেকেরই হয়তো মনে আছে, কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনের বিরুদ্ধে একটি সংবাদ প্রকাশিত হলে মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাংবাদিক আরিফুল ইসলামকে কারাদণ্ড দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে চারদিকে বেশ হইচই পড়ে গিয়েছিল। ফলে সুলতানা পারভীন ও রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) নাজিম উদ্দিন বিভাগীয় শাস্তির মুখে পড়েছিলেন। পরে তাঁরা উভয়ই পৃথকভাবে আবেদন করে শাস্তি মওকুফ করে নিয়েছিলেন। এ ঘটনায় কী প্রমাণিত হয়?
এটা কি প্রমাণিত হয় না যে যত বড় ঘটনাই হোক বা যত গর্হিত অপরাধই করুক না কেন, এর পরিণতি বেশি হলে বিভাগীয় শাস্তি মাত্র, যা আবার আবেদন করে মওকুফও করা যায়। সুলতানা পারভীনের এ ঘটনা প্রশাসনিক ক্যাডারের ইতিহাসে অন্যতম কলঙ্কজনক উদাহরণ হয়ে থাকবে অনেক দিন।
বর্তমানে উপজেলাগুলোতে উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও ও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াইয়ের কারণে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা তেমনভাবে কার্যকরি ভূমিকা পালন করতে পারছে না। তাঁদের কাজে বাধা তৈরি করছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সামন্তবাদী আচরণ। তাঁদের এমন ক্ষমতায়ন করা হয়েছে যে তাঁরা এখন আর সেই ভার সামাল দিতে পারছেন না। এ কারণেই তরুণ বয়সী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা মাঝেমধ্যেই ক্ষমতার এমন অপব্যবহার করেন, যা পুরো প্রশাসনিক ক্যাডারের জন্য লজ্জা বয়ে আনে। তাঁদের এই কার্যকলাপ নিয়ে উপজেলা পরিষদেরও অনেক অভিযোগ আছে। ‘বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশন’-এর ব্যানারে উপজেলা চেয়ারম্যানরা অনেক আগে থেকেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছেন। তাঁরা বলেন, ‘জনপ্রতিনিধিহীন জনপ্রশাসন সংবিধানবহির্ভূত ও ভয়ংকর।’ তাঁদের অভিযোগ, উপজেলা পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা থাকলেও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা সবকিছু উপেক্ষা করে উপজেলায় শাসকের দায়িত্ব পালন করছেন। উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের পাশ কাটিয়ে সরকারের নানা উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে তাঁরা এককভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা উপজেলা পরিষদের বদলে নাম ব্যবহার করছেন উপজেলা প্রশাসন। চেয়ারম্যানের অনুমোদন ছাড়াই সব কাজ পরিচালনা করছেন। অথচ উপজেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে তাঁদের সচিবের দায়িত্ব পালন করার কথা। উল্লেখ্য, উপজেলা পরিষদ আইন (সংশোধিত) ২০১১ অনুযায়ী, সব উপজেলাকে প্রশাসনিক একাংশ ঘোষণা করা হয়েছে। আইনটির তৃতীয় তফসিলে ১২টি মন্ত্রণালয়ের উপজেলাভিত্তিক ১৭টি বিভাগকে উপজেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অথচ উপজেলা চেয়ারম্যানকে উপদেষ্টা করে ইউএনওরা এই ১৭টি বিভাগের সভাপতি হয়ে বসে আছেন। উপজেলা পরিষদ আইন পুরোপুরি বাস্তবায়ন না করে বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আদেশ, পরিপত্র জারি করে উপজেলা চেয়ারম্যানদের ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে। আমতান্ত্রিক এই কূটচালে উপজেলার জনপ্রতিনিধিরা স্বাধীনভাবে কাজ করতেও পারছেন না।
এ জন্য অবশ্য ইউএনওদের পুরোপুরি দোষও দেওয়া যাচ্ছে না। সরকার থেকে এই আইন যত দিন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হচ্ছে না, তত দিন এ সমস্যার সমাধান হবে না। সরকারের অতিমাত্রায় আমলানির্ভরতা স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের কোণঠাসা করে ফেলছে। এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে ২০১৪ সালের একতরফা সাধারণ নির্বাচনের পর থেকেই।
২০১৮ সালের নির্বাচনের পর সরকারের এই আমলানির্ভরতা আরও বেড়ে গেছে। এই দুটো নির্বাচনে বর্তমান সরকারের ক্ষমতাসীন হওয়ার পেছনে ইউএনওদের কী ভূমিকা ছিল, তা নতুন করে উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগেই আমলাতন্ত্রনির্ভরতা বেড়েছে। এ কারণেই বর্তমানে দেশে যে বিধিব্যবস্থা চালু আছে তাতে জনগণের সার্বভৌমত্ব পুরো নিশ্চিত করে না। নির্বাহী বিভাগের কাছে একচেটিয়া ক্ষমতা চলে গেছে। দেশের শাসনব্যবস্থা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে তাতে ডিসি, ইউএনওসহ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা নিজেদের প্রভু এবং জনগণকে প্রজা মনে করেন। একটা কথা মনে রাখতে হবে, গণতান্ত্রিক দুর্বলতা ও জনবিচ্ছিন্নতা বাড়লে একচেটিয়া ব্যবস্থা কায়েম হয়। আর একচেটিয়া ব্যবস্থা যখন চালু হয়, তখন ক্ষমতার অপপ্রয়োগও হয় বেশি। ফলে প্রশাসনের শৃঙ্খলাতেও ঘাটতি দেখা দেয়। কেউ কাউকে মানতে চান না। ক্ষমতার দাপট দেখাতে তাঁরা একধরনের তৃপ্তি খুঁজে পান। তারই যেন বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে আলীকদম উপজেলার ইউএনও মেহরুবা ইসলাম, বগুড়া সদর উপজেলা ইউএনও সমর কুমার পাল এবং আদিতমারীর ইউএনও মুনসুর উদ্দিনের বেপরোয়া আচরণের মধ্য দিয়ে।
এ দেশের মানুষ প্রজা নয়, নাগরিক। নাগরিকদের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যেকোনো অসদাচরণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি পেতেই
হবে। প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে। কুড়িগ্রামের ডিসি সুলতানা পারভীনের মতো বিভাগীয় শাস্তি দিয়ে পরে মাফ করে দেওয়ার মতো ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে মেহরুবা ইসলাম ও সমর কুমার পালের মতো ইউএনওর ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ঠেকানো যাবে না।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে