হাসান মামুন
আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যসামগ্রীর দাম কমে এলেও দেশীয় বাজারে এর প্রভাব পড়তে অনেক সময় লেগে যাওয়ার মতো একটা পরিস্থিতি আমাদের আছে। এ জন্য আলাদা করে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে দায়ী করার প্রবণতাও রয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ব্যাপারটা ঠিকমতো মনিটর ও ম্যানেজ করে না বলে অভিযোগও কম নেই।
খোদ সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে এলেও তার বিক্রি করা পণ্যের দাম না কমানোর। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামের যে পরিস্থিতি, তাতে সরকার এর দাম কিছুটা কমিয়ে আনতে পারে বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।
তেমন প্রতিশ্রুতি দেওয়াও হয়েছিল, যখন ডিজেলসহ সব জ্বালানির দাম বাড়ানো হয় রেকর্ড পরিমাণে। সেই প্রতিশ্রুতি রাখা হচ্ছে না এ যুক্তিতেও যে আগে দীর্ঘদিন ভর্তুকি দামে জ্বালানি পণ্য বিক্রি করে লোকসান দিয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। সেটা পুষিয়ে নিতে হবে না? এই ‘যুক্তি’ যখন বেসরকারি খাতের ভেতর থেকে দেওয়া হয়, তখন কিন্তু আমরা এর তীব্র সমালোচনা করে থাকি।
জ্বালানি তেল, বিশেষ করে ডিজেলের দাম কমানো হলে এর একটা প্রভাব পড়ত পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে। তাতে সব ধরনের পণ্যসামগ্রীর দাম কমে আসার প্রবণতাও লক্ষ করা যেত। তবে কতটা যেত, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। দাম বাড়ার বিষয়টি এ দেশে যত দ্রুততার সঙ্গে ঘটে থাকে; দাম কমে আসাটা তত দ্রুত ঘটতে দেখা যায় না। সম্প্রতি পেঁয়াজের বাজারে এটা দেখা গেল। ভারত থেকে কম দামে আমদানি হলেও খুচরা বাজার পর্যন্ত এর দাম কমে আসতে অনেক সময় লেগেছে।
আমাদের জন্য পেঁয়াজ আমদানির সহজ গন্তব্য ভারতে এর ওপর সম্প্রতি উচ্চহারে শুল্ক বসানো হচ্ছে বলে খবর প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে এখানে দাম বেড়ে গেছে নতুন করে। দেশে উৎপাদিত এবং ইতিপূর্বে কম খরচে আমদানি করা পেঁয়াজ দুটোর দামই বেড়ে গেছে। কোনো পণ্যের দাম বাড়ার ওপর এ-সংক্রান্ত নেতিবাচক খবরের একটা ভূমিকা আছে অবশ্য। আমাদের দেশে সেটা বোধ হয় বেশি ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। এ অবস্থায় বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের সংশ্লিষ্টদের আরও বেশি করে দায়িত্ব গ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হয়। একা ভোক্তা অধিদপ্তরের পক্ষে এ গুরুদায়িত্ব পালন যে সম্ভব নয়, সেটা বুঝতে কারও কষ্ট হচ্ছে না।
খাদ্যপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার মাঝে বেশ অস্থির হয়ে উঠেছিল। এটা কতটা বৈশ্বিক আর কতটা অভ্যন্তরীণ কারণে, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। এর মধ্যে ওই বাজারে বেশ কিছু পণ্যের দাম কমে আসার প্রবণতাও লক্ষণীয়। তাতে আশা জেগেছিল, যেসব পণ্য আমরা বেশি বেশি আমদানি করে থাকি, সেগুলোর দাম কমে আসবে। সেটা হয়নি দুদিক থেকে।
এক. দ্রুততার সঙ্গে হয়নি। দুই. হিসাবে যতটা কমার কথা, ততটা কমেনি। এর কারণ হিসেবে অবশ্য বলা হচ্ছে ডলারের দাম অব্যাহতভাবে বেড়ে যাওয়ার কথা। গত এক বছরে দেশে এর দাম কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বেড়েছে। বেশি দামেও ডলার প্রাপ্তিতে সমস্যা দেখা দেয় মাঝেমধ্যে। তাতে আমদানি-প্রক্রিয়াই ঝুলে পড়ে। এ অবস্থায় ওষুধ তৈরির উপকরণের মতো কিছু জরুরি পণ্যের আমদানি ব্যাহত হওয়ারও খবর মিলেছিল।
শিল্পের কাঁচামাল আর মেশিনারিজ আমদানিও কমে যায় উল্লেখযোগ্যভাবে। তার প্রভাব নিশ্চিতভাবে পড়েছে কর্মসংস্থানে। মানুষ কাজ হারালে এবং নতুন করে কাজ না পেলে আয় কমে যায়। এটা যখন ঘটে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকা পরিস্থিতিতে, তখন সেটা হয় বিপজ্জনক। এ অবস্থায় সরকারকে উদ্যোগী থাকতে হয় যেখানে যেখানে দাম কমানোর সুযোগ রয়েছে, তা পরিপূর্ণভাবে নিতে।
ব্যবসায়ীদের মুনাফার পক্ষে কম থেকে ভোক্তাস্বার্থের পক্ষে বেশি করে থাকতে হয় তখন। আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ কিছু পণ্যের দাম কমে আসার সময়টায় স্থানীয় বাজারের নড়াচড়া দেখে কিন্তু তা মনে হয়নি। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় কমেনি বলে দামও সেভাবে কমানো যায়নি—ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের এ ঢালাও বক্তব্য মেনে নেওয়া যায় না। সংবাদপত্রে এ বিষয়ে তো কম প্রতিবেদন আসেনি। অনেক ক্ষেত্রেই নিত্যপণ্যের দাম যে আরও কমানো সম্ভব ছিল, সেই প্রশ্নের সদুত্তরও মেলেনি।
এ সমস্যা বেশি দেখা দেয় আমদানিনির্ভর পণ্যের ক্ষেত্রে। এখানে চিনির কথা তোলা যায়। চিনিতে আমরা আমদানিনির্ভর। চিনি পরিশোধন করে যারা বাজারে ছাড়ে, তাদের জোটবদ্ধতাও দেখার মতো। লক্ষ করা গেল, সরকার দফায় দফায় বসে বাহাস করেও তাদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলো। মাঝে তারা নিজেরা ঘোষণা দিয়ে দাম বাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটান। আন্তর্জাতিক বাজারে অন্যান্য পণ্যের মতো চিনির দাম অবশ্য সেভাবে কমেনি। তারপরও প্রশ্ন ওঠে সংশ্লিষ্ট জোটবদ্ধ ব্যবসায়ীদের আচরণে।
এদিকে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তে বাড়তে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল গত এক বছরে। এ ক্ষেত্রেও আমরা আমদানিনির্ভর। আর এ ক্ষেত্রেও আছে ভোজ্যতেল পরিশোধনকারীদের জোটবদ্ধতা। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে আসার প্রবণতা থাকলেও ডলারের দামকে অজুহাত করে ভোজ্যতেলের দাম সেভাবে কমতে তাঁরা দিচ্ছেন না। রাষ্ট্রীয় সংস্থা টিসিবির মাধ্যমে একটি জনগোষ্ঠীকে অবশ্য ভর্তুকি দামে চিনি ও ভোজ্যতেল জোগানো হচ্ছে। নানা অভিযোগ থাকলেও এতে করে কিছু উপকার যে হচ্ছে না, তা নয়। তবে মূল্যস্ফীতির সামগ্রিক চাপ কমিয়ে আনতে এসব পদক্ষেপ প্রভাব রাখতে পারছে কমই।
১৭-১৮ কোটি মানুষের দেশে কোনো সরকারের পক্ষেই চিনি, ভোজ্যতেলের মতো পণ্য অব্যাহতভাবে কম দামে দিয়ে বেসরকারি খাতের প্রতিযোগী হয়ে বাজার শান্ত রাখা সম্ভব নয়। এতটা আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা অর্জনের বিষয়টি কল্পনা করাও কঠিন। সরকারকে এ ক্ষেত্রে তথাকথিত সিন্ডিকেটের কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ না করে বরং তীক্ষ্ণভাবে হিসাব করে দেখতে হবে, নিত্যপণ্যের বাজার স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে কি না। সেটি না করলে রীতিমতো গবেষণা করে যেসব জায়গায় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা নিতে হবে।
খুচরা পর্যায়ে দৈহিকভাবে উপস্থিত হয়ে জরিমানার মতো পদক্ষেপ নেওয়ার প্রবণতা অবশ্য দেখা যায়। তা প্রচারও পেয়ে থাকে। কিন্তু এর সুফল সামান্য। এরই মধ্যে বাণিজ্যমন্ত্রীর এ বক্তব্য তীব্রভাবে সমালোচিত হলো যে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে পণ্যবাজার হয়তো আরও অস্থিতিশীল হবে। কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।
সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, সিন্ডিকেট গড়ে উঠতেই বা দেওয়া কেন? যেসব পণ্যের বাজারে সিন্ডিকেশনের সুযোগ সত্যিই রয়েছে, সেখানে বিপুলসংখ্যক ভোক্তার পক্ষে সরকার কী করতে পারে—তাহলে তো সে আলোচনা হওয়া দরকার। বাংলাদেশের সমমানের দেশগুলোর অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে দেখাটাও এ ক্ষেত্রে জরুরি।
সরকার উদ্যোগী হলে যে কঠিন পরিস্থিতি থেকেও বেরিয়ে আসা যায়, সাম্প্রতিককালে শ্রীলঙ্কা এর দৃষ্টান্ত। তারা অর্থনৈতিকভাবে এমন এক পরিস্থিতিতে পড়েছিল, যাতে নজিরবিহীন গণ-অভ্যুত্থান ঘটে দেশটিতে। নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়ে কতটা কী করতে পারবে, তা নিয়েও সংশয় কম ছিল না। কিন্তু দেখা গেল, উপযুক্ত সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ায় পরিস্থিতি ক্রমে নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে। শ্রীলঙ্কায় মাত্রাছাড়া মূল্যস্ফীতিও এখন নিয়ন্ত্রিত।
যে খাতগুলো তার অর্থনীতির প্রাণ, সেগুলো ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তাতে দেশটির রিজার্ভ পরিস্থিতিরও উন্নতি লক্ষণীয়। তারা বাংলাদেশ থেকে নেওয়া ঋণের একাংশ ইতিমধ্যে ফেরত দিতে সক্ষম হয়েছে। বাকি ঋণও সময়মতো ফেরত দিতে পারবে বলে আশা। এতে বাংলাদেশও উপকৃত হবে। আমরা তো আছি রিজার্ভ-সংকটে। প্রকৃত রিজার্ভ এত দিন দেখানো না হলেও আইএমএফের চাপে যখন এটা প্রকাশ করতে হচ্ছে, তখন দেখা যাচ্ছে রিজার্ভ আসলেই কম। স্বস্তিকর সময়ে সরকার এর সদ্ব্যবহার কতটা করতে পেরেছিল, সে প্রশ্নও কম উঠছে না। পরে অধিকতর রিজার্ভ-সংকটের আশঙ্কায় সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণে যাওয়াতেও নিত্যপণ্যের বাজারে সংকট বেড়ে উঠেছে বললে কি ভুল হবে?
আন্তর্জাতিক বাজারে কিছু জরুরি খাদ্যপণ্যের দাম আবার নতুন করে বাড়তে পারে বলে খবর মিলছে। এর মধ্যে গমের পাশাপাশি রয়েছে চাল। চাল আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য। এর মজুত সরকারিভাবে যথেষ্ট বলা হলেও চালে কিছু আমদানিনির্ভরতা কিন্তু রয়েছে। গমের ক্ষেত্রে আমরা অনেক বেশি আমদানিনির্ভর। দেশে ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন ভালো হওয়ায় চালের দাম অবশ্য কিছুটা কমে এসেছিল।
আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম কমে আসায় আটা-ময়দার দামও কমে আসার প্রবণতা ছিল; বিশেষ করে দরিদ্রদের খাদ্যনিরাপত্তার দিকে তাকিয়ে সরকারকে এখন থেকে এ ব্যাপারে সতর্কভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। সামনেই রয়েছে অতিগুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন। তার উপযুক্ত আয়োজন নিয়ে সংকটও কম নেই। এ অবস্থায় জরুরি খাদ্যপণ্যের বাজার নতুন করে অশান্ত হলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়তে সময় লাগবে না।
লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যসামগ্রীর দাম কমে এলেও দেশীয় বাজারে এর প্রভাব পড়তে অনেক সময় লেগে যাওয়ার মতো একটা পরিস্থিতি আমাদের আছে। এ জন্য আলাদা করে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে দায়ী করার প্রবণতাও রয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ব্যাপারটা ঠিকমতো মনিটর ও ম্যানেজ করে না বলে অভিযোগও কম নেই।
খোদ সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে এলেও তার বিক্রি করা পণ্যের দাম না কমানোর। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামের যে পরিস্থিতি, তাতে সরকার এর দাম কিছুটা কমিয়ে আনতে পারে বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।
তেমন প্রতিশ্রুতি দেওয়াও হয়েছিল, যখন ডিজেলসহ সব জ্বালানির দাম বাড়ানো হয় রেকর্ড পরিমাণে। সেই প্রতিশ্রুতি রাখা হচ্ছে না এ যুক্তিতেও যে আগে দীর্ঘদিন ভর্তুকি দামে জ্বালানি পণ্য বিক্রি করে লোকসান দিয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। সেটা পুষিয়ে নিতে হবে না? এই ‘যুক্তি’ যখন বেসরকারি খাতের ভেতর থেকে দেওয়া হয়, তখন কিন্তু আমরা এর তীব্র সমালোচনা করে থাকি।
জ্বালানি তেল, বিশেষ করে ডিজেলের দাম কমানো হলে এর একটা প্রভাব পড়ত পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে। তাতে সব ধরনের পণ্যসামগ্রীর দাম কমে আসার প্রবণতাও লক্ষ করা যেত। তবে কতটা যেত, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। দাম বাড়ার বিষয়টি এ দেশে যত দ্রুততার সঙ্গে ঘটে থাকে; দাম কমে আসাটা তত দ্রুত ঘটতে দেখা যায় না। সম্প্রতি পেঁয়াজের বাজারে এটা দেখা গেল। ভারত থেকে কম দামে আমদানি হলেও খুচরা বাজার পর্যন্ত এর দাম কমে আসতে অনেক সময় লেগেছে।
আমাদের জন্য পেঁয়াজ আমদানির সহজ গন্তব্য ভারতে এর ওপর সম্প্রতি উচ্চহারে শুল্ক বসানো হচ্ছে বলে খবর প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে এখানে দাম বেড়ে গেছে নতুন করে। দেশে উৎপাদিত এবং ইতিপূর্বে কম খরচে আমদানি করা পেঁয়াজ দুটোর দামই বেড়ে গেছে। কোনো পণ্যের দাম বাড়ার ওপর এ-সংক্রান্ত নেতিবাচক খবরের একটা ভূমিকা আছে অবশ্য। আমাদের দেশে সেটা বোধ হয় বেশি ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে। এ অবস্থায় বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের সংশ্লিষ্টদের আরও বেশি করে দায়িত্ব গ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হয়। একা ভোক্তা অধিদপ্তরের পক্ষে এ গুরুদায়িত্ব পালন যে সম্ভব নয়, সেটা বুঝতে কারও কষ্ট হচ্ছে না।
খাদ্যপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার মাঝে বেশ অস্থির হয়ে উঠেছিল। এটা কতটা বৈশ্বিক আর কতটা অভ্যন্তরীণ কারণে, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। এর মধ্যে ওই বাজারে বেশ কিছু পণ্যের দাম কমে আসার প্রবণতাও লক্ষণীয়। তাতে আশা জেগেছিল, যেসব পণ্য আমরা বেশি বেশি আমদানি করে থাকি, সেগুলোর দাম কমে আসবে। সেটা হয়নি দুদিক থেকে।
এক. দ্রুততার সঙ্গে হয়নি। দুই. হিসাবে যতটা কমার কথা, ততটা কমেনি। এর কারণ হিসেবে অবশ্য বলা হচ্ছে ডলারের দাম অব্যাহতভাবে বেড়ে যাওয়ার কথা। গত এক বছরে দেশে এর দাম কমপক্ষে ২৫ শতাংশ বেড়েছে। বেশি দামেও ডলার প্রাপ্তিতে সমস্যা দেখা দেয় মাঝেমধ্যে। তাতে আমদানি-প্রক্রিয়াই ঝুলে পড়ে। এ অবস্থায় ওষুধ তৈরির উপকরণের মতো কিছু জরুরি পণ্যের আমদানি ব্যাহত হওয়ারও খবর মিলেছিল।
শিল্পের কাঁচামাল আর মেশিনারিজ আমদানিও কমে যায় উল্লেখযোগ্যভাবে। তার প্রভাব নিশ্চিতভাবে পড়েছে কর্মসংস্থানে। মানুষ কাজ হারালে এবং নতুন করে কাজ না পেলে আয় কমে যায়। এটা যখন ঘটে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকা পরিস্থিতিতে, তখন সেটা হয় বিপজ্জনক। এ অবস্থায় সরকারকে উদ্যোগী থাকতে হয় যেখানে যেখানে দাম কমানোর সুযোগ রয়েছে, তা পরিপূর্ণভাবে নিতে।
ব্যবসায়ীদের মুনাফার পক্ষে কম থেকে ভোক্তাস্বার্থের পক্ষে বেশি করে থাকতে হয় তখন। আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ কিছু পণ্যের দাম কমে আসার সময়টায় স্থানীয় বাজারের নড়াচড়া দেখে কিন্তু তা মনে হয়নি। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় কমেনি বলে দামও সেভাবে কমানো যায়নি—ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের এ ঢালাও বক্তব্য মেনে নেওয়া যায় না। সংবাদপত্রে এ বিষয়ে তো কম প্রতিবেদন আসেনি। অনেক ক্ষেত্রেই নিত্যপণ্যের দাম যে আরও কমানো সম্ভব ছিল, সেই প্রশ্নের সদুত্তরও মেলেনি।
এ সমস্যা বেশি দেখা দেয় আমদানিনির্ভর পণ্যের ক্ষেত্রে। এখানে চিনির কথা তোলা যায়। চিনিতে আমরা আমদানিনির্ভর। চিনি পরিশোধন করে যারা বাজারে ছাড়ে, তাদের জোটবদ্ধতাও দেখার মতো। লক্ষ করা গেল, সরকার দফায় দফায় বসে বাহাস করেও তাদের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলো। মাঝে তারা নিজেরা ঘোষণা দিয়ে দাম বাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটান। আন্তর্জাতিক বাজারে অন্যান্য পণ্যের মতো চিনির দাম অবশ্য সেভাবে কমেনি। তারপরও প্রশ্ন ওঠে সংশ্লিষ্ট জোটবদ্ধ ব্যবসায়ীদের আচরণে।
এদিকে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তে বাড়তে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল গত এক বছরে। এ ক্ষেত্রেও আমরা আমদানিনির্ভর। আর এ ক্ষেত্রেও আছে ভোজ্যতেল পরিশোধনকারীদের জোটবদ্ধতা। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে আসার প্রবণতা থাকলেও ডলারের দামকে অজুহাত করে ভোজ্যতেলের দাম সেভাবে কমতে তাঁরা দিচ্ছেন না। রাষ্ট্রীয় সংস্থা টিসিবির মাধ্যমে একটি জনগোষ্ঠীকে অবশ্য ভর্তুকি দামে চিনি ও ভোজ্যতেল জোগানো হচ্ছে। নানা অভিযোগ থাকলেও এতে করে কিছু উপকার যে হচ্ছে না, তা নয়। তবে মূল্যস্ফীতির সামগ্রিক চাপ কমিয়ে আনতে এসব পদক্ষেপ প্রভাব রাখতে পারছে কমই।
১৭-১৮ কোটি মানুষের দেশে কোনো সরকারের পক্ষেই চিনি, ভোজ্যতেলের মতো পণ্য অব্যাহতভাবে কম দামে দিয়ে বেসরকারি খাতের প্রতিযোগী হয়ে বাজার শান্ত রাখা সম্ভব নয়। এতটা আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা অর্জনের বিষয়টি কল্পনা করাও কঠিন। সরকারকে এ ক্ষেত্রে তথাকথিত সিন্ডিকেটের কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ না করে বরং তীক্ষ্ণভাবে হিসাব করে দেখতে হবে, নিত্যপণ্যের বাজার স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে কি না। সেটি না করলে রীতিমতো গবেষণা করে যেসব জায়গায় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা নিতে হবে।
খুচরা পর্যায়ে দৈহিকভাবে উপস্থিত হয়ে জরিমানার মতো পদক্ষেপ নেওয়ার প্রবণতা অবশ্য দেখা যায়। তা প্রচারও পেয়ে থাকে। কিন্তু এর সুফল সামান্য। এরই মধ্যে বাণিজ্যমন্ত্রীর এ বক্তব্য তীব্রভাবে সমালোচিত হলো যে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে পণ্যবাজার হয়তো আরও অস্থিতিশীল হবে। কথাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।
সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, সিন্ডিকেট গড়ে উঠতেই বা দেওয়া কেন? যেসব পণ্যের বাজারে সিন্ডিকেশনের সুযোগ সত্যিই রয়েছে, সেখানে বিপুলসংখ্যক ভোক্তার পক্ষে সরকার কী করতে পারে—তাহলে তো সে আলোচনা হওয়া দরকার। বাংলাদেশের সমমানের দেশগুলোর অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে দেখাটাও এ ক্ষেত্রে জরুরি।
সরকার উদ্যোগী হলে যে কঠিন পরিস্থিতি থেকেও বেরিয়ে আসা যায়, সাম্প্রতিককালে শ্রীলঙ্কা এর দৃষ্টান্ত। তারা অর্থনৈতিকভাবে এমন এক পরিস্থিতিতে পড়েছিল, যাতে নজিরবিহীন গণ-অভ্যুত্থান ঘটে দেশটিতে। নতুন সরকার দায়িত্ব নিয়ে কতটা কী করতে পারবে, তা নিয়েও সংশয় কম ছিল না। কিন্তু দেখা গেল, উপযুক্ত সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ায় পরিস্থিতি ক্রমে নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে। শ্রীলঙ্কায় মাত্রাছাড়া মূল্যস্ফীতিও এখন নিয়ন্ত্রিত।
যে খাতগুলো তার অর্থনীতির প্রাণ, সেগুলো ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তাতে দেশটির রিজার্ভ পরিস্থিতিরও উন্নতি লক্ষণীয়। তারা বাংলাদেশ থেকে নেওয়া ঋণের একাংশ ইতিমধ্যে ফেরত দিতে সক্ষম হয়েছে। বাকি ঋণও সময়মতো ফেরত দিতে পারবে বলে আশা। এতে বাংলাদেশও উপকৃত হবে। আমরা তো আছি রিজার্ভ-সংকটে। প্রকৃত রিজার্ভ এত দিন দেখানো না হলেও আইএমএফের চাপে যখন এটা প্রকাশ করতে হচ্ছে, তখন দেখা যাচ্ছে রিজার্ভ আসলেই কম। স্বস্তিকর সময়ে সরকার এর সদ্ব্যবহার কতটা করতে পেরেছিল, সে প্রশ্নও কম উঠছে না। পরে অধিকতর রিজার্ভ-সংকটের আশঙ্কায় সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণে যাওয়াতেও নিত্যপণ্যের বাজারে সংকট বেড়ে উঠেছে বললে কি ভুল হবে?
আন্তর্জাতিক বাজারে কিছু জরুরি খাদ্যপণ্যের দাম আবার নতুন করে বাড়তে পারে বলে খবর মিলছে। এর মধ্যে গমের পাশাপাশি রয়েছে চাল। চাল আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য। এর মজুত সরকারিভাবে যথেষ্ট বলা হলেও চালে কিছু আমদানিনির্ভরতা কিন্তু রয়েছে। গমের ক্ষেত্রে আমরা অনেক বেশি আমদানিনির্ভর। দেশে ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন ভালো হওয়ায় চালের দাম অবশ্য কিছুটা কমে এসেছিল।
আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম কমে আসায় আটা-ময়দার দামও কমে আসার প্রবণতা ছিল; বিশেষ করে দরিদ্রদের খাদ্যনিরাপত্তার দিকে তাকিয়ে সরকারকে এখন থেকে এ ব্যাপারে সতর্কভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে। সামনেই রয়েছে অতিগুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন। তার উপযুক্ত আয়োজন নিয়ে সংকটও কম নেই। এ অবস্থায় জরুরি খাদ্যপণ্যের বাজার নতুন করে অশান্ত হলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়তে সময় লাগবে না।
লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে