ফজলুল কবির
গণতন্ত্র ফেরি করতে করতে ক্লান্ত যুক্তরাষ্ট্রের উর্দির ভেতরটা প্রকাশ হয়ে গিয়েছিল গত বছরের ৬ জানুয়ারি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং এ নিয়ে গোটা দুনিয়ার সচকিত চোখের সামনেই এদিন ঘটে ক্যাপিটল হিল হামলার ঘটনা। সারা দুনিয়া দেখল—গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা রাষ্ট্রটির গণতান্ত্রিক কাঠামোর অন্যতম মিনারকে আক্রান্ত হতে। সেখানকার এই এত এত নিরাপত্তা, প্রহরা এবং অত্যুজ্জ্বল সব উক্তি—কোনো কিছুই কিছু করতে পারল না। সব কেমন মিইয়ে গেল। গণতন্ত্রের তাবৎ গৌরব পথ ছেড়ে দিয়ে বিস্তার হতে দিল সহিংসতাকে। এই ঘটনা আদতে গোটা মার্কিন গণতন্ত্রের ভিতে থাকা গোপন ফাটলকে স্পষ্ট করে তুলল। ভেতরের ক্ষত এবং তাতে জমাট হওয়া এত দিনের পুঁজ সব প্রকাশ্যে চলে এল।
এই ঘটনা কি এক দিনে ঘটেছিল? না। সাদা কথায় বলতে গেলে অনেকেই হয়তো ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এর মূল হোতা হিসেবে সামনে হাজির করতে চাইবেন। ক্যাপিটলে হামলার কারণ হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরের ক্ষমতাকালকে অনেকে বেশ জোরের সঙ্গে সামনে হাজির করবেন। হ্যাঁ, মার্কিন গণতন্ত্র ও এর জোরে সারা দুনিয়ায় চালানো আধিপত্যের মুকুটের নিচে লুকানো প্যান্ডোরার এই বাক্সটি ডোনাল্ড ট্রাম্পই খুলেছিলেন। এটা সত্য, খুবই সত্য। কিন্তু এই কথা আরও যে সত্যকে সামনে আনে, তা হলো—মার্কিন সেই মুকুটের তলায় প্যান্ডোরার বাক্সটি আগে থেকেই ছিল। ট্রাম্প শুধু তার ঝাঁপটি খুলে দিয়েছেন।
ক্যাপিটলে হামলার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের কট্টর সমর্থকেরা নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁরা সব ভেঙেচুরে ক্যাপিটলে প্রবেশ করেছেন এবং ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। তারও আগে শার্লোৎসভিলে উগ্র শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীরা বর্ণবাদবিরোধী মিছিলে হামলা করেছিল। কিংবা জর্জ ফ্লয়েড হত্যার জেরে ছড়িয়ে পড়া ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের ওপর পুলিশ ও ট্রাম্প সমর্থকদের হামলা, বা বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইন নিয়ে চার বছরব্যাপী যে জলঘোলা, বা অভিবাসন নিয়ে বিশেষত আফ্রিকা ও মুসলিম দেশগুলোর অভিবাসীদের বিষয়ে ট্রাম্প জমানায় মার্কিন যে দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটেছিল, তা তো এই বিভাজনের সুদূর বিস্তৃত মূলটির সন্ধান দেয়। ট্রাম্পের কৃতিত্ব যদি কিছু থেকে থাকে, তবে তা এই ক্ষত, পুঁজ ও বিভাজনের মানচিত্রকে সবার বোধগম্য করে তোলা।
ডোনাল্ড ট্রাম্প সরাসরি ও ঘোষিত অর্থেই কট্টর, বর্ণবাদী ও একনায়কোচিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন এবং এত এত সমালোচনার পর তিনি তা-ই আছেন। কট্টর ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়ানোর দায়ে এবং দাঙ্গা উসকে দেওয়ার অভিযোগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টুইটার ও ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট নিষিদ্ধ হলে তাই ট্রাম্প নিজেই একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম করতে এগোন। হ্যাঁ, তিনি এখন ফেসবুক বা টুইটারের মাধ্যমে বা প্রেসিডেন্সিতে থাকার সময় প্রচলিত সংবাদমাধ্যম ব্যবহার করে যে উগ্র বক্তব্য দিতে পারতেন, তা দিতে পারছেন না। কিন্তু তাঁর মানসিক গঠনে তো কোনো পরিবর্তন আসেনি। না অস্ত্র প্রশ্নে, না অভিবাসী প্রশ্নে, না বাণিজ্য প্রশ্নে, না ইরান, মধ্যপ্রাচ্য, চীন বা অন্য কোনো প্রশ্নে। তফাৎ শুধু এই যে, তাঁর ভাষ্যটি আর আগের মতো প্রচারে আসছে না। ঠিক একইভাবে তাঁর বা তাঁর মতো ব্যক্তির মতবাদের সমর্থকদের ভাষ্যটিও আড়ালে পড়ে থাকছে।
এখন ট্রাম্পের মতো করে নিজের ভাষ্যটি প্রচারের সুযোগ ও সুবিধা পাচ্ছেন জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিস এবং তাঁদের অনুসারীরা। এর মানে এই নয় যে, অন্য ভাষ্যটি সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে। বরং বলা যায় অন্য ভাষ্যটি চাপা পড়ে থাকছে। ট্রাম্পের আগের ও ট্রাম্পের পরের যুক্তরাষ্ট্র আলাদা। ট্রাম্পের আগের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টরা কি রিপাবলিকান, কি ডেমোক্র্যাট, গণতন্ত্র এবং এর বহুল প্রচারিত ও বিজ্ঞাপিত বিভিন্ন মূল্যবোধের জয়গান গেয়ে আসছেন। এই সংগীতের সুর ও তাল একই। তফাত শুধু উচ্চতায়। ট্রাম্পের ক্ষেত্রে এসে এই সুর প্রথম বদলে গেল। তাঁর আগমন মুহূর্ত থেকেই ভিন্ন সুরের স্বাদ পেল মার্কিনরা। ফলে চাপা পড়া সেই মার্কিন ভাষ্য ক্রমে বেরিয়ে আসার একটা পথ খুঁজে বের করল। এই একই সুযোগ সামনে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন বার্নি স্যান্ডার্স। তাঁর শক্তিটিকে ডেমোক্র্যাটরা চিনতে পারেনি। আর ট্রাম্পকে ঠিকই চিনেছিল রিপাবলিকানরা। আর এই তফাতের কারণেই ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত মসনদ পেলেন, যা দিয়ে তিনি নিজের ঘরানার সুরকেই প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পান। কে না জানে শিল্প ও রাজনৈতিক ভাষ্যের যাত্রা ও গতিপথ একই; দুটিই পৃষ্ঠপোষকতা চায় এবং আনুকূল্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়।
সরকারি ভাষ্যের নির্মাণও একধরনের শিল্প বৈকি। ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে চাপা পড়া সেই মার্কিন ভাষ্যকে আশ্বস্ত করলেন, বললেন—প্রকাশ হও। ফলে এমনিতেই প্রকাশের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা, নতুন একটি ভাষ্যের জন্য উচাটন হওয়া যুদ্ধ-ক্লান্ত মার্কিনরা এটি লুফে নিল। এখন বলা হচ্ছে, বহু ছদ্ম-বামপন্থী ট্রাম্পের দলে ভিড়েছিলেন, বলা হচ্ছে ক্যাপিটল হামলার সঙ্গেও তাঁরা যুক্ত ছিলেন, বলা হচ্ছে এর মধ্য দিয়েই তাঁরা ‘বিপ্লব’ করতে চেয়েছিলেন। এর বিপরীতে জোরালো যুক্তি ও ভাষ্য থাকলেও সেদিকে না গিয়ে যদি পাল্টা প্রশ্ন করা হয়—এই ভেড়াটা কি ভুল ছিল? মার্কিন জনগণ কয়েক দশক ধরে নিজের দেশের কর্তাদের দেখেছে শুধু আধিপত্য বিস্তারের জন্য দেশে দেশে যুদ্ধ করে যেতে। তারা দেখেছে তাদের করের টাকা দিয়ে কেনা অস্ত্র বহন করে তাদেরই পাঠানো হচ্ছে ভিন দেশে প্রাণ দিতে। তারা দেখেছে ধনীদের আরও ধনী হওয়া। তারা দেখেছে নিম্নমধ্যবিত্তদের গৃহহীন হয়ে যাওয়া। নিজেদের তারা একসময় প্রান্তিক হিসেবে আবিষ্কার করেছে। ফলে এই গণতন্ত্র এবং তার জন্য নিবেদিত তাবৎ মূল্যবোধকে তাদের কাছে ঠুনকো মনে হওয়াটাই কি স্বাভাবিক নয়।
‘দ্য অ্যাসাসিনেশন অব রিচার্ড নিক্সন’ সিনেমায় প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ঘাতকের নির্মাণের এক দারুণ বয়ান হাজির করা হয়েছে। সেখানে দেখানো হয়েছে কী করে ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং এর প্রভাবে ওই ঘাতকের চাকরি হারানো, প্রেমিকার সঙ্গে বিচ্ছেদ, সংসারের সারহীনতায় ডুবে যাওয়া এবং প্রতি মুহূর্তে নিজের উপার্জনহীনতার জন্য নিজের অন্তঃসারশূন্যতাকেই সামনে আসতে দেখা একজন ব্যক্তি টিভিতে প্রচারিত সরকারি ভাষ্যে বারবার নিক্সনকে দেখে খেপে ওঠে। তার কাছে মনে হয় এই যে প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে দেওয়া শান্তি ও নিরাপত্তার ভাষ্য, গণতন্ত্র ও দেশোদ্ধারের ভাষ্য, এটিই আসলে তাঁর শত্রু। সে তখন এই ভাষ্যকেই হত্যা করতে চায়। নিক্সন সেখানে একটা অবয়ব মাত্র। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় বসা এবং সেই সূত্রে ঘটা নানা ঘটনা আদতে এই অবয়ব। ভেতরে থাকা বিভাজনটি তো আগে থেকেই ছিল। না হলে যেকোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এত সহজে ‘লাল’ ও ‘নীল’ অঙ্গরাজ্য কী করে আলাদা করা যায়। এই বিভাজন একটা ভদ্র পরিসরে ছিল। ভদ্রলোকি কোটের নিচে লুকানো এই বিভাজন ট্রাম্প শুধু প্রকাশ্যে এনেছেন। তিনি আবারও আসতে চান; ২০২৪ সালে। সে সম্ভাবনাও বিস্তর। কারণ, প্যান্ডোরার সেই বাক্স খুলে দেওয়ার পর এখন মার্কিনরা সরাসরি কথা বলছে। তারা বলছে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বা সেখানে টিকে থাকতে প্রয়োজনে আঘাত করা যেতে পারে। ১৭ শতাংশ মার্কিন বলছে, ক্যাপিটলে যা ঘটেছিল, তা ঠিক ছিল। সিবিএস/ইউগভের জরিপ বলছে, মার্কিন গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত বলে মনে করেন মাত্র ৩৩ শতাংশ লোক।
গত বছরের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটলে যে হামলা হয়েছিল, তা ছিল মার্কিন গণতান্ত্রিক যে আদর্শের কথা বলা হয়, তার ওপর। এটি কোনো সুনির্দিষ্ট ভবনের ওপর নয়। হামলাটি এসেছিল কট্টর ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলোর দিক থেকে। স্যান্ডার্সের পেছনে জমা হওয়া বামপন্থী যে তরুণ গোষ্ঠী, সেটি তখন অতি-উদারপন্থী ট্যাগ গায়ে নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের খারিজের খাতায়। ট্রাম্পকে গ্রহণের মধ্য দিয়ে রিপাবলিকান দল একটি কাজ অন্তত করতে পেরেছিল। তারা রক্ষণশীল থেকে শুরু করে কট্টর বা অতি কট্টর গোষ্ঠীগুলোকে বলতে পেরেছিল যে, কাঠামোটি দ্বিদলীয় হলেও তোমার ভাষ্যটি দেওয়ার সুযোগ থাকছে। ডেমোক্র্যাটরা এই জায়গাটিতেই সবচেয়ে বেশি ব্যর্থ। গত নির্বাচনে ট্রাম্প পরাজিত হয়েছেন বলে এটা ধরার কোনো কারণ নেই যে, যুক্তরাষ্ট্রে বিভাজনের রাজনীতি পরাজিত হয়েছে। বরং বাইডেনকে জিতিয়ে এনেছেই বিভাজনের রাজনীতি। ডেমোক্র্যাটরা উদারপন্থীদের একজোট করতে না পারলেও ট্রাম্প তাঁদের এক করে দিয়েছেন, যা বাইডেনকে শেষতক জয়ী করেছে। সামনে যে তিনি বা তাঁর মতো ব্যক্তি বিপরীত শিবিরকেই জয়ী করবে, তা কে বলতে পারে। সে ক্ষেত্রে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ার রয়্যাল রোডস বিশ্ববিদ্যালয়ের কাসকাডে ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক থমাস হোমার-ডিক্সনের সতর্কতাটি যুক্তরাষ্ট্র আমলে নিতে পারে। পরবর্তী গণতন্ত্রহীনতা ও স্বৈরশাসকের জন্য অপেক্ষা না করে, তা নিরোধে ভিন্নমতের দিকে তারা একটু তাকাতেই পারে।
ফজলুল কবির: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আরও পড়ুন:
গণতন্ত্র ফেরি করতে করতে ক্লান্ত যুক্তরাষ্ট্রের উর্দির ভেতরটা প্রকাশ হয়ে গিয়েছিল গত বছরের ৬ জানুয়ারি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং এ নিয়ে গোটা দুনিয়ার সচকিত চোখের সামনেই এদিন ঘটে ক্যাপিটল হিল হামলার ঘটনা। সারা দুনিয়া দেখল—গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা রাষ্ট্রটির গণতান্ত্রিক কাঠামোর অন্যতম মিনারকে আক্রান্ত হতে। সেখানকার এই এত এত নিরাপত্তা, প্রহরা এবং অত্যুজ্জ্বল সব উক্তি—কোনো কিছুই কিছু করতে পারল না। সব কেমন মিইয়ে গেল। গণতন্ত্রের তাবৎ গৌরব পথ ছেড়ে দিয়ে বিস্তার হতে দিল সহিংসতাকে। এই ঘটনা আদতে গোটা মার্কিন গণতন্ত্রের ভিতে থাকা গোপন ফাটলকে স্পষ্ট করে তুলল। ভেতরের ক্ষত এবং তাতে জমাট হওয়া এত দিনের পুঁজ সব প্রকাশ্যে চলে এল।
এই ঘটনা কি এক দিনে ঘটেছিল? না। সাদা কথায় বলতে গেলে অনেকেই হয়তো ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এর মূল হোতা হিসেবে সামনে হাজির করতে চাইবেন। ক্যাপিটলে হামলার কারণ হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরের ক্ষমতাকালকে অনেকে বেশ জোরের সঙ্গে সামনে হাজির করবেন। হ্যাঁ, মার্কিন গণতন্ত্র ও এর জোরে সারা দুনিয়ায় চালানো আধিপত্যের মুকুটের নিচে লুকানো প্যান্ডোরার এই বাক্সটি ডোনাল্ড ট্রাম্পই খুলেছিলেন। এটা সত্য, খুবই সত্য। কিন্তু এই কথা আরও যে সত্যকে সামনে আনে, তা হলো—মার্কিন সেই মুকুটের তলায় প্যান্ডোরার বাক্সটি আগে থেকেই ছিল। ট্রাম্প শুধু তার ঝাঁপটি খুলে দিয়েছেন।
ক্যাপিটলে হামলার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের কট্টর সমর্থকেরা নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁরা সব ভেঙেচুরে ক্যাপিটলে প্রবেশ করেছেন এবং ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। তারও আগে শার্লোৎসভিলে উগ্র শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীরা বর্ণবাদবিরোধী মিছিলে হামলা করেছিল। কিংবা জর্জ ফ্লয়েড হত্যার জেরে ছড়িয়ে পড়া ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের ওপর পুলিশ ও ট্রাম্প সমর্থকদের হামলা, বা বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইন নিয়ে চার বছরব্যাপী যে জলঘোলা, বা অভিবাসন নিয়ে বিশেষত আফ্রিকা ও মুসলিম দেশগুলোর অভিবাসীদের বিষয়ে ট্রাম্প জমানায় মার্কিন যে দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটেছিল, তা তো এই বিভাজনের সুদূর বিস্তৃত মূলটির সন্ধান দেয়। ট্রাম্পের কৃতিত্ব যদি কিছু থেকে থাকে, তবে তা এই ক্ষত, পুঁজ ও বিভাজনের মানচিত্রকে সবার বোধগম্য করে তোলা।
ডোনাল্ড ট্রাম্প সরাসরি ও ঘোষিত অর্থেই কট্টর, বর্ণবাদী ও একনায়কোচিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন এবং এত এত সমালোচনার পর তিনি তা-ই আছেন। কট্টর ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়ানোর দায়ে এবং দাঙ্গা উসকে দেওয়ার অভিযোগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টুইটার ও ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট নিষিদ্ধ হলে তাই ট্রাম্প নিজেই একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম করতে এগোন। হ্যাঁ, তিনি এখন ফেসবুক বা টুইটারের মাধ্যমে বা প্রেসিডেন্সিতে থাকার সময় প্রচলিত সংবাদমাধ্যম ব্যবহার করে যে উগ্র বক্তব্য দিতে পারতেন, তা দিতে পারছেন না। কিন্তু তাঁর মানসিক গঠনে তো কোনো পরিবর্তন আসেনি। না অস্ত্র প্রশ্নে, না অভিবাসী প্রশ্নে, না বাণিজ্য প্রশ্নে, না ইরান, মধ্যপ্রাচ্য, চীন বা অন্য কোনো প্রশ্নে। তফাৎ শুধু এই যে, তাঁর ভাষ্যটি আর আগের মতো প্রচারে আসছে না। ঠিক একইভাবে তাঁর বা তাঁর মতো ব্যক্তির মতবাদের সমর্থকদের ভাষ্যটিও আড়ালে পড়ে থাকছে।
এখন ট্রাম্পের মতো করে নিজের ভাষ্যটি প্রচারের সুযোগ ও সুবিধা পাচ্ছেন জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিস এবং তাঁদের অনুসারীরা। এর মানে এই নয় যে, অন্য ভাষ্যটি সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে। বরং বলা যায় অন্য ভাষ্যটি চাপা পড়ে থাকছে। ট্রাম্পের আগের ও ট্রাম্পের পরের যুক্তরাষ্ট্র আলাদা। ট্রাম্পের আগের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টরা কি রিপাবলিকান, কি ডেমোক্র্যাট, গণতন্ত্র এবং এর বহুল প্রচারিত ও বিজ্ঞাপিত বিভিন্ন মূল্যবোধের জয়গান গেয়ে আসছেন। এই সংগীতের সুর ও তাল একই। তফাত শুধু উচ্চতায়। ট্রাম্পের ক্ষেত্রে এসে এই সুর প্রথম বদলে গেল। তাঁর আগমন মুহূর্ত থেকেই ভিন্ন সুরের স্বাদ পেল মার্কিনরা। ফলে চাপা পড়া সেই মার্কিন ভাষ্য ক্রমে বেরিয়ে আসার একটা পথ খুঁজে বের করল। এই একই সুযোগ সামনে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন বার্নি স্যান্ডার্স। তাঁর শক্তিটিকে ডেমোক্র্যাটরা চিনতে পারেনি। আর ট্রাম্পকে ঠিকই চিনেছিল রিপাবলিকানরা। আর এই তফাতের কারণেই ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত মসনদ পেলেন, যা দিয়ে তিনি নিজের ঘরানার সুরকেই প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পান। কে না জানে শিল্প ও রাজনৈতিক ভাষ্যের যাত্রা ও গতিপথ একই; দুটিই পৃষ্ঠপোষকতা চায় এবং আনুকূল্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়।
সরকারি ভাষ্যের নির্মাণও একধরনের শিল্প বৈকি। ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে চাপা পড়া সেই মার্কিন ভাষ্যকে আশ্বস্ত করলেন, বললেন—প্রকাশ হও। ফলে এমনিতেই প্রকাশের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা, নতুন একটি ভাষ্যের জন্য উচাটন হওয়া যুদ্ধ-ক্লান্ত মার্কিনরা এটি লুফে নিল। এখন বলা হচ্ছে, বহু ছদ্ম-বামপন্থী ট্রাম্পের দলে ভিড়েছিলেন, বলা হচ্ছে ক্যাপিটল হামলার সঙ্গেও তাঁরা যুক্ত ছিলেন, বলা হচ্ছে এর মধ্য দিয়েই তাঁরা ‘বিপ্লব’ করতে চেয়েছিলেন। এর বিপরীতে জোরালো যুক্তি ও ভাষ্য থাকলেও সেদিকে না গিয়ে যদি পাল্টা প্রশ্ন করা হয়—এই ভেড়াটা কি ভুল ছিল? মার্কিন জনগণ কয়েক দশক ধরে নিজের দেশের কর্তাদের দেখেছে শুধু আধিপত্য বিস্তারের জন্য দেশে দেশে যুদ্ধ করে যেতে। তারা দেখেছে তাদের করের টাকা দিয়ে কেনা অস্ত্র বহন করে তাদেরই পাঠানো হচ্ছে ভিন দেশে প্রাণ দিতে। তারা দেখেছে ধনীদের আরও ধনী হওয়া। তারা দেখেছে নিম্নমধ্যবিত্তদের গৃহহীন হয়ে যাওয়া। নিজেদের তারা একসময় প্রান্তিক হিসেবে আবিষ্কার করেছে। ফলে এই গণতন্ত্র এবং তার জন্য নিবেদিত তাবৎ মূল্যবোধকে তাদের কাছে ঠুনকো মনে হওয়াটাই কি স্বাভাবিক নয়।
‘দ্য অ্যাসাসিনেশন অব রিচার্ড নিক্সন’ সিনেমায় প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ঘাতকের নির্মাণের এক দারুণ বয়ান হাজির করা হয়েছে। সেখানে দেখানো হয়েছে কী করে ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং এর প্রভাবে ওই ঘাতকের চাকরি হারানো, প্রেমিকার সঙ্গে বিচ্ছেদ, সংসারের সারহীনতায় ডুবে যাওয়া এবং প্রতি মুহূর্তে নিজের উপার্জনহীনতার জন্য নিজের অন্তঃসারশূন্যতাকেই সামনে আসতে দেখা একজন ব্যক্তি টিভিতে প্রচারিত সরকারি ভাষ্যে বারবার নিক্সনকে দেখে খেপে ওঠে। তার কাছে মনে হয় এই যে প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে দেওয়া শান্তি ও নিরাপত্তার ভাষ্য, গণতন্ত্র ও দেশোদ্ধারের ভাষ্য, এটিই আসলে তাঁর শত্রু। সে তখন এই ভাষ্যকেই হত্যা করতে চায়। নিক্সন সেখানে একটা অবয়ব মাত্র। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায় বসা এবং সেই সূত্রে ঘটা নানা ঘটনা আদতে এই অবয়ব। ভেতরে থাকা বিভাজনটি তো আগে থেকেই ছিল। না হলে যেকোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এত সহজে ‘লাল’ ও ‘নীল’ অঙ্গরাজ্য কী করে আলাদা করা যায়। এই বিভাজন একটা ভদ্র পরিসরে ছিল। ভদ্রলোকি কোটের নিচে লুকানো এই বিভাজন ট্রাম্প শুধু প্রকাশ্যে এনেছেন। তিনি আবারও আসতে চান; ২০২৪ সালে। সে সম্ভাবনাও বিস্তর। কারণ, প্যান্ডোরার সেই বাক্স খুলে দেওয়ার পর এখন মার্কিনরা সরাসরি কথা বলছে। তারা বলছে, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বা সেখানে টিকে থাকতে প্রয়োজনে আঘাত করা যেতে পারে। ১৭ শতাংশ মার্কিন বলছে, ক্যাপিটলে যা ঘটেছিল, তা ঠিক ছিল। সিবিএস/ইউগভের জরিপ বলছে, মার্কিন গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত বলে মনে করেন মাত্র ৩৩ শতাংশ লোক।
গত বছরের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটলে যে হামলা হয়েছিল, তা ছিল মার্কিন গণতান্ত্রিক যে আদর্শের কথা বলা হয়, তার ওপর। এটি কোনো সুনির্দিষ্ট ভবনের ওপর নয়। হামলাটি এসেছিল কট্টর ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলোর দিক থেকে। স্যান্ডার্সের পেছনে জমা হওয়া বামপন্থী যে তরুণ গোষ্ঠী, সেটি তখন অতি-উদারপন্থী ট্যাগ গায়ে নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের খারিজের খাতায়। ট্রাম্পকে গ্রহণের মধ্য দিয়ে রিপাবলিকান দল একটি কাজ অন্তত করতে পেরেছিল। তারা রক্ষণশীল থেকে শুরু করে কট্টর বা অতি কট্টর গোষ্ঠীগুলোকে বলতে পেরেছিল যে, কাঠামোটি দ্বিদলীয় হলেও তোমার ভাষ্যটি দেওয়ার সুযোগ থাকছে। ডেমোক্র্যাটরা এই জায়গাটিতেই সবচেয়ে বেশি ব্যর্থ। গত নির্বাচনে ট্রাম্প পরাজিত হয়েছেন বলে এটা ধরার কোনো কারণ নেই যে, যুক্তরাষ্ট্রে বিভাজনের রাজনীতি পরাজিত হয়েছে। বরং বাইডেনকে জিতিয়ে এনেছেই বিভাজনের রাজনীতি। ডেমোক্র্যাটরা উদারপন্থীদের একজোট করতে না পারলেও ট্রাম্প তাঁদের এক করে দিয়েছেন, যা বাইডেনকে শেষতক জয়ী করেছে। সামনে যে তিনি বা তাঁর মতো ব্যক্তি বিপরীত শিবিরকেই জয়ী করবে, তা কে বলতে পারে। সে ক্ষেত্রে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়ার রয়্যাল রোডস বিশ্ববিদ্যালয়ের কাসকাডে ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক থমাস হোমার-ডিক্সনের সতর্কতাটি যুক্তরাষ্ট্র আমলে নিতে পারে। পরবর্তী গণতন্ত্রহীনতা ও স্বৈরশাসকের জন্য অপেক্ষা না করে, তা নিরোধে ভিন্নমতের দিকে তারা একটু তাকাতেই পারে।
ফজলুল কবির: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আরও পড়ুন:
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৪ দিন আগে