হাসান মামুন
গত বছরও এপ্রিলে বেশ গরম পড়েছিল; বইছিল তাপপ্রবাহ। এবারও এপ্রিলের মধ্যভাগ থেকে পরিস্থিতি খারাপ। এরই মধ্যে রাজধানীসহ ১২টি জেলায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করেছে। চুয়াডাঙ্গা ও যশোরে এ নিবন্ধ লেখার দিন এটা ছাড়িয়ে গেছে ৪২ ডিগ্রি।গত বছরের ১৭ এপ্রিল ঈশ্বরদীতে তাপমাত্রা পৌঁছেছিল ৪৩ ডিগ্রিতে। আবহাওয়া বিভাগ বলছে, এবার তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে।
প্রিলের বাকি সময়ে পরিস্থিতির উন্নতির বদলে অবনতির শঙ্কাই বেশি। তবে সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের অনেক এলাকায় তাপমাত্রা অসহনীয় নয় এখনো। কোথাও কোথাও বৃষ্টি আর কালবৈশাখীর পূর্বাভাসও রয়েছে। তবে প্রায় দেশজুড়ে ভারী বৃষ্টি না হলে মাঝারি থেকে তীব্র এবং কোনো কোনো অঞ্চলে অতি তীব্র হয়ে ওঠা তাপপ্রবাহ কমবে বলে মনে করা যাচ্ছে না।
ঈদেও আবহাওয়া অনুকূলে ছিল না। এরই মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষ রাজধানীসহ বড় বড় শহর থেকে গ্রামের বাড়ি গেছে। বেড়াতেও গেছে পর্যটন স্পটগুলোয়। নববর্ষ যুক্ত হওয়ায় এবার দীর্ঘ ছুটি পেয়েছে মানুষ। সাধ্যমতো কেনাকাটা করেছে। আরও বেশি গরমের মধ্যে নববর্ষ পালন করেছে মানুষ উৎসাহভরে। সেদিন রাঙামাটিতে তাপমাত্রা ওঠে ৪০ ডিগ্রিতে। তাতেও ওই পার্বত্য জেলায় ‘বৈসাবি’ পালনে উৎসাহের ঘাটতি হয়নি। রাজধানী থেকেও অনেকে গিয়ে এই উৎসবে যোগ দিয়েছে যথারীতি। প্রতিকূল আবহাওয়া আমাদের কখনো পুরোপুরি দমাতে পারেনি। তবে কষ্ট তো হয়েই থাকে।
সময়ে-সময়ে আবহাওয়া অত্যন্ত বিরূপ হয়ে উঠছে, যেটাকে বলে ‘চরম ভাবাপন্ন’। এটা কেবল এ দেশে নয়; এই অঞ্চলে এবং পৃথিবীর আরও কিছু অংশে। এর কারণ নিয়ে হচ্ছে গবেষণা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেই আবহাওয়া বিশেষ প্রতিকূল হয়ে উঠছে বলে ব্যাপকভাবে মনে করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও অদৃষ্টপূর্ব দুর্যোগ নেমে আসার ঘটনাও ঘটছে। সম্প্রতি দুবাই শহর ডুবে যায় বিরল অতিবর্ষণে। একই সময়ে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে প্রবল বন্যা, ভূমিধসে শতাধিক মানুষ মারা গেছে। ফসল, সড়ক অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মৃত্যু ঘটেছে অনেক গবাদিপশুর।
বাংলাদেশে চলমান তাপপ্রবাহও একধরনের দুর্যোগ নিয়ে এসেছে জনজীবনে। গত ক’বছরের অভিজ্ঞতায় মনে হচ্ছে, এটা স্বল্পমেয়াদি হবে না। অন্তত চলতি অর্থবছরের বাকি দুই মাসেও থেকে থেকে তাপপ্রবাহ মোকাবিলা করেই চলতে হবে আমাদের। আবহাওয়াবিদেরা তেমনটাই বলছেন।
অত্যধিক গরম ও তাপপ্রবাহে প্রথমত জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটে থাকে। এর চাপ গিয়ে পড়ে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয়; বিশেষ করে গরমজনিত জটিলতায় আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকেরা হাজির হন হাসপাতালে। দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের এমন পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি থাকার কথা। ভালো যে তাদের একেবারে অপ্রস্তুত মনে হচ্ছে না। তাপপ্রবাহ চলাকালে প্রাপ্তবয়স্করাও ‘হিট স্ট্রোকে’ আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এরই মধ্যে কমপক্ষে তিনজন এতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে সতর্ক থাকলে এটা কিন্তু এড়ানো যেতে পারে। দেরিতে হলেও এ-বিষয়ক নির্দেশনা প্রচারিত হচ্ছে। মিডিয়া এ ক্ষেত্রে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। গত বছরও তাপপ্রবাহ, এর প্রভাব ইত্যাদি নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছিল মিডিয়ায়। এবার সেটা আরও গভীরে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।
দুপুরের দিকে তাপমাত্রা যখন বেশি থাকে এবং আকাশ থেকে সূর্য ঢালতে থাকে আগুন, তখন ঘরের বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সমস্যা হলো, দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষকে এই পরিস্থিতিতেও বাইরে যেতে হয় উপার্জন করতে। খোলা আকাশের নিচেই কাজ করতে হয় অনেককে। যেমন কৃষি ও নির্মাণশ্রমিকদের। হাওরাঞ্চলে এরই মধ্যে বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। আগাম বন্যা বা অন্য কোনো কারণে তাঁদের ফসল নষ্ট হয়নি এবার। বেশি জমিতে আবাদ হয়েছে; ফলনও নাকি ভালো। এই গরমেও তাঁরা প্রয়োজনে কৃষিশ্রমিক নিয়োগ দিয়ে ঘরে ফসল তুলছেন। তাপপ্রবাহ বেশি প্রতিকূল হলে সেখানে যান্ত্রিকভাবে ধান উত্তোলনের ব্যবস্থা করতে হবে।
ব্যবসাবিষয়ক একটি সংবাদপত্রে হাওরে ‘কম্বাইন হারভেস্টার’ ব্যবহার শুরুর খবর দেওয়া হয়েছে। যা হোক, ধান উত্তোলনসহ কৃষিকাজে নিয়োজিত সবাইকে কার্যকরভাবে সতর্ক করতে হবে এমন তাপপ্রবাহে বেশি ঝুঁকি না নেওয়ার। হিট স্ট্রোকে মারা যাওয়া একজন জমিতে কাজ করার সময়ই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বলে জানা যাচ্ছে।
সরকার প্রত্যাশা অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দিনক্ষণ পিছিয়েছে। ঘরেও, বিশেষ করে শিশুদের দিকে খেয়াল রাখতে হবে, যেন গরমে অসুস্থ হয়ে না পড়ে। প্রবীণ ও আগে থেকে রোগাক্রান্তরা এমন পরিস্থিতিতে নাজুক জনগোষ্ঠী হয়ে ওঠে। তাদের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে এক একটি পরিবারে নেমে আসে বিপর্যয়। কারও অসুস্থতা মানেই আবার হঠাৎ করে অর্থ ব্যয়। অনেকেরই এর প্রস্তুতি থাকে না।
এটা একই সঙ্গে ইনফ্লুয়েঞ্জারও সময়। গত বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত খারাপ। বহু মানুষ মারা গেছে এই প্রতিরোধযোগ্য রোগে।এটা ঘিরে বহু পরিবারে নেমে আসে দুর্যোগ; হয় বিপুল অর্থ ব্যয়। এবারও এই তাপপ্রবাহের মধ্যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপের দিকে মোড় নিচ্ছে। সময় ও সুযোগ থাকতে সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া না হলে পরিস্থিতি বিপজ্জনক হতে পারে।
অর্থবছরের শেষ সময়ে এডিপির আওতাধীন প্রকল্পগুলো পুরোদমে বাস্তবায়নের সময় এখন। দেশে তাপপ্রবাহ চলতে থাকলে এটি অবশ্য ব্যাহত হবে। অর্থবছরের শুরুতে ক’মাস বৃষ্টিবাদলে এডিপির বাস্তবায়ন ব্যাহত হয়। এখন শেষ সময়ে তাপপ্রবাহে এর বাস্তবায়ন, বিশেষ করে নির্মাণ ও উন্নয়নকাজ বিঘ্নিত হলে তাতে কর্মসংস্থান কমবে।
প্রবৃদ্ধিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চলতি মাসে গরমের মধ্যে দু-দুটি উৎসবে অর্থনীতি চাঙা হয়ে ওঠাটা অবশ্য এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক। এতে মূল্যস্ফীতি আবার কিছুটা বাড়ার কথা। এটা থেকে আমাদের রেহাই নেই আরও অনেক দিন; বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ এক বছরের বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধকল সইছে। তাপপ্রবাহে তাদের একাংশও যদি ঠিকমতো কাজ করতে না পারে; অসুস্থ থাকে, উৎপাদনশীলতা ও আয় হারায়, তাহলে পরিস্থিতি হয়ে উঠবে আরও খারাপ। এ প্রসঙ্গে রিকশাচালক ও দিনমজুরদের কথা স্মরণ করা যায়।
গার্মেন্টসের মতো খাতে যাঁরা নিয়োজিত, তাঁদের উৎপাদনশীলতাও কি কমবে তাপপ্রবাহে? এ খাতে কাজের পরিবেশ অপেক্ষাকৃত ভালো হয়েছে মর্মন্তুদ ঘটনাবলি ঘটার পর, প্রধানত বিদেশি ক্রেতাদের চাপে। চলমান তাপপ্রবাহে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এর মালিকপক্ষকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। বিজিএমইএকে নিতে হবে সক্রিয় ভূমিকা। ঈদের আগে অনেক প্রতিষ্ঠান মার্চের বেতন না দিয়ে কেবল বোনাস দিতে পেরেছিল। তাপপ্রবাহে তারা যেন শ্রমিকদের কাজের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে। সেটা পারা উচিত অন্যান্য শিল্প খাতেও। তবে এখনো বেশির ভাগ মানুষ নিয়োজিত অনানুষ্ঠানিক খাতে। রাস্তা আর ফুটপাতে আত্মকর্মসংস্থানেও অনেকে নিয়োজিত। দীর্ঘমেয়াদি তাপপ্রবাহে তাঁদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর ক্ষতিপূরণ দেবে কে?
ঈদের পর পণ্য সরবরাহব্যবস্থা সচল হওয়ার আগেই শুরু হলো তাপপ্রবাহ। নতুন করে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে এর অবদান থাকতে পারে। তাপপ্রবাহে পণ্য সংরক্ষণেও সৃষ্টি হয় চ্যালেঞ্জ। স্বাভাবিকের অধিক তাপমাত্রায় ওষুধের গুণমান হারানোর কথা বিবেচনায় নিতে হবে আমাদের। প্রচণ্ড গরমে পোলট্রি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবরও রয়েছে।
ডিমের উৎপাদন নাকি ব্যাহত। কোরবানির হাটে তোলার জন্য গরু পালনে নিয়োজিতদের কী অবস্থা এখন? রাজধানীর বাইরে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সুবিধাজনক নয় বলেই জানা যাচ্ছে। এ কারণে চার্জার ফ্যান ও আইপিএস কেনার প্রবণতা বেড়েছে মফস্বলে। দেশজুড়ে এসি বিক্রিও বেড়ে গেছে। অত্যধিক এসি ব্যবহারের কারণেও কিন্তু শহরাঞ্চলে তাপপ্রবাহ কমছে না। রাজধানীসহ শহরগুলো হয়ে উঠছে ‘হিট আইল্যান্ড’!
তাপপ্রবাহে বোরোর ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেওয়া যাবে না। এটা আমাদের প্রধান ফসল। আম, লিচুচাষিরাও উদ্বিগ্ন। সেচের অভাব কিংবা পরিচর্যার দুর্বলতায় ফল-ফসল উৎপাদন ব্যাহত হলে গ্রাম ও শহরের সব শ্রেণির মানুষকেই কমবেশি মাশুল গুনতে হবে। তাপপ্রবাহ কিংবা আবহাওয়ার বিচিত্র আচরণে খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কোনো অঞ্চলে ফলন মার খেলে সেটা কিন্তু বড় দুঃসংবাদ হয়ে ওঠে খোদ বিশ্ববাজারে।
এর প্রভাবে ওই জরুরি পণ্যের দাম বেড়ে যায়। তাই দৃষ্টি রাখতে হয় দেশের বাইরেও। এই বাস্তবতা এটা অনুধাবনের দিকেও আমাদের নিয়ে যায় যে আবহাওয়ার কোনো সীমান্ত নেই এবং আমরা সবাই একটা অখণ্ড গ্রহের মধ্যে আছি। এ অবস্থায় নিজ নিজ দেশেও তাপপ্রবাহ বা এমন কোনো বিরূপ পরিস্থিতিতে জীবনকে স্বাভাবিক ধারায় রাখতে সচেষ্ট থাকতে হবে; বিশেষ করে যারা এর অসহায় শিকার হয়ে পড়ছে, তাদের পাশে দাঁড়াতে যথাসম্ভব প্রস্তুত রাখতে হবে রাষ্ট্রকে।
লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
গত বছরও এপ্রিলে বেশ গরম পড়েছিল; বইছিল তাপপ্রবাহ। এবারও এপ্রিলের মধ্যভাগ থেকে পরিস্থিতি খারাপ। এরই মধ্যে রাজধানীসহ ১২টি জেলায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করেছে। চুয়াডাঙ্গা ও যশোরে এ নিবন্ধ লেখার দিন এটা ছাড়িয়ে গেছে ৪২ ডিগ্রি।গত বছরের ১৭ এপ্রিল ঈশ্বরদীতে তাপমাত্রা পৌঁছেছিল ৪৩ ডিগ্রিতে। আবহাওয়া বিভাগ বলছে, এবার তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে।
প্রিলের বাকি সময়ে পরিস্থিতির উন্নতির বদলে অবনতির শঙ্কাই বেশি। তবে সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের অনেক এলাকায় তাপমাত্রা অসহনীয় নয় এখনো। কোথাও কোথাও বৃষ্টি আর কালবৈশাখীর পূর্বাভাসও রয়েছে। তবে প্রায় দেশজুড়ে ভারী বৃষ্টি না হলে মাঝারি থেকে তীব্র এবং কোনো কোনো অঞ্চলে অতি তীব্র হয়ে ওঠা তাপপ্রবাহ কমবে বলে মনে করা যাচ্ছে না।
ঈদেও আবহাওয়া অনুকূলে ছিল না। এরই মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষ রাজধানীসহ বড় বড় শহর থেকে গ্রামের বাড়ি গেছে। বেড়াতেও গেছে পর্যটন স্পটগুলোয়। নববর্ষ যুক্ত হওয়ায় এবার দীর্ঘ ছুটি পেয়েছে মানুষ। সাধ্যমতো কেনাকাটা করেছে। আরও বেশি গরমের মধ্যে নববর্ষ পালন করেছে মানুষ উৎসাহভরে। সেদিন রাঙামাটিতে তাপমাত্রা ওঠে ৪০ ডিগ্রিতে। তাতেও ওই পার্বত্য জেলায় ‘বৈসাবি’ পালনে উৎসাহের ঘাটতি হয়নি। রাজধানী থেকেও অনেকে গিয়ে এই উৎসবে যোগ দিয়েছে যথারীতি। প্রতিকূল আবহাওয়া আমাদের কখনো পুরোপুরি দমাতে পারেনি। তবে কষ্ট তো হয়েই থাকে।
সময়ে-সময়ে আবহাওয়া অত্যন্ত বিরূপ হয়ে উঠছে, যেটাকে বলে ‘চরম ভাবাপন্ন’। এটা কেবল এ দেশে নয়; এই অঞ্চলে এবং পৃথিবীর আরও কিছু অংশে। এর কারণ নিয়ে হচ্ছে গবেষণা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেই আবহাওয়া বিশেষ প্রতিকূল হয়ে উঠছে বলে ব্যাপকভাবে মনে করা হচ্ছে। কোথাও কোথাও অদৃষ্টপূর্ব দুর্যোগ নেমে আসার ঘটনাও ঘটছে। সম্প্রতি দুবাই শহর ডুবে যায় বিরল অতিবর্ষণে। একই সময়ে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে প্রবল বন্যা, ভূমিধসে শতাধিক মানুষ মারা গেছে। ফসল, সড়ক অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মৃত্যু ঘটেছে অনেক গবাদিপশুর।
বাংলাদেশে চলমান তাপপ্রবাহও একধরনের দুর্যোগ নিয়ে এসেছে জনজীবনে। গত ক’বছরের অভিজ্ঞতায় মনে হচ্ছে, এটা স্বল্পমেয়াদি হবে না। অন্তত চলতি অর্থবছরের বাকি দুই মাসেও থেকে থেকে তাপপ্রবাহ মোকাবিলা করেই চলতে হবে আমাদের। আবহাওয়াবিদেরা তেমনটাই বলছেন।
অত্যধিক গরম ও তাপপ্রবাহে প্রথমত জনস্বাস্থ্য পরিস্থিতির অবনতি ঘটে থাকে। এর চাপ গিয়ে পড়ে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয়; বিশেষ করে গরমজনিত জটিলতায় আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকেরা হাজির হন হাসপাতালে। দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের এমন পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি থাকার কথা। ভালো যে তাদের একেবারে অপ্রস্তুত মনে হচ্ছে না। তাপপ্রবাহ চলাকালে প্রাপ্তবয়স্করাও ‘হিট স্ট্রোকে’ আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এরই মধ্যে কমপক্ষে তিনজন এতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে সতর্ক থাকলে এটা কিন্তু এড়ানো যেতে পারে। দেরিতে হলেও এ-বিষয়ক নির্দেশনা প্রচারিত হচ্ছে। মিডিয়া এ ক্ষেত্রে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। গত বছরও তাপপ্রবাহ, এর প্রভাব ইত্যাদি নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছিল মিডিয়ায়। এবার সেটা আরও গভীরে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।
দুপুরের দিকে তাপমাত্রা যখন বেশি থাকে এবং আকাশ থেকে সূর্য ঢালতে থাকে আগুন, তখন ঘরের বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। সমস্যা হলো, দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষকে এই পরিস্থিতিতেও বাইরে যেতে হয় উপার্জন করতে। খোলা আকাশের নিচেই কাজ করতে হয় অনেককে। যেমন কৃষি ও নির্মাণশ্রমিকদের। হাওরাঞ্চলে এরই মধ্যে বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। আগাম বন্যা বা অন্য কোনো কারণে তাঁদের ফসল নষ্ট হয়নি এবার। বেশি জমিতে আবাদ হয়েছে; ফলনও নাকি ভালো। এই গরমেও তাঁরা প্রয়োজনে কৃষিশ্রমিক নিয়োগ দিয়ে ঘরে ফসল তুলছেন। তাপপ্রবাহ বেশি প্রতিকূল হলে সেখানে যান্ত্রিকভাবে ধান উত্তোলনের ব্যবস্থা করতে হবে।
ব্যবসাবিষয়ক একটি সংবাদপত্রে হাওরে ‘কম্বাইন হারভেস্টার’ ব্যবহার শুরুর খবর দেওয়া হয়েছে। যা হোক, ধান উত্তোলনসহ কৃষিকাজে নিয়োজিত সবাইকে কার্যকরভাবে সতর্ক করতে হবে এমন তাপপ্রবাহে বেশি ঝুঁকি না নেওয়ার। হিট স্ট্রোকে মারা যাওয়া একজন জমিতে কাজ করার সময়ই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বলে জানা যাচ্ছে।
সরকার প্রত্যাশা অনুযায়ী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দিনক্ষণ পিছিয়েছে। ঘরেও, বিশেষ করে শিশুদের দিকে খেয়াল রাখতে হবে, যেন গরমে অসুস্থ হয়ে না পড়ে। প্রবীণ ও আগে থেকে রোগাক্রান্তরা এমন পরিস্থিতিতে নাজুক জনগোষ্ঠী হয়ে ওঠে। তাদের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে এক একটি পরিবারে নেমে আসে বিপর্যয়। কারও অসুস্থতা মানেই আবার হঠাৎ করে অর্থ ব্যয়। অনেকেরই এর প্রস্তুতি থাকে না।
এটা একই সঙ্গে ইনফ্লুয়েঞ্জারও সময়। গত বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত খারাপ। বহু মানুষ মারা গেছে এই প্রতিরোধযোগ্য রোগে।এটা ঘিরে বহু পরিবারে নেমে আসে দুর্যোগ; হয় বিপুল অর্থ ব্যয়। এবারও এই তাপপ্রবাহের মধ্যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপের দিকে মোড় নিচ্ছে। সময় ও সুযোগ থাকতে সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া না হলে পরিস্থিতি বিপজ্জনক হতে পারে।
অর্থবছরের শেষ সময়ে এডিপির আওতাধীন প্রকল্পগুলো পুরোদমে বাস্তবায়নের সময় এখন। দেশে তাপপ্রবাহ চলতে থাকলে এটি অবশ্য ব্যাহত হবে। অর্থবছরের শুরুতে ক’মাস বৃষ্টিবাদলে এডিপির বাস্তবায়ন ব্যাহত হয়। এখন শেষ সময়ে তাপপ্রবাহে এর বাস্তবায়ন, বিশেষ করে নির্মাণ ও উন্নয়নকাজ বিঘ্নিত হলে তাতে কর্মসংস্থান কমবে।
প্রবৃদ্ধিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। চলতি মাসে গরমের মধ্যে দু-দুটি উৎসবে অর্থনীতি চাঙা হয়ে ওঠাটা অবশ্য এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক। এতে মূল্যস্ফীতি আবার কিছুটা বাড়ার কথা। এটা থেকে আমাদের রেহাই নেই আরও অনেক দিন; বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ এক বছরের বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধকল সইছে। তাপপ্রবাহে তাদের একাংশও যদি ঠিকমতো কাজ করতে না পারে; অসুস্থ থাকে, উৎপাদনশীলতা ও আয় হারায়, তাহলে পরিস্থিতি হয়ে উঠবে আরও খারাপ। এ প্রসঙ্গে রিকশাচালক ও দিনমজুরদের কথা স্মরণ করা যায়।
গার্মেন্টসের মতো খাতে যাঁরা নিয়োজিত, তাঁদের উৎপাদনশীলতাও কি কমবে তাপপ্রবাহে? এ খাতে কাজের পরিবেশ অপেক্ষাকৃত ভালো হয়েছে মর্মন্তুদ ঘটনাবলি ঘটার পর, প্রধানত বিদেশি ক্রেতাদের চাপে। চলমান তাপপ্রবাহে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এর মালিকপক্ষকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। বিজিএমইএকে নিতে হবে সক্রিয় ভূমিকা। ঈদের আগে অনেক প্রতিষ্ঠান মার্চের বেতন না দিয়ে কেবল বোনাস দিতে পেরেছিল। তাপপ্রবাহে তারা যেন শ্রমিকদের কাজের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে। সেটা পারা উচিত অন্যান্য শিল্প খাতেও। তবে এখনো বেশির ভাগ মানুষ নিয়োজিত অনানুষ্ঠানিক খাতে। রাস্তা আর ফুটপাতে আত্মকর্মসংস্থানেও অনেকে নিয়োজিত। দীর্ঘমেয়াদি তাপপ্রবাহে তাঁদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর ক্ষতিপূরণ দেবে কে?
ঈদের পর পণ্য সরবরাহব্যবস্থা সচল হওয়ার আগেই শুরু হলো তাপপ্রবাহ। নতুন করে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে এর অবদান থাকতে পারে। তাপপ্রবাহে পণ্য সংরক্ষণেও সৃষ্টি হয় চ্যালেঞ্জ। স্বাভাবিকের অধিক তাপমাত্রায় ওষুধের গুণমান হারানোর কথা বিবেচনায় নিতে হবে আমাদের। প্রচণ্ড গরমে পোলট্রি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবরও রয়েছে।
ডিমের উৎপাদন নাকি ব্যাহত। কোরবানির হাটে তোলার জন্য গরু পালনে নিয়োজিতদের কী অবস্থা এখন? রাজধানীর বাইরে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি সুবিধাজনক নয় বলেই জানা যাচ্ছে। এ কারণে চার্জার ফ্যান ও আইপিএস কেনার প্রবণতা বেড়েছে মফস্বলে। দেশজুড়ে এসি বিক্রিও বেড়ে গেছে। অত্যধিক এসি ব্যবহারের কারণেও কিন্তু শহরাঞ্চলে তাপপ্রবাহ কমছে না। রাজধানীসহ শহরগুলো হয়ে উঠছে ‘হিট আইল্যান্ড’!
তাপপ্রবাহে বোরোর ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেওয়া যাবে না। এটা আমাদের প্রধান ফসল। আম, লিচুচাষিরাও উদ্বিগ্ন। সেচের অভাব কিংবা পরিচর্যার দুর্বলতায় ফল-ফসল উৎপাদন ব্যাহত হলে গ্রাম ও শহরের সব শ্রেণির মানুষকেই কমবেশি মাশুল গুনতে হবে। তাপপ্রবাহ কিংবা আবহাওয়ার বিচিত্র আচরণে খাদ্যশস্য উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কোনো অঞ্চলে ফলন মার খেলে সেটা কিন্তু বড় দুঃসংবাদ হয়ে ওঠে খোদ বিশ্ববাজারে।
এর প্রভাবে ওই জরুরি পণ্যের দাম বেড়ে যায়। তাই দৃষ্টি রাখতে হয় দেশের বাইরেও। এই বাস্তবতা এটা অনুধাবনের দিকেও আমাদের নিয়ে যায় যে আবহাওয়ার কোনো সীমান্ত নেই এবং আমরা সবাই একটা অখণ্ড গ্রহের মধ্যে আছি। এ অবস্থায় নিজ নিজ দেশেও তাপপ্রবাহ বা এমন কোনো বিরূপ পরিস্থিতিতে জীবনকে স্বাভাবিক ধারায় রাখতে সচেষ্ট থাকতে হবে; বিশেষ করে যারা এর অসহায় শিকার হয়ে পড়ছে, তাদের পাশে দাঁড়াতে যথাসম্ভব প্রস্তুত রাখতে হবে রাষ্ট্রকে।
লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে