মযহারুল ইসলাম বাবলা
বাংলাদেশে বেশির ভাগ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। অন্য ভাষার মানুষও কিছু আছে। তবে এই সংখ্যা খুব কম। তাই রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে বিকল্প ভাষার প্রয়োজন পড়ে না। অথচ প্রতিবেশী ভারতে এটা কল্পনাও করা যায় না। কারণ, ভারতে বহু ভাষীর মানুষের বাস।পশ্চিমবঙ্গের অনেক বাঙালি এ নিয়ে তাদের আক্ষেপের কথা গোপন করে না। এমনও বলা হয়, ভিন্ন প্রদেশে তো পরের কথা, নিজেদের প্রদেশেও বাংলা ভাষায় একচেটিয়া কথা বলার উপায় তাদের নেই। গোটা ভারতে ২২টি স্বীকৃত ভাষা রয়েছে। এ ছাড়া অস্বীকৃত আঞ্চলিক ভাষা তো গুনে শেষ করা যাবে না। ইউরোপ মহাদেশের সঙ্গে এ ক্ষেত্রে ভারতকে তুলনা করা যায়। ইউরোপের প্রতিটি দেশের যেমন ভিন্ন ভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতি, ঠিক তেমনি ভারতের প্রতিটি প্রদেশের ভাষা-সংস্কৃতির ভিন্ন ভিন্ন রূপ রয়েছে। স্বকীয় ও স্বাতন্ত্র্যে কোনোটির সঙ্গে কোনোটির মিল নেই।
রয়েছে ব্যাপক ভিন্নতা। ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দি নয়, হিন্দি সরকারি ভাষা।ভারতের সাংবিধানিক ভাষা আইনে হিন্দিকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার ফলে অহিন্দিভাষীদের আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলন সামাল দিতে সরকার অহিন্দি প্রদেশগুলোতে সরকারি ভাষা হিসেবে পূর্ববৎ ইংরেজি ভাষাকে বহাল রাখতে বাধ্য হয়। হিন্দি ভাষাবিরোধী ওই আন্দোলন সহিংস রূপ ধারণ করেছিল। পট্টি শ্রীরামালুর আত্মদহনসহ অসংখ্য সম্পদের ক্ষতি সাধিত হয়েছিল।
এ ছাড়া বিহার, উত্তর প্রদেশে উর্দু ভাষাকে দ্বিতীয় সরকারি ভাষা ঘোষণায়, ভাষাভিত্তিক প্রদেশগুলোর সীমানা নির্ধারণে, প্রদেশের সংখ্যালঘু ভাষীদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানে বাধা প্রদান, ওডিশার বাঙালিদের দ্বারা উৎকলবাসীদের শোষণ-বঞ্চনা ইত্যাদি নিয়েও বিক্ষোভ ও হানাহানির ঘটনা ঘটেছিল। পুরুলিয়া জেলা বিহার রাজ্যে যুক্ত থাকায় বিহার সরকার প্রদেশের একমাত্র ভাষা হিন্দির ঘোষণায় বাঙালি-অধ্যুষিত পুরুলিয়ায় বাংলা ভাষার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে। অবশেষে বিহার থেকে পুরুলিয়াকে পশ্চিমবঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়।
কংগ্রেস সরকার অসমিয়া জাত্যভিমানকে রাজনৈতিক স্বার্থের পক্ষে টানতে ১৯৬১ সালে বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলনকারীদের সশস্ত্র পন্থায় দমন করেছিল। আসামের ভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ১১ জন বাঙালি প্রাণ হারিয়েছিল। ভারতে জাতীয়তার প্রশ্নটি মীমাংসিত না হওয়ার ফলে মাঝে মাঝেই সংকট মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
প্রতিটি জাতির মাতৃভাষা সেখানে আঞ্চলিক ভাষার মর্যাদায়। আমাদের মাতৃভাষাকেই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি।ভারতীয়দের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি। সরকারি হিন্দি ভাষা কিন্তু সব প্রদেশে সরকারি ভাষার মর্যাদায় নেই। দক্ষিণের পাঁচ প্রদেশের প্রাদেশিক ভাষার একমাত্র বিকল্প ভাষা ইংরেজি। দক্ষিণ ভারতের পাঁচ রাজ্য যথাক্রমে তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্র, কেরালা ও কর্ণাটক।
এই পাঁচ রাজ্য নিয়েই দক্ষিণ ভারত। দক্ষিণের তামিল, তেলুগু, মালায়লাম, কন্নড় ভাষার কোনোটির সঙ্গে কোনোটির সাদৃশ্য নেই। না বর্ণমালায়, না শব্দে। দক্ষিণ ভারতীয়রা সচেতনভাবে সরকারি হিন্দি ভাষাবিদ্বেষী। হিন্দির প্রতি তাদের রয়েছে অবজ্ঞা। তাদের অভিযোগ, ভারতের সব আঞ্চলিক ভাষার মতো হিন্দিও আঞ্চলিক ভাষা। হিন্দিভাষী ভারতীয় রাজনীতিকেরা সংবিধান সভায় ভোটাভুটির কৌশলতায় হিন্দি ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ অহিন্দিভাষী জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন। এই চাপাচাপি দক্ষিণসহ অহিন্দিভাষী প্রদেশ গ্রহণ করেনি। সচেতনভাবে হিন্দি ভাষাকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
স্বাধীন ভারতের ভাষা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যটি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে শান্তিনিকেতনে মতবিনিময় সভায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, স্বাধীন ভারতে প্রাদেশিক ভাষাগুলো অপরিবর্তিত থাকবে। এখন যেমন রয়েছে, ঠিক তেমনি। তবে রাষ্ট্রভাষা হতে হবে ইংরেজি। ওই বৈঠকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও উপস্থিত ছিলেন। হিন্দি-বলয়ের ভারতীয় বুর্জোয়া-পুঁজিপতি শ্রেণি এবং ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকারের কারসাজিতে ভারতের সরকারি ভাষা হিন্দি হয়েছিল। হিন্দির অসীম আগ্রাসন গোটা ভারতের বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের মাতৃভাষা-সংস্কৃতিকে বিপদাপন্ন করে তুলেছে। যার জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত আমাদের অভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতির পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকালেই স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়।
বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মাণিক্য রাজাদের শাসনামলের শুরুর দিকে ১৪৬১ সালে সামন্ত রাজাদের শাসনাধীন ত্রিপুরার রাজ-ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করা হয়েছিল। মাণিক্য রাজারা কিন্তু বাংলাভাষী ছিলেন না। বোড়ো, তিপ্রাভাষী ছিলেন। অথচ রাজ্যের সরকারি বাংলা ভাষার প্রচলন ও প্রসারে রাজারা রাজ-কর্মকর্তাদের ওপর হুকুম জারি পর্যন্ত করেছিলেন। ত্রিপুরা রাজ্যে ১৪৬১ সালে বাংলা সরকারি ভাষার মর্যাদা পেয়েছিল, আজ অবধি রাজ্যের প্রাদেশিক ভাষা বাংলা। মোগল ও ব্রিটিশ শাসনামলেও ত্রিপুরা রাজ্যের সরকারি ভাষা ছিল বাংলা। অথচ বাংলা ভাষার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির পাঠস্থান বাংলা প্রদেশে সরকারি ভাষা মোগল যুগে ছিল ফারসি এবং ইংরেজ ঔপনিবেশিক যুগে ছিল ইংরেজি।
অখণ্ড বাংলা প্রদেশের রাজধানী কলকাতা একসময়ের বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির পীঠস্থান ছিল বটে। এখন অতীতের সেই ঐতিহ্য ইতিহাসে পরিণত। বাস্তবে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি ক্রমেই বিলুপ্তির পথ ধরেছে। বাংলা ভাষা সেখানে আঞ্চলিক ভাষার মর্যাদায় ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। কলকাতার কেন্দ্রস্থলে বাংলায় কথা বলার পর্যন্ত উপায় নেই। হোটেলে, মার্কেটে, ট্রামে, বাসে, হাটে-বাজারে যেখানেই কথা বলার প্রয়োজন হবে, কথা বলতে হয় হিন্দিতে। বাংলাভাষী পশ্চিমবঙ্গের মানুষেরা ক্রমেই হিন্দির আগ্রাসনে জাতীয়তার তীব্র সংকটের মুখে।
মনে পড়ে, ১৯৮৮ সালে কলকাতার নাট্যদল নান্দীকারের নাট্য-উৎসবের আমন্ত্রণে ঢাকা থিয়েটারের প্রতিনিধিরূপে কলকাতায় গিয়েছিলাম। ‘কেরামত মঙ্গল’ নাটকটি রবীন্দ্রসদনে প্রদর্শিত হয়েছিল। রবীন্দ্রসদনে উপচে পড়া দর্শকের উপস্থিতিতে নাটকের প্রদর্শনীর শেষে দর্শক প্রতিক্রিয়ায় হতাশ হয়েছিলাম। দর্শকদের অভিযোগ ছিল, নাটকের সংলাপ তাদের বিন্দুমাত্র বোধগম্য হয়নি। এ নিয়ে নান্দীকার প্রধান রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত শ্লেষে বলেছিলেন, ‘হিন্দি শুনতে শুনতে কলকাতার বাঙালিদের কান নষ্ট হয়ে গেছে। আর হিন্দি বলতে বলতে বাংলা ভাষাও ভুলতে বসেছে। সেখানে পূর্ব বাংলার গ্রামীণ বাংলা ভাষার কেরামত মঙ্গল নাটকের সংলাপ তাদের বোঝার উপায় কোথায়?’
বাংলা শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির অগ্রবর্তী কলকাতার বাঙালিদের বাস্তব অবস্থা দেখে সেদিন আমরাও কম হতাশ-বিস্মিত হইনি। এখন তো বিষয়টি আরও চরম পর্যায়ে। কলকাতার উচ্চবিত্তদের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরা পর্যন্ত বাংলা ভাষা ত্যাগ করে হিন্দি-ইংরেজি ভাষার শিক্ষাক্রমে সন্তানদের ঢালাওভাবে ঠেলে দিয়েছেন। সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠার মোহে তারা মাতৃভাষা বাংলা ছেড়ে হিন্দি-ইংরেজি ভাষার পেছনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
ত্রিশ বছর আগে শারদীয় পূজায় কলকাতায় গিয়েছিলাম। মফস্বল ও জেলাগুলোর পূজা দেখতে চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, বর্ধমান, চুঁচড়াসহ অনেক স্থানে গিয়েছিলাম। দেখেছি বারোয়ারি পূজামণ্ডপের মাইকগুলোতে লতা মঙ্গেশকর, হেমন্ত, সতীনাথ, মান্না দে, কিশোর কুমার, জগন্ময় মিত্র, তালাত মাহমুদ, সলিল চৌধুরী, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, সাগর সেন, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, ভূপেন হাজারিকাসহ বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পীদের গান দিন-রাত বেজে চলেছে। অথচ মাত্র কয়েক বছর আগে একই স্থানগুলোতে দুর্গাপূজায় গিয়ে দেখেছি সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। বারোয়ারি পূজামণ্ডপে গান বাজছে সত্য, তবে একটি গানও বাংলা নয়। সবই হিন্দি ছায়াছবির ধুমধাড়াক্কা হিন্দি গান। যুগের ব্যবধানে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের পাল্টে গেছে সাংস্কৃতিক মান ও রুচি।
এখন সেটা ভয়ানক পর্যায়ে। বরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় জীবদ্দশায় বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির লালনপালন পশ্চিম বাংলাকেন্দ্রিক থাকবে না। সেটা বাংলাদেশকেন্দ্রিক হয়ে যাবে।’ তাঁর বলা কথা এখন বাস্তবে পরিণত। হিন্দির বহুমাত্রিক আগ্রাসনে কেবল পশ্চিম বাংলা আক্রান্ত নয়; আক্রান্ত ভারতের অপরাপর প্রদেশগুলোও।
দুঃখজনক হচ্ছে বাংলাদেশেও হিন্দি সংস্কৃতির প্রভাব ক্রমাগত বিস্তার লাভ করেছে। স্যাটেলাইট টেলিভিশনের কল্যাণে হিন্দি সিনেমা, সিরিয়ালে আক্রান্ত বাংলাদেশের দর্শক। আমাদের কিশোর বয়সীরা পর্যন্ত ইতিমধ্যে হিন্দি ভাষা রপ্ত করে ফেলেছে। হিন্দি ভারতের সরকারি ভাষা। সে বিবেচনায় পশ্চিমবঙ্গে বাঙালিদের ওপর হিন্দির প্রভাব থাকাটা অসংগত নয়। ইচ্ছা করলেই তারা হিন্দিকে এখন আর পরিত্যাগ করতে পারবে না। তারা বাঙালি জাতীয়তা পরিত্যাগ করে বহু আগেই ভারতীয় জাতীয়তায় নিজেদের সঁপে দিয়েছে। কিন্তু হিন্দি ভাষা তো আমাদের সুযোগ-প্রতিষ্ঠা কোনোটি দিতে পারবে না। তাহলে আমরা কেন হিন্দির আগ্রাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করে চলেছি? হিন্দি সিরিয়ালে আকৃষ্ট দর্শকেরা পরনিন্দা, পরচর্চা, হিংসা-বিদ্বেষ, কুটিলতা, শঠতার কুশিক্ষায় পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনকে কলুষিত করার দীক্ষা নিচ্ছে। আমরাও ব্যাধিমুক্ত কোথায়? একদিকে হিন্দি ভাষা-সংস্কৃতির আগ্রাসন, অপরদিকে বিশ্বায়ন এবং সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বহুমাত্রিক প্রভাব আমাদের জাতীয় জীবনকে শঙ্কার মুখে ফেলেছে। সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে মুক্ত হতে না পারলে আমাদেরও কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক নতুন দিগন্ত
বাংলাদেশে বেশির ভাগ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। অন্য ভাষার মানুষও কিছু আছে। তবে এই সংখ্যা খুব কম। তাই রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে বিকল্প ভাষার প্রয়োজন পড়ে না। অথচ প্রতিবেশী ভারতে এটা কল্পনাও করা যায় না। কারণ, ভারতে বহু ভাষীর মানুষের বাস।পশ্চিমবঙ্গের অনেক বাঙালি এ নিয়ে তাদের আক্ষেপের কথা গোপন করে না। এমনও বলা হয়, ভিন্ন প্রদেশে তো পরের কথা, নিজেদের প্রদেশেও বাংলা ভাষায় একচেটিয়া কথা বলার উপায় তাদের নেই। গোটা ভারতে ২২টি স্বীকৃত ভাষা রয়েছে। এ ছাড়া অস্বীকৃত আঞ্চলিক ভাষা তো গুনে শেষ করা যাবে না। ইউরোপ মহাদেশের সঙ্গে এ ক্ষেত্রে ভারতকে তুলনা করা যায়। ইউরোপের প্রতিটি দেশের যেমন ভিন্ন ভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতি, ঠিক তেমনি ভারতের প্রতিটি প্রদেশের ভাষা-সংস্কৃতির ভিন্ন ভিন্ন রূপ রয়েছে। স্বকীয় ও স্বাতন্ত্র্যে কোনোটির সঙ্গে কোনোটির মিল নেই।
রয়েছে ব্যাপক ভিন্নতা। ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দি নয়, হিন্দি সরকারি ভাষা।ভারতের সাংবিধানিক ভাষা আইনে হিন্দিকে সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার ফলে অহিন্দিভাষীদের আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলন সামাল দিতে সরকার অহিন্দি প্রদেশগুলোতে সরকারি ভাষা হিসেবে পূর্ববৎ ইংরেজি ভাষাকে বহাল রাখতে বাধ্য হয়। হিন্দি ভাষাবিরোধী ওই আন্দোলন সহিংস রূপ ধারণ করেছিল। পট্টি শ্রীরামালুর আত্মদহনসহ অসংখ্য সম্পদের ক্ষতি সাধিত হয়েছিল।
এ ছাড়া বিহার, উত্তর প্রদেশে উর্দু ভাষাকে দ্বিতীয় সরকারি ভাষা ঘোষণায়, ভাষাভিত্তিক প্রদেশগুলোর সীমানা নির্ধারণে, প্রদেশের সংখ্যালঘু ভাষীদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদানে বাধা প্রদান, ওডিশার বাঙালিদের দ্বারা উৎকলবাসীদের শোষণ-বঞ্চনা ইত্যাদি নিয়েও বিক্ষোভ ও হানাহানির ঘটনা ঘটেছিল। পুরুলিয়া জেলা বিহার রাজ্যে যুক্ত থাকায় বিহার সরকার প্রদেশের একমাত্র ভাষা হিন্দির ঘোষণায় বাঙালি-অধ্যুষিত পুরুলিয়ায় বাংলা ভাষার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে। অবশেষে বিহার থেকে পুরুলিয়াকে পশ্চিমবঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়।
কংগ্রেস সরকার অসমিয়া জাত্যভিমানকে রাজনৈতিক স্বার্থের পক্ষে টানতে ১৯৬১ সালে বাংলা ভাষার দাবিতে আন্দোলনকারীদের সশস্ত্র পন্থায় দমন করেছিল। আসামের ভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে ১১ জন বাঙালি প্রাণ হারিয়েছিল। ভারতে জাতীয়তার প্রশ্নটি মীমাংসিত না হওয়ার ফলে মাঝে মাঝেই সংকট মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
প্রতিটি জাতির মাতৃভাষা সেখানে আঞ্চলিক ভাষার মর্যাদায়। আমাদের মাতৃভাষাকেই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি।ভারতীয়দের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি। সরকারি হিন্দি ভাষা কিন্তু সব প্রদেশে সরকারি ভাষার মর্যাদায় নেই। দক্ষিণের পাঁচ প্রদেশের প্রাদেশিক ভাষার একমাত্র বিকল্প ভাষা ইংরেজি। দক্ষিণ ভারতের পাঁচ রাজ্য যথাক্রমে তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্র, কেরালা ও কর্ণাটক।
এই পাঁচ রাজ্য নিয়েই দক্ষিণ ভারত। দক্ষিণের তামিল, তেলুগু, মালায়লাম, কন্নড় ভাষার কোনোটির সঙ্গে কোনোটির সাদৃশ্য নেই। না বর্ণমালায়, না শব্দে। দক্ষিণ ভারতীয়রা সচেতনভাবে সরকারি হিন্দি ভাষাবিদ্বেষী। হিন্দির প্রতি তাদের রয়েছে অবজ্ঞা। তাদের অভিযোগ, ভারতের সব আঞ্চলিক ভাষার মতো হিন্দিও আঞ্চলিক ভাষা। হিন্দিভাষী ভারতীয় রাজনীতিকেরা সংবিধান সভায় ভোটাভুটির কৌশলতায় হিন্দি ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ অহিন্দিভাষী জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন। এই চাপাচাপি দক্ষিণসহ অহিন্দিভাষী প্রদেশ গ্রহণ করেনি। সচেতনভাবে হিন্দি ভাষাকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
স্বাধীন ভারতের ভাষা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যটি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে শান্তিনিকেতনে মতবিনিময় সভায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, স্বাধীন ভারতে প্রাদেশিক ভাষাগুলো অপরিবর্তিত থাকবে। এখন যেমন রয়েছে, ঠিক তেমনি। তবে রাষ্ট্রভাষা হতে হবে ইংরেজি। ওই বৈঠকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহও উপস্থিত ছিলেন। হিন্দি-বলয়ের ভারতীয় বুর্জোয়া-পুঁজিপতি শ্রেণি এবং ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকারের কারসাজিতে ভারতের সরকারি ভাষা হিন্দি হয়েছিল। হিন্দির অসীম আগ্রাসন গোটা ভারতের বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের মাতৃভাষা-সংস্কৃতিকে বিপদাপন্ন করে তুলেছে। যার জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত আমাদের অভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতির পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকালেই স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়।
বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মাণিক্য রাজাদের শাসনামলের শুরুর দিকে ১৪৬১ সালে সামন্ত রাজাদের শাসনাধীন ত্রিপুরার রাজ-ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে গ্রহণ করা হয়েছিল। মাণিক্য রাজারা কিন্তু বাংলাভাষী ছিলেন না। বোড়ো, তিপ্রাভাষী ছিলেন। অথচ রাজ্যের সরকারি বাংলা ভাষার প্রচলন ও প্রসারে রাজারা রাজ-কর্মকর্তাদের ওপর হুকুম জারি পর্যন্ত করেছিলেন। ত্রিপুরা রাজ্যে ১৪৬১ সালে বাংলা সরকারি ভাষার মর্যাদা পেয়েছিল, আজ অবধি রাজ্যের প্রাদেশিক ভাষা বাংলা। মোগল ও ব্রিটিশ শাসনামলেও ত্রিপুরা রাজ্যের সরকারি ভাষা ছিল বাংলা। অথচ বাংলা ভাষার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির পাঠস্থান বাংলা প্রদেশে সরকারি ভাষা মোগল যুগে ছিল ফারসি এবং ইংরেজ ঔপনিবেশিক যুগে ছিল ইংরেজি।
অখণ্ড বাংলা প্রদেশের রাজধানী কলকাতা একসময়ের বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির পীঠস্থান ছিল বটে। এখন অতীতের সেই ঐতিহ্য ইতিহাসে পরিণত। বাস্তবে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি ক্রমেই বিলুপ্তির পথ ধরেছে। বাংলা ভাষা সেখানে আঞ্চলিক ভাষার মর্যাদায় ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। কলকাতার কেন্দ্রস্থলে বাংলায় কথা বলার পর্যন্ত উপায় নেই। হোটেলে, মার্কেটে, ট্রামে, বাসে, হাটে-বাজারে যেখানেই কথা বলার প্রয়োজন হবে, কথা বলতে হয় হিন্দিতে। বাংলাভাষী পশ্চিমবঙ্গের মানুষেরা ক্রমেই হিন্দির আগ্রাসনে জাতীয়তার তীব্র সংকটের মুখে।
মনে পড়ে, ১৯৮৮ সালে কলকাতার নাট্যদল নান্দীকারের নাট্য-উৎসবের আমন্ত্রণে ঢাকা থিয়েটারের প্রতিনিধিরূপে কলকাতায় গিয়েছিলাম। ‘কেরামত মঙ্গল’ নাটকটি রবীন্দ্রসদনে প্রদর্শিত হয়েছিল। রবীন্দ্রসদনে উপচে পড়া দর্শকের উপস্থিতিতে নাটকের প্রদর্শনীর শেষে দর্শক প্রতিক্রিয়ায় হতাশ হয়েছিলাম। দর্শকদের অভিযোগ ছিল, নাটকের সংলাপ তাদের বিন্দুমাত্র বোধগম্য হয়নি। এ নিয়ে নান্দীকার প্রধান রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত শ্লেষে বলেছিলেন, ‘হিন্দি শুনতে শুনতে কলকাতার বাঙালিদের কান নষ্ট হয়ে গেছে। আর হিন্দি বলতে বলতে বাংলা ভাষাও ভুলতে বসেছে। সেখানে পূর্ব বাংলার গ্রামীণ বাংলা ভাষার কেরামত মঙ্গল নাটকের সংলাপ তাদের বোঝার উপায় কোথায়?’
বাংলা শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির অগ্রবর্তী কলকাতার বাঙালিদের বাস্তব অবস্থা দেখে সেদিন আমরাও কম হতাশ-বিস্মিত হইনি। এখন তো বিষয়টি আরও চরম পর্যায়ে। কলকাতার উচ্চবিত্তদের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরা পর্যন্ত বাংলা ভাষা ত্যাগ করে হিন্দি-ইংরেজি ভাষার শিক্ষাক্রমে সন্তানদের ঢালাওভাবে ঠেলে দিয়েছেন। সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠার মোহে তারা মাতৃভাষা বাংলা ছেড়ে হিন্দি-ইংরেজি ভাষার পেছনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
ত্রিশ বছর আগে শারদীয় পূজায় কলকাতায় গিয়েছিলাম। মফস্বল ও জেলাগুলোর পূজা দেখতে চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, বর্ধমান, চুঁচড়াসহ অনেক স্থানে গিয়েছিলাম। দেখেছি বারোয়ারি পূজামণ্ডপের মাইকগুলোতে লতা মঙ্গেশকর, হেমন্ত, সতীনাথ, মান্না দে, কিশোর কুমার, জগন্ময় মিত্র, তালাত মাহমুদ, সলিল চৌধুরী, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, সাগর সেন, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, ভূপেন হাজারিকাসহ বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পীদের গান দিন-রাত বেজে চলেছে। অথচ মাত্র কয়েক বছর আগে একই স্থানগুলোতে দুর্গাপূজায় গিয়ে দেখেছি সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র। বারোয়ারি পূজামণ্ডপে গান বাজছে সত্য, তবে একটি গানও বাংলা নয়। সবই হিন্দি ছায়াছবির ধুমধাড়াক্কা হিন্দি গান। যুগের ব্যবধানে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের পাল্টে গেছে সাংস্কৃতিক মান ও রুচি।
এখন সেটা ভয়ানক পর্যায়ে। বরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় জীবদ্দশায় বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির লালনপালন পশ্চিম বাংলাকেন্দ্রিক থাকবে না। সেটা বাংলাদেশকেন্দ্রিক হয়ে যাবে।’ তাঁর বলা কথা এখন বাস্তবে পরিণত। হিন্দির বহুমাত্রিক আগ্রাসনে কেবল পশ্চিম বাংলা আক্রান্ত নয়; আক্রান্ত ভারতের অপরাপর প্রদেশগুলোও।
দুঃখজনক হচ্ছে বাংলাদেশেও হিন্দি সংস্কৃতির প্রভাব ক্রমাগত বিস্তার লাভ করেছে। স্যাটেলাইট টেলিভিশনের কল্যাণে হিন্দি সিনেমা, সিরিয়ালে আক্রান্ত বাংলাদেশের দর্শক। আমাদের কিশোর বয়সীরা পর্যন্ত ইতিমধ্যে হিন্দি ভাষা রপ্ত করে ফেলেছে। হিন্দি ভারতের সরকারি ভাষা। সে বিবেচনায় পশ্চিমবঙ্গে বাঙালিদের ওপর হিন্দির প্রভাব থাকাটা অসংগত নয়। ইচ্ছা করলেই তারা হিন্দিকে এখন আর পরিত্যাগ করতে পারবে না। তারা বাঙালি জাতীয়তা পরিত্যাগ করে বহু আগেই ভারতীয় জাতীয়তায় নিজেদের সঁপে দিয়েছে। কিন্তু হিন্দি ভাষা তো আমাদের সুযোগ-প্রতিষ্ঠা কোনোটি দিতে পারবে না। তাহলে আমরা কেন হিন্দির আগ্রাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করে চলেছি? হিন্দি সিরিয়ালে আকৃষ্ট দর্শকেরা পরনিন্দা, পরচর্চা, হিংসা-বিদ্বেষ, কুটিলতা, শঠতার কুশিক্ষায় পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনকে কলুষিত করার দীক্ষা নিচ্ছে। আমরাও ব্যাধিমুক্ত কোথায়? একদিকে হিন্দি ভাষা-সংস্কৃতির আগ্রাসন, অপরদিকে বিশ্বায়ন এবং সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বহুমাত্রিক প্রভাব আমাদের জাতীয় জীবনকে শঙ্কার মুখে ফেলেছে। সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে মুক্ত হতে না পারলে আমাদেরও কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক নতুন দিগন্ত
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে