মামুনুর রশীদ, নাট্যব্যক্তিত্ব
রাজপথ আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। অতীতের সব আন্দোলনের মতোই হরতাল, অবরোধে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ছে। এর সঙ্গে আছে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং অনিশ্চয়তা। গ্রেপ্তার, মৃত্যু, সহিংসতা এসবই তার অন্তর্গত। এ অবস্থায় আমরা যারা শীতকালে সংস্কৃতি উৎসবের আয়োজন করে থাকি, তারা একটা অনিশ্চয়তায় ভুগছি। নানান ধরনের অনুষ্ঠান এখনই বাতিল করতে হচ্ছে। এ এক অসহায় অবস্থা।
যে ভাষায় বিরোধী দল কথা বলছে, তার পাল্টাপাল্টি জবাবে সরকারও কথা বলছে। সেটা একটা রাজনৈতিক আচরণ বটে। কিন্তু সাধারণ মানুষের কথা ভেবে দুই প্রতিপক্ষ কোনো মীমাংসায় পৌঁছাতে পারবে বলে এই মুহূর্তে সেটা মনে হচ্ছে না। তাহলে বিষয়টা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
পৃথিবীর অনেক দেশেই এ ধরনের রাজনৈতিক আন্দোলন চলে, কিন্তু তার উদ্দেশ্য একটাই—সেটা হচ্ছে একটা মীমাংসায় পৌঁছানো এবং জনজীবনকে স্বাভাবিক করে তোলা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না; বরং পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ছে। এই জটিলতার অবসান ঘটবে, সে রকম কারও কোনো সুচিন্তিত মতামত সাধারণ মানুষকে নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।
আমাদের দেশের জনগণের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ঐতিহ্য রয়েছে। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে আজ অবধি নানান আন্দোলন, সংগ্রাম এমনকি সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি। দীর্ঘ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও আমরা যুক্ত থেকেছি। যার মধ্য দিয়ে আমাদের শিল্প-সাহিত্য উন্নত হয়েছে। মানুষ আন্দোলন থেকে প্রেরণা পেয়েছে। কিন্তু আজ আন্দোলন এবং আন্দোলন বিরোধিতার মধ্যে শুধু একটিই বিষয় তা হলো, নির্বাচন এবং ক্ষমতা।
ক্ষমতা মানে কী, সেটা আমরা অতীতেও দেখেছি এবং এখনো দেখছি। ক্ষমতা মানে অর্থ, ক্ষমতা মানে অপপ্রয়োগ এবং জনগণের স্বপ্নকে বারবার ভেঙে দেওয়া। বেশ কিছু লোক আঙুল ফুলে কলাগাছ হবে, শিক্ষাব্যবস্থা ধসে যাবে, স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রস্তুতিহীন হয়ে পড়বে আর এর মধ্য দিয়ে বিদেশে অর্থ পাচারের পথটি আরও সুপ্রশস্ত হবে।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, মোগল আমলেই অনেক সংস্কারকাজ হয়েছে। জনগণের রাজস্বের বিনিময়ে সুশাসন এবং অবকাঠামোগত অনেক উন্নতি ঘটেছে। অনেক ঐতিহাসিক ও অর্থনীতিবিদ মনে করেন ধর্মীয় সংঘাত তাঁরা কমিয়ে আনতে পেরেছেন। কিন্তু আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর দেশীয় রাজ্যগুলো স্বাধীনভাবে পরিচালিত হতে থাকে। তারা নামমাত্র দিল্লির সম্রাটকে একটা রাজস্ব দিত। কিন্তু বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব ইংরেজদের শঠতা ও স্থানীয় শাসকদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে যখন ইংরেজ বণিকের কাছে দেশটা বিক্রি করে দেয়, তারপর থেকেই এই অঞ্চলের মানুষের জীবনে নেমে আসে এক বিশাল দুর্যোগ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসায়ীদের লাগামহীন মুনাফা এবং লুণ্ঠনের ফলে এই অঞ্চল দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে যায়। কোম্পানি সারা ভারতে সম্প্রসারিত হয়ে ভারতকে একটি দরিদ্র রাষ্ট্রে পরিণত করে।
দেশ ভাগের পর বাংলাদেশের রাজনীতি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত লোকদের হাতে পরিচালিত হয়ে আসছিল। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষক, সাবেক ছাত্রনেতা, আইনজ্ঞ এবং সর্বোপরি একদল দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা। কালক্রমে তার জায়গা দখল করেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের চরিত্র ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসায়ীদের থেকে স্বতন্ত্র হবে, এ কথা বিশ্বাস করা যায় না। যে একবার মুনাফার স্বাদ পেয়েছে, সে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নিজের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে মানুষের স্বার্থ হাসিল করবে, এটা কল্পনাই করা যায় না। তাই ব্যবসায়ীদের কাছে রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্বে থেকে নিজের দেশের চিন্তার চেয়ে ব্যক্তিগত চিন্তাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। দলগুলো পরিচালনা করতে গিয়ে একসময় যে গণচাঁদার ব্যবস্থা ছিল তা অনেক আগেই উঠে গেছে। এখন বড় বড় চাঁদা দিয়ে দলগুলো পরিচালিত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদেশি অর্থও আসে।
তাই দলগুলোকে শুধু ভোটের সময় ছাড়া কখনোই জনগণের কাছে যেতে দেখা যায় না।
ব্যবসায়ীরা দল পরিচালনায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। অতীত ও বর্তমানে বড় বড় শিল্পপতি দেশের প্রধান প্রধান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থেকে যান, বিশেষ করে শিল্প-বাণিজ্য-অর্থের। ফলে যাঁরা পেশাদার রাজনীতিক, তাঁরা যেভাবে জনস্বার্থকে মুখ্য করে দেখেন, সেখানে ব্যবসায়ীরা কখনোই জনস্বার্থকে মুখ্য করে দেখতে পারেন না। ফলে আমলা, ব্যবসায়ী এবং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে একটা চমৎকার ঐক্য গড়ে ওঠে এবং দেশের অর্থ বিদেশে পাঠানোর একটা সুবর্ণ সুযোগ মিলে যায়। আর দেশপ্রেমিক রাজনীতিকেরা কোণঠাসা হতে হতে একসময় তাঁদের ভূমিকা নিষ্প্রভ হয়ে ওঠে। রাজনীতিতে মানবিকতা, সুশিক্ষা, সুশাসন ক্রমেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে এবং নিয়ন্ত্রণটা চলে যায় অর্থের কাছে। এ ক্ষেত্রে মিডিয়ার মালিকানায়ও চলে আসেন ব্যবসায়ীরা।
একটি টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক ব্যবসায়ী। তিনি মাসে কোটি টাকা ব্যয় করেন অথচ চ্যানেলটি কেউ দেখে না। কোনো সংবাদ পরিবেশনায় বা অনুষ্ঠানের মানের প্রতিও তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। তিনি অকপটে স্বীকার করেন, ওই সবে তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। তাঁর কারখানা চালাতে শত শত ট্রাকের প্রয়োজন হয়। প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকা বিভিন্ন সংস্থায়, বিশেষ করে পুলিশকে দিতে হয়। কিন্তু এখন একটি টাকাও কাউকে দিতে হয় না। কারণ তাঁর হাতে একটি টেলিভিশন চ্যানেল আছে। এই চ্যানেল হাতে থাকায় সেই সব ঝামেলা থেকে তিনি মুক্ত হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে মিডিয়া চলে গেছে ব্যবসায়ীদের হাতে।
রাজনীতি করতে গেলে প্রথমেই একজন ব্যবসায়ী টার্গেট করেন তাঁর নিজস্ব এলাকাকে। একটি ভালো স্কুল প্রতিষ্ঠার বদলে তিনি একটি মাদ্রাসা বা মসজিদকে অবলম্বন করে নিজের পথ পরিষ্কার করতে চান, ক্ষমতার পাশাপাশি যাতে ইহলোক ও পরলোক দুটিই নিশ্চিত হয়। জনগণের অজ্ঞতা এবং অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে টাকা ঢেলে তিনি হয়ে যান দেশপ্রেমিক, জনদরদি। তাই কোনো না কোনোভাবে তাঁকে ক্ষমতায় আসতেই হবে। এই যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় যাঁরা আসেন, তাঁদের জনগণের প্রতি কোনো অঙ্গীকার থাকার প্রয়োজন আছে কি? এর মধ্যে দেশে যে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি ১৯৯০ সালে সূচনা হয়েছিল, যার মধ্য দিয়ে আমরা একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেই স্বপ্ন রাজনীতিকদের হাতে পড়ে খান খান হয়ে গেছে।
দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এই অবকাঠামোকে ব্যবহার করতে যে সংস্কৃতির প্রয়োজন ছিল, সুশিক্ষার প্রয়োজন ছিল, তা হয়ে ওঠেনি। ফলে এখন শিক্ষার মান দেখলে রীতিমতো ভয় হয়। শিক্ষা যে শুধু স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় নয়, চারদিকের সব ঘটনাবলিকে পর্যবেক্ষণ করা বা কোনো আদর্শকে অনুসরণ করা—তার বিনিময়ে পড়া মুখস্থ, কোচিংয়ে যাওয়া, নম্বর পাওয়া এবং মুখস্থবিদ্যা দিয়ে একটি প্রশাসনিক পদ দখল করার মধ্য দিয়েই সম্পন্ন হয়। এসব তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরা কোনো দায়িত্বে গেলে প্রথমেই তাঁরা সহজে অর্থ উপার্জনের পথ খোঁজেন। কারণ শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে কোনো আদর্শিক শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। তাই একজন তরুণ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছু শিখবে না, শুধু মুখস্থ করবে, রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে শিখবে না, সামনে কোনো আদর্শ মানুষ থেকে শিখবে না, তাহলে তার পরিণতিই–বা কী?
আর এদিকে ক্ষমতা ধরে রাখা এবং ক্ষমতায় যাওয়া—এই টাগ অব ওয়ারের মধ্যে মানুষ আরও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। আন্দোলনে মানুষের ক্ষোভ প্রকাশ হয় বটে, কিন্তু কোনো স্বপ্ন তৈরি হয় না। আজকাল স্বপ্ন তৈরি করা এবং প্রতিবাদী মানুষের জন্ম দেওয়া কোনো রাজনৈতিক দলেরই উদ্দেশ্য নয়। তাই আশপাশে আমরা কিছু অর্থপিপাসু লোকদের দেখতে পাই। কিন্তু এর শেষ কোথায়? সবকিছু মিলিয়ে যদি একটি দুর্নীতিপরায়ণ সমাজই গড়ে ওঠে এবং সেখানে কিছু নিবেদিত প্রাণ সুরাজনৈতিক সংস্কৃতির স্বপ্ন যাঁরা এখনো দেখেন,
তাঁদের কী হবে? এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া খুবই কঠিন।
বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকারের একটি উক্তি দিয়ে শেষ করি। তিনি বলেছেন, ‘শান্তিই সমস্ত ভালো কার্য্যের আরম্ভ। জাতীয় উন্নতি ও উৎকর্ষসাধন করিতে হইলে, অধ্যবসায়ের সহিত সুদীর্ঘকাল সুনির্দিষ্ট পন্থার অনুসরণ করিতে হয়, এবং শক্তিমান, নিঃস্বার্থ ও পবিত্র হৃদয় মনীষীবৃন্দ যে পথে জাতিকে পরিচালিত করা কর্তব্য বিবেচনা করেন, সেই পথেই অগ্রসর হইতে হয়; অরাজকতা ও অশান্তি এই কল্যাণময় পথের পরম শত্রু। আর সব কারণ ছাড়িয়া দিলেও শুধু বর্তমান জগতে বাঁচিয়া থাকিবার জন্য দেশবাসীকে দলবদ্ধভাবে দক্ষ, কর্মঠ হইতে হইবে। জাতীয় মুক্তির এই পথ।’
রাজপথ আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। অতীতের সব আন্দোলনের মতোই হরতাল, অবরোধে জনজীবন স্থবির হয়ে পড়ছে। এর সঙ্গে আছে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং অনিশ্চয়তা। গ্রেপ্তার, মৃত্যু, সহিংসতা এসবই তার অন্তর্গত। এ অবস্থায় আমরা যারা শীতকালে সংস্কৃতি উৎসবের আয়োজন করে থাকি, তারা একটা অনিশ্চয়তায় ভুগছি। নানান ধরনের অনুষ্ঠান এখনই বাতিল করতে হচ্ছে। এ এক অসহায় অবস্থা।
যে ভাষায় বিরোধী দল কথা বলছে, তার পাল্টাপাল্টি জবাবে সরকারও কথা বলছে। সেটা একটা রাজনৈতিক আচরণ বটে। কিন্তু সাধারণ মানুষের কথা ভেবে দুই প্রতিপক্ষ কোনো মীমাংসায় পৌঁছাতে পারবে বলে এই মুহূর্তে সেটা মনে হচ্ছে না। তাহলে বিষয়টা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
পৃথিবীর অনেক দেশেই এ ধরনের রাজনৈতিক আন্দোলন চলে, কিন্তু তার উদ্দেশ্য একটাই—সেটা হচ্ছে একটা মীমাংসায় পৌঁছানো এবং জনজীবনকে স্বাভাবিক করে তোলা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না; বরং পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়ছে। এই জটিলতার অবসান ঘটবে, সে রকম কারও কোনো সুচিন্তিত মতামত সাধারণ মানুষকে নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।
আমাদের দেশের জনগণের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ঐতিহ্য রয়েছে। সেই ভাষা আন্দোলন থেকে আজ অবধি নানান আন্দোলন, সংগ্রাম এমনকি সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি। দীর্ঘ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও আমরা যুক্ত থেকেছি। যার মধ্য দিয়ে আমাদের শিল্প-সাহিত্য উন্নত হয়েছে। মানুষ আন্দোলন থেকে প্রেরণা পেয়েছে। কিন্তু আজ আন্দোলন এবং আন্দোলন বিরোধিতার মধ্যে শুধু একটিই বিষয় তা হলো, নির্বাচন এবং ক্ষমতা।
ক্ষমতা মানে কী, সেটা আমরা অতীতেও দেখেছি এবং এখনো দেখছি। ক্ষমতা মানে অর্থ, ক্ষমতা মানে অপপ্রয়োগ এবং জনগণের স্বপ্নকে বারবার ভেঙে দেওয়া। বেশ কিছু লোক আঙুল ফুলে কলাগাছ হবে, শিক্ষাব্যবস্থা ধসে যাবে, স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রস্তুতিহীন হয়ে পড়বে আর এর মধ্য দিয়ে বিদেশে অর্থ পাচারের পথটি আরও সুপ্রশস্ত হবে।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, মোগল আমলেই অনেক সংস্কারকাজ হয়েছে। জনগণের রাজস্বের বিনিময়ে সুশাসন এবং অবকাঠামোগত অনেক উন্নতি ঘটেছে। অনেক ঐতিহাসিক ও অর্থনীতিবিদ মনে করেন ধর্মীয় সংঘাত তাঁরা কমিয়ে আনতে পেরেছেন। কিন্তু আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর দেশীয় রাজ্যগুলো স্বাধীনভাবে পরিচালিত হতে থাকে। তারা নামমাত্র দিল্লির সম্রাটকে একটা রাজস্ব দিত। কিন্তু বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব ইংরেজদের শঠতা ও স্থানীয় শাসকদের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে যখন ইংরেজ বণিকের কাছে দেশটা বিক্রি করে দেয়, তারপর থেকেই এই অঞ্চলের মানুষের জীবনে নেমে আসে এক বিশাল দুর্যোগ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসায়ীদের লাগামহীন মুনাফা এবং লুণ্ঠনের ফলে এই অঞ্চল দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে যায়। কোম্পানি সারা ভারতে সম্প্রসারিত হয়ে ভারতকে একটি দরিদ্র রাষ্ট্রে পরিণত করে।
দেশ ভাগের পর বাংলাদেশের রাজনীতি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত লোকদের হাতে পরিচালিত হয়ে আসছিল। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষক, সাবেক ছাত্রনেতা, আইনজ্ঞ এবং সর্বোপরি একদল দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা। কালক্রমে তার জায়গা দখল করেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের চরিত্র ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসায়ীদের থেকে স্বতন্ত্র হবে, এ কথা বিশ্বাস করা যায় না। যে একবার মুনাফার স্বাদ পেয়েছে, সে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নিজের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে মানুষের স্বার্থ হাসিল করবে, এটা কল্পনাই করা যায় না। তাই ব্যবসায়ীদের কাছে রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্বে থেকে নিজের দেশের চিন্তার চেয়ে ব্যক্তিগত চিন্তাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। দলগুলো পরিচালনা করতে গিয়ে একসময় যে গণচাঁদার ব্যবস্থা ছিল তা অনেক আগেই উঠে গেছে। এখন বড় বড় চাঁদা দিয়ে দলগুলো পরিচালিত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদেশি অর্থও আসে।
তাই দলগুলোকে শুধু ভোটের সময় ছাড়া কখনোই জনগণের কাছে যেতে দেখা যায় না।
ব্যবসায়ীরা দল পরিচালনায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। অতীত ও বর্তমানে বড় বড় শিল্পপতি দেশের প্রধান প্রধান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থেকে যান, বিশেষ করে শিল্প-বাণিজ্য-অর্থের। ফলে যাঁরা পেশাদার রাজনীতিক, তাঁরা যেভাবে জনস্বার্থকে মুখ্য করে দেখেন, সেখানে ব্যবসায়ীরা কখনোই জনস্বার্থকে মুখ্য করে দেখতে পারেন না। ফলে আমলা, ব্যবসায়ী এবং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে একটা চমৎকার ঐক্য গড়ে ওঠে এবং দেশের অর্থ বিদেশে পাঠানোর একটা সুবর্ণ সুযোগ মিলে যায়। আর দেশপ্রেমিক রাজনীতিকেরা কোণঠাসা হতে হতে একসময় তাঁদের ভূমিকা নিষ্প্রভ হয়ে ওঠে। রাজনীতিতে মানবিকতা, সুশিক্ষা, সুশাসন ক্রমেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে এবং নিয়ন্ত্রণটা চলে যায় অর্থের কাছে। এ ক্ষেত্রে মিডিয়ার মালিকানায়ও চলে আসেন ব্যবসায়ীরা।
একটি টেলিভিশন চ্যানেলের মালিক ব্যবসায়ী। তিনি মাসে কোটি টাকা ব্যয় করেন অথচ চ্যানেলটি কেউ দেখে না। কোনো সংবাদ পরিবেশনায় বা অনুষ্ঠানের মানের প্রতিও তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। তিনি অকপটে স্বীকার করেন, ওই সবে তাঁর কোনো আগ্রহ নেই। তাঁর কারখানা চালাতে শত শত ট্রাকের প্রয়োজন হয়। প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকা বিভিন্ন সংস্থায়, বিশেষ করে পুলিশকে দিতে হয়। কিন্তু এখন একটি টাকাও কাউকে দিতে হয় না। কারণ তাঁর হাতে একটি টেলিভিশন চ্যানেল আছে। এই চ্যানেল হাতে থাকায় সেই সব ঝামেলা থেকে তিনি মুক্ত হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে মিডিয়া চলে গেছে ব্যবসায়ীদের হাতে।
রাজনীতি করতে গেলে প্রথমেই একজন ব্যবসায়ী টার্গেট করেন তাঁর নিজস্ব এলাকাকে। একটি ভালো স্কুল প্রতিষ্ঠার বদলে তিনি একটি মাদ্রাসা বা মসজিদকে অবলম্বন করে নিজের পথ পরিষ্কার করতে চান, ক্ষমতার পাশাপাশি যাতে ইহলোক ও পরলোক দুটিই নিশ্চিত হয়। জনগণের অজ্ঞতা এবং অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে টাকা ঢেলে তিনি হয়ে যান দেশপ্রেমিক, জনদরদি। তাই কোনো না কোনোভাবে তাঁকে ক্ষমতায় আসতেই হবে। এই যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় যাঁরা আসেন, তাঁদের জনগণের প্রতি কোনো অঙ্গীকার থাকার প্রয়োজন আছে কি? এর মধ্যে দেশে যে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি ১৯৯০ সালে সূচনা হয়েছিল, যার মধ্য দিয়ে আমরা একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেই স্বপ্ন রাজনীতিকদের হাতে পড়ে খান খান হয়ে গেছে।
দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এই অবকাঠামোকে ব্যবহার করতে যে সংস্কৃতির প্রয়োজন ছিল, সুশিক্ষার প্রয়োজন ছিল, তা হয়ে ওঠেনি। ফলে এখন শিক্ষার মান দেখলে রীতিমতো ভয় হয়। শিক্ষা যে শুধু স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় নয়, চারদিকের সব ঘটনাবলিকে পর্যবেক্ষণ করা বা কোনো আদর্শকে অনুসরণ করা—তার বিনিময়ে পড়া মুখস্থ, কোচিংয়ে যাওয়া, নম্বর পাওয়া এবং মুখস্থবিদ্যা দিয়ে একটি প্রশাসনিক পদ দখল করার মধ্য দিয়েই সম্পন্ন হয়। এসব তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরা কোনো দায়িত্বে গেলে প্রথমেই তাঁরা সহজে অর্থ উপার্জনের পথ খোঁজেন। কারণ শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে কোনো আদর্শিক শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। তাই একজন তরুণ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিছু শিখবে না, শুধু মুখস্থ করবে, রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে শিখবে না, সামনে কোনো আদর্শ মানুষ থেকে শিখবে না, তাহলে তার পরিণতিই–বা কী?
আর এদিকে ক্ষমতা ধরে রাখা এবং ক্ষমতায় যাওয়া—এই টাগ অব ওয়ারের মধ্যে মানুষ আরও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। আন্দোলনে মানুষের ক্ষোভ প্রকাশ হয় বটে, কিন্তু কোনো স্বপ্ন তৈরি হয় না। আজকাল স্বপ্ন তৈরি করা এবং প্রতিবাদী মানুষের জন্ম দেওয়া কোনো রাজনৈতিক দলেরই উদ্দেশ্য নয়। তাই আশপাশে আমরা কিছু অর্থপিপাসু লোকদের দেখতে পাই। কিন্তু এর শেষ কোথায়? সবকিছু মিলিয়ে যদি একটি দুর্নীতিপরায়ণ সমাজই গড়ে ওঠে এবং সেখানে কিছু নিবেদিত প্রাণ সুরাজনৈতিক সংস্কৃতির স্বপ্ন যাঁরা এখনো দেখেন,
তাঁদের কী হবে? এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া খুবই কঠিন।
বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকারের একটি উক্তি দিয়ে শেষ করি। তিনি বলেছেন, ‘শান্তিই সমস্ত ভালো কার্য্যের আরম্ভ। জাতীয় উন্নতি ও উৎকর্ষসাধন করিতে হইলে, অধ্যবসায়ের সহিত সুদীর্ঘকাল সুনির্দিষ্ট পন্থার অনুসরণ করিতে হয়, এবং শক্তিমান, নিঃস্বার্থ ও পবিত্র হৃদয় মনীষীবৃন্দ যে পথে জাতিকে পরিচালিত করা কর্তব্য বিবেচনা করেন, সেই পথেই অগ্রসর হইতে হয়; অরাজকতা ও অশান্তি এই কল্যাণময় পথের পরম শত্রু। আর সব কারণ ছাড়িয়া দিলেও শুধু বর্তমান জগতে বাঁচিয়া থাকিবার জন্য দেশবাসীকে দলবদ্ধভাবে দক্ষ, কর্মঠ হইতে হইবে। জাতীয় মুক্তির এই পথ।’
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৪ দিন আগে