চিররঞ্জন সরকার
ছোট ছোট সাদা দানার মিষ্টি এক জিনিস হচ্ছে চিনি। চিনির ইংরেজি নাম ‘সুগার’। তবে বাংলায় চিনি শব্দটি একাধিক অর্থে ব্যবহার হয়। বিশেষ্য হিসেবে ‘চিনি’ বলতে বোঝায় ‘সুগার’; আবার ক্রিয়া হিসেবে ‘চিনি’ বলতে কাউকে চেনা (know) বোঝায়। শিশুশিক্ষার্থীদের চিনি শব্দটি নিয়ে বিপত্তির মুখে পড়তে হয়। এক শিক্ষার্থী ‘আমি তাকে চিনি’ এ বাক্যটির ইংরেজি লিখতে গিয়ে লিখেছিল, ‘আই সুগার হিম!’
এই চিনির দাম হু-হু করে বাড়ছে। পবিত্র রমজানের আগে চিনি আমদানিতে শুল্ক-কর কমানো হবে, এমন সংবাদে বাজারে পণ্যটির দাম কিছুটা কমেছিল। কিন্তু শুল্কহার ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কমেনি। নতুন শুল্কায়ন পদ্ধতিতে প্রতি কেজি চিনি আমদানিতে শুল্ক কমেছে ৬৮ পয়সার মতো। তাতে পণ্যটির দাম না কমে বরং উল্টো এখন বাড়তে শুরু করেছে।
দুই-তিন দিনের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে বস্তাপ্রতি চিনির দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বেড়েছে। বাজারে প্যাকেটজাত চিনির সরবরাহ বেশ নিয়ন্ত্রিত। তাতে খুচরায় কোথাও কোথাও ১৫০ টাকার ওপরেও এক কেজির প্যাকেটজাত চিনি কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।
এদিকে সম্প্রতি সরকারি মিলের প্যাকেটজাত লাল চিনির দাম কেজিতে ২০ টাকা বাড়িয়ে ১৬০ টাকা করার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)। সরকার শুল্ক কমিয়ে যখন চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে, ঠিক এ রকম সময়েই কিনা সরকারি প্রতিষ্ঠানটি চিনির দাম নির্ধারণ করেছে ইতিহাসের সর্বোচ্চ। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে কয়েক ঘণ্টা পরই শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে চিনির মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে বিএসএফআইসি।
স্থানীয় চিনিশিল্পের সুরক্ষায় বিদেশ থেকে আমদানি করা চিনিতে সরকার উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করে রেখেছে। এরপরও স্থানীয়ভাবে বিএসএফআইসির উৎপাদিত লাল চিনির উৎপাদন মোট চাহিদার মাত্র ১ শতাংশ। দেশে বছরে ২০-২২ লাখ টন চিনি আমদানি হয়। আর লাল চিনি উৎপাদিত হয় মাত্র ৩০ হাজার টনের মতো; অর্থাৎ চিনির বাজার প্রায় পুরোপুরি আমদানি করা সাদা চিনির ওপরই নির্ভরশীল।
মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের অনেকেই বলছেন, রোজার আগে চিনির চাহিদা বাড়ে। তাতে দামও একটু বাড়তি হয়। অন্যান্য নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রেও চড়া দাম দেখা যাচ্ছে। রোজার আগে দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের নানা তোড়জোড়েও বাজারে সেভাবে প্রভাব পড়ছে না।
চিনির দাম কেন বাড়ছে, এর কোনো যুক্তিসংগত কারণ বা ব্যাখ্যা নেই। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে ধারাবাহিকভাবে চিনির দাম বাড়ছে। কিন্তু এই বিশ্ববাজারের সঙ্গে আমাদের বাজারে চিনির দামের কোনো সামঞ্জস্য নেই। বর্তমানে প্রতি কেজি চিনির দাম ডলারের হিসাবে পড়ে ১১৪ টাকা। অথচ বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। এর মানে আমদানিকারকদের লাভের অঙ্ক স্ফীত করতেই চিনির দাম বাড়ছে!
আমাদের দেশে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে কারসাজি হয়। চিনি নিয়েও হয়। আমদানিকারকদের বক্তব্য হচ্ছে, ডলার-সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো এলসি করতে রাজি হচ্ছে না। একটা জাহাজে কম করে হলেও ২৭ থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলারের এলসি খুলতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ৩ মিলিয়ন ডলারের বেশি এলসি খোলা যাবে না। সে ক্ষেত্রে তাঁদের পরপর ৯টি এলসি খুলতে হচ্ছে। ডলার কিনতে হচ্ছে ১১০-১২০ টাকা দরে। এত হাঙ্গামা সয়ে শুল্ক পরিশোধ করে চিনি আমদানি করে এখন আর পোষায় না। ফলে চিনির আমদানি কমেছে।
বাড়ছে দাম। যদিও ব্যবসায়ীদের এই যুক্তি মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। ৩৫ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতির সম্মুখীন পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে চিনির দাম বেশি। গ্লোবাল প্রোডাক্ট প্রাইস ওয়েবসাইট অনুসারে, চিনির দাম সূচকে ৮২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৯তম; অর্থাৎ বিশ্বের ৩৩টি দেশে চিনির দাম বাংলাদেশের চেয়ে কম। মার্কিন ডলারের হিসাবে বাংলাদেশে প্রতি কেজি চিনির দাম ১ দশমিক ৩৫ ডলার, শ্রীলঙ্কায় ১ দশমিক ২০, ভারতে শূন্য দশমিক ৬৬, থাইল্যান্ডে শূন্য দশমিক ৬১ এবং পাকিস্তানে শূন্য দশমিক ৬৩ ডলার। তালিকায় গড়ে সর্বোচ্চ মূল্য হংকংয়ে ৩ দশমিক ১৮ ডলার এবং সর্বনিম্ন মূল্য নাইজেরিয়ায় শূন্য দশমিক ৩৭ ডলার।
চিনির দাম আপাতত কমছে না—এটা বিবেচনায় নিয়েই আমাদের দৈনন্দিন বাজেট ঠিক করতে হবে। ধীরে ধীরে ‘চিনি’কে ভুলে ‘চিনি না’ বলতে শিখতে হবে। চিনি নিয়ে গভীর আলোচনায় গিয়ে কোনো লাভ নেই; বরং কিছু হালকা আলোচনা করলে শরীরের চিনি বা শর্করা কমতে পারে। চিনি শব্দটির মানে নিয়ে একটা বিখ্যাত গল্প প্রচলিত আছে।
মরিস সাহেব ছিলেন শান্তিনিকেতনে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার অধ্যাপক। একা থাকলে তিনি প্রায়ই গুনগুন করে গান গাইতেন। একদিন তিনি তৎকালীন ছাত্র প্রমথনাথ বিশীকে বললেন: গুরুদেব চিনির ওপর একটি গান লিখেছেন, তা কি তুমি শুনেছ? গানটি বড়ই মিষ্টি।
বিশী: কোন গানটি?
মরিস: আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী...।
বিশী: তা চিনির গান তো মিষ্টি হবেই। কিন্তু এই ব্যাখ্যা আপনি কোথায় পেলেন?
মরিস: কেন, স্বয়ং গুরুদেবই তো আমাকে বলেছেন!
চিনি শব্দটির মানে নিয়েই যে কেবল বিপত্তি ঘটে তা-ই নয়, চিনি খাওয়া নিয়েও অনেক বিপত্তি দেখা দেয়। চিনির তৈরি বিভিন্ন মিষ্টিদ্রব্য পছন্দ করেন না, এমন মানুষ বড় বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না; কিন্তু সবাই সব সময় সমানভাবে মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য খেতে পারেন না।অনেকের রক্তে ‘সুগার’ বা চিনির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা আছে। তখন চিনি বা মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য তাঁর জন্য বিষ বা হারাম হিসেবে বিবেচিত হয়। যাঁরা রক্তে চিনিসংক্রান্ত সমস্যায় ভোগেন, তাঁদের আমরা ডায়াবেটিসের রোগী হিসেবে চিহ্নিত করি। সাধারণভাবে বড়লোকদের মধ্যেই রক্তে এই ‘চিনি সমস্যা’ বেশি দেখা যায়। তাঁদের মন চাইলেও শরীর চিনিকে গ্রহণ করতে পারে না। অথচ যাঁরা ভাতের মতো কেজি কেজি চিনি খেতে পারেন, সেই গরিব মানুষের কপালে এক চিমটি চিনিও জুটছে না। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! চিনির স্বাদ সব সময়ই মিষ্টি। জোর করে খাওয়ালেও চিনি মিষ্টিই লাগে। কমবেশি সবাই তাই চিনি খেতে চান। আর মাগনা বা ‘ফ্রি’ পাওয়ার সুযোগ থাকলে তো কথাই নেই।
এক রোগী ওষুধের দোকানে গিয়ে বললেন: ওষুধ তো দিলেন, চিনিটাও তো দেবেন। দোকানি: চিনি তো বেচি না। রোগী: বললেই হবে, ওষুধেই তো লেখা আছে, ‘সুগার ফ্রি’!
চাল, তেল, পেঁয়াজের পর চিনি নিয়ে কারসাজি মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। কারণ বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবন চিনি ছাড়া চলে না।বাচ্চাদের খাদ্যের অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে চিনি। চা-কফিতে চিনি। সেমাই-সুজি-হালুয়ায় চিনি। আরও বিচিত্র সব আইটেম তৈরি করা হয় চিনি দিয়ে। বাদ্য ছাড়া গান আর চিনি ছাড়া খানা উভয়ই বাঙালির কাছে অপাঙ্ক্তেয়।
এই গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান চিনি নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক হাহাকার। দামের কারণে মিষ্টি জাতের খাবার সেমাই, সুজি, হালুয়া তো দূরে থাক, চা-কফিও হয়ে গেছে ‘সুগার ফ্রি’—ডায়াবেটিসের রোগীর খাবার। চায়ে যতটা পারা যায় কম চিনি দেওয়া হচ্ছে। ঘরে চায়ে চিনির পরিমাণ নিয়ে ঝগড়া-কলহ তো হচ্ছেই, দোকানে পর্যন্ত চা-বিক্রেতাদের সঙ্গে ঝামেলা সৃষ্টি হচ্ছে। চিনি কম দিয়ে, পারলে না দিয়ে কীভাবে চা বানানো যায় ঘরে ঘরে এবং দোকানে দোকানে এখন চলছে সেই কসরত। যাঁদের ডায়াবেটিস নেই তাঁরা পড়েছেন মহা ফাঁপরে।সুস্থ মিষ্টিপ্রিয় মানুষের পক্ষে রোগীর পথ্য আর কাঁহাতক সহ্য হয়?
ঠিকমতো দুধ-চিনি দেওয়া চা খেতে না পারার কারণেই কিনা, বিএনপির নেতা-কর্মীরাও কেমন নেতিয়ে পড়েছেন। তাঁদের আন্দোলন-সংগ্রাম আপাতত লাটে উঠেছে। আসলে চিনির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে সবখানে। মিষ্টি এখন উচ্চবিত্তের শৌখিন খাবার (যদিও তাঁরা ডায়াবেটিসের ভয়ে তা খেতে পারেন না)! আনন্দ আর খুশির খবরেও এখন আর মিষ্টির দেখা পাওয়া যাচ্ছে না, মিষ্টিমুখ করা হচ্ছে না। যাঁদের হাতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আছে, এখন তাঁরাই কেবল মিষ্টির স্বাদ উপভোগ করছেন। চিনির দাম বেড়ে যাওয়ায় মিষ্টির সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টি কথাও হারিয়ে যাচ্ছে। সবাই কেমন যেন তিতা তিতা কথা বলছেন। সরকারি ও বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের কথায় তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। ঘরে কুরুক্ষেত্র তো আগেই ছিল, এখন বাইরেও তা শুরু হয়েছে।
চিনির দাম বাড়ার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপে ব্যর্থ হয়ে সরকার ক্রমেই গালাগালের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে। এই চিনি শেষ পর্যন্ত সরকারকে, সর্বোপরি দেশকে কোথায় নিয়ে যায়, আরও কত বিপত্তি ঘটায় কে জানে!
লেখক: গবেষক, কলামিস্ট
ছোট ছোট সাদা দানার মিষ্টি এক জিনিস হচ্ছে চিনি। চিনির ইংরেজি নাম ‘সুগার’। তবে বাংলায় চিনি শব্দটি একাধিক অর্থে ব্যবহার হয়। বিশেষ্য হিসেবে ‘চিনি’ বলতে বোঝায় ‘সুগার’; আবার ক্রিয়া হিসেবে ‘চিনি’ বলতে কাউকে চেনা (know) বোঝায়। শিশুশিক্ষার্থীদের চিনি শব্দটি নিয়ে বিপত্তির মুখে পড়তে হয়। এক শিক্ষার্থী ‘আমি তাকে চিনি’ এ বাক্যটির ইংরেজি লিখতে গিয়ে লিখেছিল, ‘আই সুগার হিম!’
এই চিনির দাম হু-হু করে বাড়ছে। পবিত্র রমজানের আগে চিনি আমদানিতে শুল্ক-কর কমানো হবে, এমন সংবাদে বাজারে পণ্যটির দাম কিছুটা কমেছিল। কিন্তু শুল্কহার ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কমেনি। নতুন শুল্কায়ন পদ্ধতিতে প্রতি কেজি চিনি আমদানিতে শুল্ক কমেছে ৬৮ পয়সার মতো। তাতে পণ্যটির দাম না কমে বরং উল্টো এখন বাড়তে শুরু করেছে।
দুই-তিন দিনের ব্যবধানে পাইকারি বাজারে বস্তাপ্রতি চিনির দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বেড়েছে। বাজারে প্যাকেটজাত চিনির সরবরাহ বেশ নিয়ন্ত্রিত। তাতে খুচরায় কোথাও কোথাও ১৫০ টাকার ওপরেও এক কেজির প্যাকেটজাত চিনি কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।
এদিকে সম্প্রতি সরকারি মিলের প্যাকেটজাত লাল চিনির দাম কেজিতে ২০ টাকা বাড়িয়ে ১৬০ টাকা করার ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)। সরকার শুল্ক কমিয়ে যখন চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে, ঠিক এ রকম সময়েই কিনা সরকারি প্রতিষ্ঠানটি চিনির দাম নির্ধারণ করেছে ইতিহাসের সর্বোচ্চ। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে কয়েক ঘণ্টা পরই শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে চিনির মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে বিএসএফআইসি।
স্থানীয় চিনিশিল্পের সুরক্ষায় বিদেশ থেকে আমদানি করা চিনিতে সরকার উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করে রেখেছে। এরপরও স্থানীয়ভাবে বিএসএফআইসির উৎপাদিত লাল চিনির উৎপাদন মোট চাহিদার মাত্র ১ শতাংশ। দেশে বছরে ২০-২২ লাখ টন চিনি আমদানি হয়। আর লাল চিনি উৎপাদিত হয় মাত্র ৩০ হাজার টনের মতো; অর্থাৎ চিনির বাজার প্রায় পুরোপুরি আমদানি করা সাদা চিনির ওপরই নির্ভরশীল।
মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের অনেকেই বলছেন, রোজার আগে চিনির চাহিদা বাড়ে। তাতে দামও একটু বাড়তি হয়। অন্যান্য নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রেও চড়া দাম দেখা যাচ্ছে। রোজার আগে দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের নানা তোড়জোড়েও বাজারে সেভাবে প্রভাব পড়ছে না।
চিনির দাম কেন বাড়ছে, এর কোনো যুক্তিসংগত কারণ বা ব্যাখ্যা নেই। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে ধারাবাহিকভাবে চিনির দাম বাড়ছে। কিন্তু এই বিশ্ববাজারের সঙ্গে আমাদের বাজারে চিনির দামের কোনো সামঞ্জস্য নেই। বর্তমানে প্রতি কেজি চিনির দাম ডলারের হিসাবে পড়ে ১১৪ টাকা। অথচ বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। এর মানে আমদানিকারকদের লাভের অঙ্ক স্ফীত করতেই চিনির দাম বাড়ছে!
আমাদের দেশে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে কারসাজি হয়। চিনি নিয়েও হয়। আমদানিকারকদের বক্তব্য হচ্ছে, ডলার-সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো এলসি করতে রাজি হচ্ছে না। একটা জাহাজে কম করে হলেও ২৭ থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলারের এলসি খুলতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ৩ মিলিয়ন ডলারের বেশি এলসি খোলা যাবে না। সে ক্ষেত্রে তাঁদের পরপর ৯টি এলসি খুলতে হচ্ছে। ডলার কিনতে হচ্ছে ১১০-১২০ টাকা দরে। এত হাঙ্গামা সয়ে শুল্ক পরিশোধ করে চিনি আমদানি করে এখন আর পোষায় না। ফলে চিনির আমদানি কমেছে।
বাড়ছে দাম। যদিও ব্যবসায়ীদের এই যুক্তি মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। ৩৫ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতির সম্মুখীন পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে চিনির দাম বেশি। গ্লোবাল প্রোডাক্ট প্রাইস ওয়েবসাইট অনুসারে, চিনির দাম সূচকে ৮২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৯তম; অর্থাৎ বিশ্বের ৩৩টি দেশে চিনির দাম বাংলাদেশের চেয়ে কম। মার্কিন ডলারের হিসাবে বাংলাদেশে প্রতি কেজি চিনির দাম ১ দশমিক ৩৫ ডলার, শ্রীলঙ্কায় ১ দশমিক ২০, ভারতে শূন্য দশমিক ৬৬, থাইল্যান্ডে শূন্য দশমিক ৬১ এবং পাকিস্তানে শূন্য দশমিক ৬৩ ডলার। তালিকায় গড়ে সর্বোচ্চ মূল্য হংকংয়ে ৩ দশমিক ১৮ ডলার এবং সর্বনিম্ন মূল্য নাইজেরিয়ায় শূন্য দশমিক ৩৭ ডলার।
চিনির দাম আপাতত কমছে না—এটা বিবেচনায় নিয়েই আমাদের দৈনন্দিন বাজেট ঠিক করতে হবে। ধীরে ধীরে ‘চিনি’কে ভুলে ‘চিনি না’ বলতে শিখতে হবে। চিনি নিয়ে গভীর আলোচনায় গিয়ে কোনো লাভ নেই; বরং কিছু হালকা আলোচনা করলে শরীরের চিনি বা শর্করা কমতে পারে। চিনি শব্দটির মানে নিয়ে একটা বিখ্যাত গল্প প্রচলিত আছে।
মরিস সাহেব ছিলেন শান্তিনিকেতনে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার অধ্যাপক। একা থাকলে তিনি প্রায়ই গুনগুন করে গান গাইতেন। একদিন তিনি তৎকালীন ছাত্র প্রমথনাথ বিশীকে বললেন: গুরুদেব চিনির ওপর একটি গান লিখেছেন, তা কি তুমি শুনেছ? গানটি বড়ই মিষ্টি।
বিশী: কোন গানটি?
মরিস: আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী...।
বিশী: তা চিনির গান তো মিষ্টি হবেই। কিন্তু এই ব্যাখ্যা আপনি কোথায় পেলেন?
মরিস: কেন, স্বয়ং গুরুদেবই তো আমাকে বলেছেন!
চিনি শব্দটির মানে নিয়েই যে কেবল বিপত্তি ঘটে তা-ই নয়, চিনি খাওয়া নিয়েও অনেক বিপত্তি দেখা দেয়। চিনির তৈরি বিভিন্ন মিষ্টিদ্রব্য পছন্দ করেন না, এমন মানুষ বড় বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না; কিন্তু সবাই সব সময় সমানভাবে মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য খেতে পারেন না।অনেকের রক্তে ‘সুগার’ বা চিনির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা আছে। তখন চিনি বা মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য তাঁর জন্য বিষ বা হারাম হিসেবে বিবেচিত হয়। যাঁরা রক্তে চিনিসংক্রান্ত সমস্যায় ভোগেন, তাঁদের আমরা ডায়াবেটিসের রোগী হিসেবে চিহ্নিত করি। সাধারণভাবে বড়লোকদের মধ্যেই রক্তে এই ‘চিনি সমস্যা’ বেশি দেখা যায়। তাঁদের মন চাইলেও শরীর চিনিকে গ্রহণ করতে পারে না। অথচ যাঁরা ভাতের মতো কেজি কেজি চিনি খেতে পারেন, সেই গরিব মানুষের কপালে এক চিমটি চিনিও জুটছে না। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! চিনির স্বাদ সব সময়ই মিষ্টি। জোর করে খাওয়ালেও চিনি মিষ্টিই লাগে। কমবেশি সবাই তাই চিনি খেতে চান। আর মাগনা বা ‘ফ্রি’ পাওয়ার সুযোগ থাকলে তো কথাই নেই।
এক রোগী ওষুধের দোকানে গিয়ে বললেন: ওষুধ তো দিলেন, চিনিটাও তো দেবেন। দোকানি: চিনি তো বেচি না। রোগী: বললেই হবে, ওষুধেই তো লেখা আছে, ‘সুগার ফ্রি’!
চাল, তেল, পেঁয়াজের পর চিনি নিয়ে কারসাজি মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। কারণ বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবন চিনি ছাড়া চলে না।বাচ্চাদের খাদ্যের অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে চিনি। চা-কফিতে চিনি। সেমাই-সুজি-হালুয়ায় চিনি। আরও বিচিত্র সব আইটেম তৈরি করা হয় চিনি দিয়ে। বাদ্য ছাড়া গান আর চিনি ছাড়া খানা উভয়ই বাঙালির কাছে অপাঙ্ক্তেয়।
এই গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান চিনি নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক হাহাকার। দামের কারণে মিষ্টি জাতের খাবার সেমাই, সুজি, হালুয়া তো দূরে থাক, চা-কফিও হয়ে গেছে ‘সুগার ফ্রি’—ডায়াবেটিসের রোগীর খাবার। চায়ে যতটা পারা যায় কম চিনি দেওয়া হচ্ছে। ঘরে চায়ে চিনির পরিমাণ নিয়ে ঝগড়া-কলহ তো হচ্ছেই, দোকানে পর্যন্ত চা-বিক্রেতাদের সঙ্গে ঝামেলা সৃষ্টি হচ্ছে। চিনি কম দিয়ে, পারলে না দিয়ে কীভাবে চা বানানো যায় ঘরে ঘরে এবং দোকানে দোকানে এখন চলছে সেই কসরত। যাঁদের ডায়াবেটিস নেই তাঁরা পড়েছেন মহা ফাঁপরে।সুস্থ মিষ্টিপ্রিয় মানুষের পক্ষে রোগীর পথ্য আর কাঁহাতক সহ্য হয়?
ঠিকমতো দুধ-চিনি দেওয়া চা খেতে না পারার কারণেই কিনা, বিএনপির নেতা-কর্মীরাও কেমন নেতিয়ে পড়েছেন। তাঁদের আন্দোলন-সংগ্রাম আপাতত লাটে উঠেছে। আসলে চিনির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে সবখানে। মিষ্টি এখন উচ্চবিত্তের শৌখিন খাবার (যদিও তাঁরা ডায়াবেটিসের ভয়ে তা খেতে পারেন না)! আনন্দ আর খুশির খবরেও এখন আর মিষ্টির দেখা পাওয়া যাচ্ছে না, মিষ্টিমুখ করা হচ্ছে না। যাঁদের হাতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আছে, এখন তাঁরাই কেবল মিষ্টির স্বাদ উপভোগ করছেন। চিনির দাম বেড়ে যাওয়ায় মিষ্টির সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টি কথাও হারিয়ে যাচ্ছে। সবাই কেমন যেন তিতা তিতা কথা বলছেন। সরকারি ও বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের কথায় তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। ঘরে কুরুক্ষেত্র তো আগেই ছিল, এখন বাইরেও তা শুরু হয়েছে।
চিনির দাম বাড়ার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপে ব্যর্থ হয়ে সরকার ক্রমেই গালাগালের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছে। এই চিনি শেষ পর্যন্ত সরকারকে, সর্বোপরি দেশকে কোথায় নিয়ে যায়, আরও কত বিপত্তি ঘটায় কে জানে!
লেখক: গবেষক, কলামিস্ট
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৪ দিন আগে