কেমন আছে সন্তানের মনের বাড়ি? 

মৃত্তিকা পণ্ডিত
প্রকাশ : ০৮ জুলাই ২০২১, ১১: ০০
আপডেট : ০৮ জুলাই ২০২১, ১১: ১৭

‘তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই।’ গল্পের চরিত্র ফটিকের কল্যাণেই রবীন্দ্রনাথ হয়তো এখানে শুধু ছেলেশিশুদের উল্লেখ করে থেমে গেছেন। কিন্তু এই একই বয়সের মেয়েশিশুদের ক্ষেত্রেও তো কথাটা সত্য। এই তেরো বছর বয়স বা ইংরেজি ‘থারটিন’ থেকেই তো শুরু হয় টিনএজ, যা কিনা শেষ হয় গিয়ে উনিশে। এই বয়স একই সঙ্গে দ্বিধার ও প্রাণোচ্ছলতার।

আজকের এই সময় এই টিনএজাররাই সবচেয়ে বেশি সংকটে আছে। তাদের বাইরের দুনিয়া হঠাৎ করেই সংকুচিত হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ অনেক দিন হলো। খুলব–খুলছি করেও শেষ পর্যন্ত আর তা খুলছে না। শহর–গ্রামনির্বিশেষে আগের সেই যৌথ পরিবার আর নেই। ফলে উঠতি শিশু–কিশোরদের সঙ্গ পাওয়াটা দিন দিন দুরূহ হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় সন্তানের দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়াটা ভীষণভাবে দরকার। 

করোনা মহামারির এই সময়ে আপনার আদরের সন্তান ঠিক কেমন আছে, সেই খোঁজ কি আপনি জানেন? বেড়ে ওঠার সময় একটি শিশু নানা ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায়। কৈশোরে পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গে তার শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন হয়। এই সময়টি ভীষণ জটিল। এই সময়ে সৃষ্ট বিভিন্ন সমস্যা আমাদের সামগ্রিক মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনিতেই এই গতিশীল সময়ে শিশু–কিশোরদের মানসিকভাবে স্থিতিশীল রাখাটা ভীষণ কঠিন একটি কাজ। এই বয়সেই নানা দিকে নানা ধরনের ঝোঁক তৈরি হয়। এটা প্রাণশক্তির লক্ষণ। একই সঙ্গে এটি ঝুঁকিও তৈরি করে। কারণ, এই ঝোঁক নেতিবাচক দিকেও হতে পারে। 

মহামারি শুরুর আগে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের দেওয়া এক তথ্যমতে, কিশোর-কিশোরীদের, বিশেষত বয়ঃসন্ধিতে থাকা শিশুদের চিন্তা-ভাবনার কেন্দ্রে ছিল নিজের একটি আশ্রয় বা ঘর। এর সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির পদ্ধতি এবং নিজের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির বিষয়ে চিন্তা করত এই বয়সীরা। 

এর পর করোনা মহামারি এল। এসব কিশোর-কিশোরী হঠাৎ করেই ঘরবন্দী হয়ে গেল। সবকিছুই ক্রমে বদলে যেতে থাকল। কতটা যোগাযোগে দক্ষ একটি প্রজন্ম এই সময়ে ঘরবন্দী থাকতে থাকতে ক্রমে ঘরকুনো হয়ে উঠছে। তাদের যোগাযোগের ক্ষমতা ক্রমে নষ্ট হচ্ছে।

চাইল্ড অ্যান্ড ফ্যামিলি থেরাপিস্ট জেনিফার কোরালি বয়ঃসন্ধিকালের শিশু-কিশোরদের নিয়ে বেশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়ে মার্কিন সাময়িকী রিডার্স ডাইজেস্টকে তিনি বলেন, বর্তমানে কিশোর-কিশোরীরা একধরনের অশান্তি ও দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে তাদের ভবিষ্যৎ পঙ্গুত্বের দিকেই যাবে। তারা নতুন কোনো বিষয়ের মুখোমুখি হতে ভয় পায়। মিশতে পারার ক্ষমতা ক্রমেই কমে যাচ্ছে তাদের। তিনি বলেন, বাবা–মায়ের সঙ্গে এসব শিশু-কিশোরের যোগাযোগ অনেক কম। নিজেদের একটি গণ্ডির ভেতর আবদ্ধ রাখতেই তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তাদের মধ্যে হতাশাও বাড়ছে। অথচ ষাটের দশকে বিষয়গুলো এমন ছিল না। 

অবশ্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও কথাসাহিত্যিক ড. মোহিত কামাল বলেন, টিনএজ কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বিদ্যমান রাগ, ক্ষোভ কিংবা হতাশা যেমন আছে, তেমনি তা কাটিয়ে ওঠা অসম্ভবও কিছু না। এ ক্ষেত্রে তিনি অভিভাবকের পাশাপাশি সন্তানের দায়িত্বও মনে করিয়ে দিলেন। তাঁর মতে, কিশোর-কিশোরীদেরও উচিত নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা। তাদেরও বুঝতে হবে, তারা এখন একটি অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। হতাশা, উদ্বেগ তাদের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। তাই মনোবল শক্ত করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, ‘মা-বাবার যেমন সন্তানের প্রতি দায়িত্ব আছে, সন্তানেরও কিন্তু তাঁদের প্রতি কর্তব্য রয়েছে। দুটি বিষয়ই কিন্তু সমান গুরুত্বপূর্ণ। দুটি বিষয় যদি ব্যালেন্স করে চলা যায় তাহলে শিশু–কিশোরদের মন ভালো থাকবে। তারা এতটা হতাশায় ভুগবে না।’ 

জেনিফার কোরালি নিজ পরিপার্শ্বের বিচারে হয়তো ষাটের দশকের কথা উল্লেখ করেছেন। মার্কিন সমাজের বিচারে তা ঠিক আছে। কিন্তু বাংলাদেশের কথা বিবেচনায় নিলে, এই দুই দশক আগেও তো চিত্রটা এমন ছিল না। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে বড় পরিবারগুলো ভেঙে ছোট ছোট পরিবার তৈরি হচ্ছিল। রাজধানী ঢাকার দিকে ছুটছিল সবাই। এখনো সে ছোটায় কোনো ছেদ পড়েনি। তবে কিছু মূলগত পার্থক্য কিন্তু আছে। সে সময় শহরে শহরে নিউক্লিয়ার পরিবার তৈরি হলেও তার মূলটি কিন্তু ছিল গ্রামের যৌথ সমাজে। আবার সে সময় যে শহরে পাড়ি জমাতেন চাকরিজীবীরা, তা তখনো শহর হয়ে ওঠেনি। শহরের পাড়া–মহল্লায় সবার সঙ্গে সবার দেখা হতো, কথা হতো। ফাঁকা স্থান বা খেলার মাঠ তখনো বিরল হয়নি। ফলে সে অর্থে নিঃসঙ্গতা এই বয়সী শিশু–কিশোরদের সে সময় ছুঁতে পারত না। এখন কিন্তু এই নিঃসঙ্গতা ব্যাপকভাবেই নিজের দখল নিয়েছে। কারণ, বাক্সে বাক্সে বন্দী বাক্স। করোনা এই বন্দিত্বকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু বদলেছে। বর্তমানে বাচ্চাদের মধ্যেও অনেক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। তারা অনেক বেশি কথা বলে বা একদমই চুপ থাকে। তারা অনেক সময় এটাই ভুলে যায় যে তাদের কোনো অভিভাবক রয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায়ই দুশ্চিন্তা, হতাশা, এমনকি মনোযোগে ঘাটতির (এডিএইচডি) মতো বিষয়গুলো দেখা দেয়; বিশেষত স্থির হতে না পারা, কোনো কিছু না ভেবেই সিদ্ধান্ত নেওয়া, নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকার মতো সমস্যাগুলো আগের তুলনায় বেড়েছে। তারা রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে থাকে, তারপর সারা দিন ঘুমিয়ে কাটায়; যা তাদের মনের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের জন্যও ক্ষতিকর।

আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব তো রয়েছেই। এখনকার শিশু-কিশোরেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। তারা তাদের না পাওয়া বিষয়গুলো সামনাসামনি বলার চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তারা একে অন্যের সমস্যাগুলো মা-বাবার সঙ্গে আলোচনা করার চেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আলাপে বেশি আগ্রহী। এই হতাশা, দুশ্চিন্তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার নেতিবাচক দিকটি হলো এতে করে তাদের হতাশা কিংবা মন খারাপগুলো অন্যদের মনে সংক্রমিত হতে পারে। আবার কিশোর-কিশোরীরা অনলাইন গেমিংয়েও ঝুঁকছে। বাইরের দুনিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, তারা নিজের মতো করে একটি দুনিয়া তৈরি করে নিচ্ছে। এই আসক্তি নিয়ে ইদানীং অনেক কথা হচ্ছে। অনেকগুলো অনলাইন গেম শিশু-কিশোরদের মানসিকভাবে হিংস্র করে তোলে। মনের রাগ, ক্ষোভ, হতাশা আরও বাড়িয়ে তোলে। বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই শিশু–কিশোরদের গেম আসক্তিতে অভিভাবকদের উদ্বেগ নিয়ে খবর প্রচার হচ্ছে। অনলাইন থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখার পরামর্শ দিয়ে নানা অনুষ্ঠান ও সচেতনতামূলক প্রচার চালানো হচ্ছে।

মুশকিল হচ্ছে এই করোনা আবার শিক্ষা কার্যক্রমের জন্যই অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। ফলে ঘরে বসে থাকাটা শিশুটিকে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়ে কোনো কাজ হচ্ছে না। তারা ডিভাইসেই সময় কাটাচ্ছে বেশি। মা–বাবার পক্ষেও সব সময় সেদিকে নজর রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এই ফাঁকেই তারা ভিডিও গেমে আসক্ত হয়ে পড়ছে। কখনো কখনো এই সূত্র ধরে তারা জড়িয়ে পড়ছে বড় কোনো অঘটনের সঙ্গে।

অনলাইন থেকে শিশু–কিশোরদের দূরে রাখার পরামর্শ দিলেন মোহিত কামালও। বললেন, ‘যেহেতু এখন করোনা মহামারির সময়, তাই কিশোর–কিশোরীরা চাইলেই হুটহাট বাইরে বের হতে পারছে না। অনলাইনে বেশি সময় কাটানো যাবে না।’

তাই এ সময়ে তো বটেই, যেকোনো সময়েই এই বয়সী সন্তানের খোঁজ একটু বেশি করেই নিতে হবে মা–বাবাকে। সন্তান হয়তো নিজের খারাপ লাগাগুলো, হতাশাগুলো প্রকাশ করতে পারছে না। মা–বাবাকে এগিয়ে যেতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে শিক্ষকদের। তাদের ভালো লাগা, চাওয়াগুলোর খোঁজ নিতে হবে। তারা যদি এগুলো নিয়ে কথা বলতে পারে, তাহলে এসব হতাশা অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব।

সব থেকে বড় কথা, করোনা মহামারির এই সময়ে সবাই সবকিছু নিয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন। আমরা একটি অনিশ্চিত পৃথিবীতে আছি। আমরা কেউই জানি না পৃথিবী কবে শান্ত হবে। এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই আমাদের পরের প্রজন্মকে তৈরি করতে হবে। শুধু শরীর নয়, মনের যত্ন নিতে হবে। নিজেরা তাদের পাশে দাঁড়িয়ে শেখাতে হবে এই যত্ন নেওয়ার কৌশল। সন্তানের মঙ্গলের জন্য, ভালোর জন্য, তাদের একটি সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য এই মনের বাড়ির খোঁজ নেওয়াটা ভীষণভাবে জরুরি। এ ক্ষেত্রে সন্তানের ভূমিকাটিও গুরুত্বপূর্ণ। ড. মোহিত কামালের ভাষায়, ‘মা-বাবার যেমন সন্তানের প্রতি দায়িত্ব আছে, সন্তানেরও কিন্তু তাঁদের প্রতি কর্তব্য রয়েছে। দুটি বিষয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ। দুটি বিষয় ব্যালেন্স করে চলা গেলে শিশু–কিশোরদের মন ভালো থাকবে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি চাকরিজীবীরা সম্পদের হিসাব না দিলে যেসব শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন

শেখ হাসিনাকে নিয়ে যুক্তরাজ্যে এম সাখাওয়াতের বিস্ফোরক মন্তব্য, কী বলেছেন এই উপদেষ্টা

শিক্ষকের নতুন ২০ হাজার পদ, প্রাথমিকে আসছে বড় পরিবর্তন

লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতাকে অতিথি করায় মাহফিল বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ

শ্রীপুরে পিকনিকের বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ শিক্ষার্থীর মৃত্যু, আহত ৩

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত