বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড সমীক্ষা এবং অগ্নি দুর্ঘটনায় করণীয়

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার
প্রকাশ : ২৭ মার্চ ২০২৪, ২৩: ৪৮

ক্রমাগত ঘটতে থাকা বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড বিধ্বংসী রূপ ধারণ করার পরও যেন ভ্রুক্ষেপ নেই কারও। বছরজুড়ে অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হওয়াই যেন এ দেশের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা। দেশে যে সকল বিস্ফোরণ ঘটেছে, তার অধিকাংশই হয়েছে বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে অর্থাৎ একই ভবনের মধ্যে আছে বাণিজ্যিক ব্যবহার, রেস্টুরেন্ট ও আবাসস্থল। 

নগরায়ণ প্রক্রিয়া বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের মিশ্র ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বিল্ডিং কোডের বিধি লঙ্ঘন এবং অগ্নি নিরাপত্তা সচেতনতার অভাবের কারণে অধিক জনসংখ্যার মেগাসিটিতে বিস্ফোরণ এবং আগুনের ঝুঁকি সর্বত্র লুকিয়ে আছে। 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থাৎ ২০১০–২২ সালের মধ্যে যেসব ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে ২০১০ সালের পুরান ঢাকার নিমতলীর নবাব কাটরায় রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের গুদামে সংঘটিত বিস্ফোরণ, ২০১২ সালে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ড, ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেটে এবং ১৫ মার্চ রাতে মহাখালীর কড়াইল বস্তিতে লাগা অগ্নিকাণ্ড, ২০১৯ সালে রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশনে এবং বনানীর এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, ২০২১ সালে মগবাজারের ওয়্যারলেস গেটের বিস্ফোরণ এবং ২০২২ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো আজও মানুষের মনে নাড়া দেয়। 

অপরদিকে শুধু ২০২৩ সালেই দেশব্যাপী ঘটে যাওয়া একাধিক বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ব্যাপকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও তেমন কোনো পদক্ষেপ এখনো পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। ২০২৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি গুলশানের মোশারফ জাকের স্কাই লাইন ভবনে লাগা আগুন, ২৬ ফেব্রুয়ারি বনানীর কড়াইল বস্তিতে অগ্নি দুর্ঘটনা, ৫ মার্চ সায়েন্স ল্যাব এলাকায় বিস্ফোরণ, গুলিস্তান বিস্ফোরণের মাত্র দুই দিন পরে ৭ মার্চ সিদ্দিকবাজারে এবং ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের। 

তার ঠিক ১১ দিন পরেই ১৫ এপ্রিল আগুন লাগে রাজধানীর অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক ভবন নিউমার্কেটে এবং আগুনে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার মালামাল পুড়ে যায়। 

 ২০২৪ সাল শুরু হতে না হতেই অগ্নিকাণ্ডের শুভ সূচনা হলো ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে আগুন লাগার মধ্য দিয়ে। বৃহস্পতিবার রাতে সংঘটিত এই অগ্নিকাণ্ডে আনুমানিক প্রায় ২০০ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয় এবং ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। প্রতিটি বিস্ফোরণের ঘটনার পরপরই পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক দপ্তর, সিআইডিসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং প্রতিবারই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। 

অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণ, নির্মিত ভবনগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ না করা, ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগ ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ব্যবহার, শিথিল অগ্নি নিরাপত্তা বিধি মালা, অতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং অগ্নি নিরাপত্তা সচেতনতার অভাবকেই অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী করা হয়। 

বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর থেকে ২০১৫–২২ সাল অর্থাৎ গত ৮ বছরের প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) জানায়, ২০১৬ এবং ২০১৯ সালের কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতিবছরই পূর্ববর্তী বছর হতে বার্ষিক অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। 

ক্যাপস–এর তথ্যানুযায়ী, বিগত ৯ বছরে সর্বমোট ১ লাখ ৬২ হাজার ৪২৬টি অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে এবং অন্যান্য বছরের তুলনায় ২০২২ সালে সর্বাধিক অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। তাই বার্ষিক ক্রমানুযায়ী, ২০২২ সাল ১ম স্থানে অবস্থান করছে এবং ২০১৯ ও ২০২১ সাল যথাক্রমে ২য় ও ৩য় স্থানে অবস্থান করছে। 

ক্যাপস–এর গবেষণায় আরও দেখা যায় যে,২০১৯ সালের তুলনায় ২০২২ সালে শূন্য দশমিক ১২ শতাংশ এবং ২০২১ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ১১ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। ক্যাপসের গবেষণায় আরও পরিলক্ষিত হয় যে, সাধারণত মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে অগ্নিকাণ্ডগুলো বেশি হয়ে থাকে। 

বাংলাদেশে অগ্নিকাণ্ডের সমস্যা মোকাবিলার জন্য সরকারকে অগ্নি নিরাপত্তা বিধান প্রতিষ্ঠা এবং কঠোরভাবে প্রয়োগের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। অপরিকল্পিতভাবে তৈরিকৃত ভবনগুলোর সেপটিক ট্যাংক এবং পানির ট্যাংকগুলোকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ না করার ফলে এর ভেতরে গ্যাস জমে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটে। তাই নিয়মিত এগুলো পর্যবেক্ষণ করতে হবে। 

নির্ধারিত সময় পর পর গ্যাসের লাইনগুলোতে লিকেজ বা ছিদ্র পরীক্ষা করতে হবে। ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ভবনটির অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা সন্তোষজনক কিনা তা যাচাই করে ভবন নির্মাণের অনুমতি দিতে হবে। 

অগ্নিনিরাপত্তায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বৈদ্যুতিক সংযোগগুলো নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখতে হবে এবং ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগ ও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি মেরামত করতে হবে। নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। 

কর্মস্থলের সকলকে অথবা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রসমূহ চালাতে জানতে হবে এবং কর্তৃপক্ষকে তাদের সকল কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রসমূহ পরিচালনার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। 

জরুরি বহির্গমনের পথ সর্বদা খোলা ও বাধামুক্ত রাখতে হবে। বহুতল ভবন ও কারখানাগুলোতে প্রত্যেক রুম বা ফ্লোর থেকে নিরাপদে বের হওয়ার জন্য একটি বহির্গমন মানচিত্র এমন স্থানে ঝুলিয়ে রাখতে হবে যাতে সবাই তা দেখতে পারে। 

ভবনে ফায়ার অ্যালার্মের ব্যবস্থা রাখতে হবে। যে কোনো সময় অগ্নিকাণ্ড সংগঠিত হতে পারে তাই সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। কোথাও আগুন লাগলে সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্যুতিক মূল সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। 

অগ্নিকাণ্ডের সময় যতটা সম্ভব ধীর-স্থির ও শান্ত থাকতে হবে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের জরুরি টেলিফোন নম্বরটি সবার মুখস্থ রাখতে হবে এবং দ্রুত তাদের জানাতে হবে। 

ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসার পূর্ব পর্যন্ত নিরাপদ দূরত্বে থেকে অবশ্যই আগুন নেভানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। অগ্নি নির্বাপণ সামগ্রী ব্যবহার করে আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে হবে। ফ্লোর ধোঁয়াচ্ছন্ন হয়ে গেলে হামাগুড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে বের হয়ে আসতে হবে। সম্ভব হলে ভেজা কাপড়ের টুকরো, রুমাল বা তোয়ালে দিয়ে মুখ ও নাক বেঁধে হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে আসতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে বের হওয়া সম্ভব না হলে গ্যাস মাস্ক পরে অপেক্ষা করতে হবে। 

সর্বোপরি জনসাধারণকে অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন করা এবং অগ্নিকাণ্ডের সময় নিজেকে রক্ষা করা এবং প্রাথমিকভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার কৌশল শেখানোর মাধ্যমে কিছুটা হলেও অযাচিত অগ্নিকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতে পারে। 

লেখক: ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ, বিভাগীয় প্রধান, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি চাকরিজীবীরা সম্পদের হিসাব না দিলে যেসব শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন

ভারতের পাল্টা আক্রমণে দিশেহারা অস্ট্রেলিয়া

ঢাকা কলেজে সংঘর্ষকালে বোমা বিস্ফোরণে ছিটকে পড়েন সেনাসদস্য—ভাইরাল ভিডিওটির প্রকৃত ঘটনা

ঐশ্বরিয়ার বিচ্ছেদের খবরে মুখ খুললেন অমিতাভ

লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতাকে অতিথি করায় মাহফিল বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত