ড. মইনুল ইসলাম
কালোটাকার মালিক শুধু ১০ শতাংশ কর দিয়ে তাঁর অবৈধ আয়কে বৈধ করতে সমর্থ হলে সৎ করদাতা হয়ে ১৫-২০-২৫ শতাংশ আয়কর প্রদান তো আহাম্মকি! বাংলাদেশের সংবিধানের ২০ (২) ধারা বলছে, ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোন ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না...’ এই সাংবিধানিক ধারার উদ্ধৃতি দিতে হলো অর্থমন্ত্রী মহোদয় ‘যত দিন অপ্রদর্শিত আয় থাকবে, তত দিন বাজেটে তা সাদা করার ব্যবস্থা থাকবে’ বক্তব্যটি দিয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করায়। কোনো ব্যক্তি যাতে ‘অনুপার্জিত আয়’ ভোগ করতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করা অর্থমন্ত্রীর অবশ্যপালনীয় সাংবিধানিক কর্তব্য। সংবিধানে ‘অপ্রদর্শিত আয়’ (Undisclosed Income) বলে কোনো টার্ম নেই। ওটা ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের টার্ম। ওই টার্মটি ব্যবহারের মাধ্যমে তখনকার সরকার ‘অনুপার্জিত আয়ের’ সমস্যাটিকে লঘু করার ব্যবস্থা করেছে। সংবিধানের বর্ণিত ‘অনুপার্জিত আয়’ মানেই কালোটাকা, যেটাকে শুধু ১০ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করার ব্যবস্থা চালু রেখে সরকার সংবিধান লঙ্ঘনের গুরুতর অপরাধ করে চলেছে।
এ বিষয়ে ‘দ্য ডেইলি স্টার’-এর ২৪ মে ২০২১ তারিখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর অবসরপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দিন আহমদের কলামে বিষয়টি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট মতামত ব্যক্ত হয়েছে। (নাসিরকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ছাত্র হিসেবে পেয়েছি, তাই কলামে তাঁকে নাসির নামেই সম্বোধন করব)। তিনি হিসাব দিয়েছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে মোট ৩০ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা ‘অপ্রদর্শিত আয়’ কালোটাকা সাদা করার সরকার প্রদত্ত সুবিধা ব্যবহার করে ‘প্রদর্শিত আয়ে’ পরিণত হয়েছে এবং এ বাবদ সরকার ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা কর-রাজস্ব সংগ্রহ করেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সুনির্দিষ্ট কিছু খাতে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগ করলে আয়ের সূত্র সম্পর্কে কোনো সরকারি মহল থেকে কোনো প্রশ্ন করা হবে না মর্মে সুবিধা দেওয়ায় ওই বছর প্রদর্শিত আয়ের স্ফীতি পরিলক্ষিত হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। অনুপার্জিত আয় কর-ফাঁকি, মানি লন্ডারিং এবং ইনফর্মাল ইকোনমি (দুর্নীতি) থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকে। ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশে যে আয়কে ‘অপ্রদর্শিত আয়’ অভিহিত করা হয়েছে, দেশের সংবিধান অনুযায়ী ওই আয় বৈধ সূত্র থেকে অর্জিত আয় হতেই হবে। সুতরাং, অবৈধ সূত্র থেকে প্রাপ্ত অনুপার্জিত আয় স্বতঃপ্রণোদিতভাবে প্রদর্শিত আয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য নয়। বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ড থেকে উদ্ভূত অনুপার্জিত আয়কর দিলেই বৈধ আয়ে (উপার্জিত আয়) রূপান্তরিত হওয়ার কোনো ‘সাংবিধানিক সুযোগ’ নেই। কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ প্রদর্শিত আয়ের সূত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারবে না—সরকারি এই ঘোষণারও কোনো সাংবিধানিক বৈধতা নেই। কারণ, দেশের সংবিধান বেআইনি বা অনুপার্জিত আয়কে আইনসম্মত আয়ে রূপান্তরিত করার কোনো ব্যবস্থা রাখেনি। নাসির দেখিয়েছেন, শুধু ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ পর্বেই ১৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা অবৈধ আয় ১০ শতাংশ কর পরিশোধের মাধ্যমে ‘প্রদর্শিত আয়ে’ পরিণত হয়েছে, যেটা বড় ধরনের একটি উল্লম্ফন। নাসির বলছেন, শুধু ১০ শতাংশ কর দিয়ে অনুপার্জিত আয়কে বৈধ আয়ে রূপান্তরিত করার সুযোগ দেওয়া সৎ করদাতাদের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক বিধায় অনৈতিক এবং অসৎ করদাতাদের বেআইনি সুবিধা দেওয়ার শামিল। তিনি মনে করেন, আসলে এই সুবিধার কারণে অত্যন্ত নিম্ন ‘কর-প্রদান-সদিচ্ছা’ (tax compliance) সৃষ্টি হওয়ায় সরকারেরও খুব বেশি ফায়দা হয় না। এর ফলে সমাজের প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে ভুল মেসেজ দেওয়া হয় এবং দেশের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের খারাপ ধারণা গেড়ে বসে। নাসির দেখিয়েছেন, ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের ১৯(ই) সেকশনে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ‘প্রযোজ্য করহারে কর পরিশোধের সঙ্গে ১০ শতাংশ জরিমানা প্রদান’ সুবিধার মাধ্যমে। ভারতে ২০১৭ সালের অবৈধ অর্থ ঘোষণা স্কিমে ৪৯.৯০ শতাংশ ‘কর, সারচার্জ এবং জরিমানা’ দিয়ে অবৈধ অর্থ বৈধকরণের ব্যবস্থা রয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশে শুধু ১০ শতাংশ কর পরিশোধ করে অবৈধ আয় বৈধকরণের বর্তমান ব্যবস্থা নৈতিকও নয় আইনসম্মতও নয়, এটা ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের সরাসরি লঙ্ঘন।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত এখনো ১০ শতাংশেরও নিচে রয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ, যথাযথ আয়কর সংগ্রহে সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা। আর এই ব্যর্থতার প্রধান কারণ, দুর্নীতিলব্ধ অনুপার্জিত আয়কে করজালের বাইরে রেখে দেওয়ার অভিপ্রায়ে প্রতিবছর কালোটাকা সাদা করার জন্য সরকারের এই অসাংবিধানিক বাজেটব্যবস্থা চালু রাখা। দক্ষিণ এশিয়ায় কর-জিডিপি অনুপাত বাংলাদেশেই সর্বনিম্ন। উপরন্তু, বাংলাদেশের কর-রাজস্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই পরোক্ষ করের অবদান। অর্থনীতি ও রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে দুর্নীতির প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা শুধুই রাজনৈতিক বাত-কা-বাত। বিশ্বের যেসব দেশের সরকার দুর্নীতি দমনে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, সেসব দেশ ক্রমেই উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় চমৎকার নজির সৃষ্টি করছে। এ ব্যাপারে সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে সিঙ্গাপুর, হংকং ও ইন্দোনেশিয়া। সিঙ্গাপুর এশিয়ার সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশ। ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত নরঘাতক সুহার্তোর চরম দুর্নীতিগ্রস্ত একনায়কত্বের অসহায় শিকার ছিল ইন্দোনেশিয়া। সুহার্তোর নিকৃষ্ট অপশাসনকেই বর্ণনা করার জন্য উন্নয়ন চিন্তায় ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ ধারণাটি প্রবর্তিত হয়েছিল। কিন্তু গত ২৩ বছরে ইন্দোনেশিয়া সত্যিকার নির্বাচনী গণতন্ত্রের চর্চার মাধ্যমে দুর্নীতির ওই অতল সাগর থেকে দেশকে উদ্ধারে সমর্থ হওয়ায় এখন ইন্দোনেশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবল জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার বর্তমান নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো ফার্নিচার দোকানের একজন সেলসম্যান ছিলেন; কিন্তু তাঁর সততা ও যোগ্যতার বলে প্রথমে রাজধানী জাকার্তার মেয়র নির্বাচিত হয়ে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে সুকর্ণকন্যা মেঘবতীর দল থেকে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থিতা অর্জন করেছেন এবং একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে এখন ইন্দোনেশিয়াকে আসিয়ান জোটের একটি অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ারে পরিণত করায় নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। ইন্দোনেশিয়ায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে উইদোদো সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন, যে কাজটি মেঘবতী নিজে করতে পারেননি। হংকং বিংশ শতাব্দীর সত্তর দশকে দুর্নীতির আখড়া বিবেচিত হতো; কিন্তু আশির দশকে তারা সিঙ্গাপুরের সাফল্য অনুকরণের মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলে এক দশকে উন্নয়নের চার এশীয় বাঘের অন্যতম পরিণত হয়েছিল।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আয়করকে সরকারের কর-রাজস্বের প্রধান সূত্রে পরিণত করতে হলে অপ্রদর্শিত আয় সাদা করার ব্যবস্থার মাধ্যমে কালোটাকাকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের বর্তমান নীতি সরকারকে পরিত্যাগ করতেই হবে। কালোটাকার মালিক শুধু ১০ শতাংশ কর দিয়ে তাঁর অবৈধ আয়কে বৈধ করতে সমর্থ হলে সৎ করদাতা হয়ে ১৫-২০-২৫ শতাংশ আয়কর প্রদান তো আহাম্মকি! কালোটাকার একটি ক্ষুদ্রাংশের জন্য ১০ শতাংশ কর দিয়ে পুরো অবৈধ আয়ের জন্য যদি আইনি বৈধতার সার্টিফিকেট অর্জন করা যায়, তাহলে সরকার কীভাবে কালোটাকা ঠেকাবে? বাংলাদেশে যে কয়েক শ ধনকুবের পয়দা হয়েছে, তাঁদের কয়জন কোটি টাকার বেশি আয়কর দেন? ‘হাকিম জর্দার’ মালিক বছরের পর বছর এ দেশের সর্বোচ্চ আয়কর প্রদানকারী হচ্ছেন, ওয়েলথ-এক্স-এর গবেষণায় যে ২৫৫ জন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর (কমপক্ষে ৩০ মিলিয়ন ডলার বা ২৫৫ কোটি টাকার মালিক) নাম উঠে এসেছে, তাঁদের নাম তো কোটি টাকার বেশি করদাতাদের তালিকায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! এই কালোটাকার মালিকেরাই দেশ থেকে পুঁজি পাচারের প্রধান হোতা। সরকার যদি মনে করে, কালোটাকা সাদা করার ব্যবস্থার কারণেই দেশে বিনিয়োগের জোয়ার সৃষ্টি হচ্ছে, তাহলে মারাত্মক ভুল হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার মাধ্যমে সরকারি রাজস্বের প্রধান সূত্র হিসেবে আয়করকে প্রতিষ্ঠা করতে পারলে প্রতিবছর যে ক্রমবর্ধমান সরকারি রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর বিপজ্জনক নির্ভরশীলতার দুষ্টচক্রে সরকারকে আটকে থাকতে হচ্ছে, তা থেকে সরকার নিষ্কৃতি পাবে।
কালোটাকার মালিক শুধু ১০ শতাংশ কর দিয়ে তাঁর অবৈধ আয়কে বৈধ করতে সমর্থ হলে সৎ করদাতা হয়ে ১৫-২০-২৫ শতাংশ আয়কর প্রদান তো আহাম্মকি! বাংলাদেশের সংবিধানের ২০ (২) ধারা বলছে, ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোন ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না...’ এই সাংবিধানিক ধারার উদ্ধৃতি দিতে হলো অর্থমন্ত্রী মহোদয় ‘যত দিন অপ্রদর্শিত আয় থাকবে, তত দিন বাজেটে তা সাদা করার ব্যবস্থা থাকবে’ বক্তব্যটি দিয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করায়। কোনো ব্যক্তি যাতে ‘অনুপার্জিত আয়’ ভোগ করতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করা অর্থমন্ত্রীর অবশ্যপালনীয় সাংবিধানিক কর্তব্য। সংবিধানে ‘অপ্রদর্শিত আয়’ (Undisclosed Income) বলে কোনো টার্ম নেই। ওটা ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের টার্ম। ওই টার্মটি ব্যবহারের মাধ্যমে তখনকার সরকার ‘অনুপার্জিত আয়ের’ সমস্যাটিকে লঘু করার ব্যবস্থা করেছে। সংবিধানের বর্ণিত ‘অনুপার্জিত আয়’ মানেই কালোটাকা, যেটাকে শুধু ১০ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করার ব্যবস্থা চালু রেখে সরকার সংবিধান লঙ্ঘনের গুরুতর অপরাধ করে চলেছে।
এ বিষয়ে ‘দ্য ডেইলি স্টার’-এর ২৪ মে ২০২১ তারিখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর অবসরপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নাসিরউদ্দিন আহমদের কলামে বিষয়টি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট মতামত ব্যক্ত হয়েছে। (নাসিরকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ছাত্র হিসেবে পেয়েছি, তাই কলামে তাঁকে নাসির নামেই সম্বোধন করব)। তিনি হিসাব দিয়েছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে মোট ৩০ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা ‘অপ্রদর্শিত আয়’ কালোটাকা সাদা করার সরকার প্রদত্ত সুবিধা ব্যবহার করে ‘প্রদর্শিত আয়ে’ পরিণত হয়েছে এবং এ বাবদ সরকার ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা কর-রাজস্ব সংগ্রহ করেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সুনির্দিষ্ট কিছু খাতে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগ করলে আয়ের সূত্র সম্পর্কে কোনো সরকারি মহল থেকে কোনো প্রশ্ন করা হবে না মর্মে সুবিধা দেওয়ায় ওই বছর প্রদর্শিত আয়ের স্ফীতি পরিলক্ষিত হয়েছে বলে তিনি মনে করেন। অনুপার্জিত আয় কর-ফাঁকি, মানি লন্ডারিং এবং ইনফর্মাল ইকোনমি (দুর্নীতি) থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকে। ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশে যে আয়কে ‘অপ্রদর্শিত আয়’ অভিহিত করা হয়েছে, দেশের সংবিধান অনুযায়ী ওই আয় বৈধ সূত্র থেকে অর্জিত আয় হতেই হবে। সুতরাং, অবৈধ সূত্র থেকে প্রাপ্ত অনুপার্জিত আয় স্বতঃপ্রণোদিতভাবে প্রদর্শিত আয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য নয়। বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ড থেকে উদ্ভূত অনুপার্জিত আয়কর দিলেই বৈধ আয়ে (উপার্জিত আয়) রূপান্তরিত হওয়ার কোনো ‘সাংবিধানিক সুযোগ’ নেই। কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ প্রদর্শিত আয়ের সূত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করতে পারবে না—সরকারি এই ঘোষণারও কোনো সাংবিধানিক বৈধতা নেই। কারণ, দেশের সংবিধান বেআইনি বা অনুপার্জিত আয়কে আইনসম্মত আয়ে রূপান্তরিত করার কোনো ব্যবস্থা রাখেনি। নাসির দেখিয়েছেন, শুধু ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ পর্বেই ১৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা অবৈধ আয় ১০ শতাংশ কর পরিশোধের মাধ্যমে ‘প্রদর্শিত আয়ে’ পরিণত হয়েছে, যেটা বড় ধরনের একটি উল্লম্ফন। নাসির বলছেন, শুধু ১০ শতাংশ কর দিয়ে অনুপার্জিত আয়কে বৈধ আয়ে রূপান্তরিত করার সুযোগ দেওয়া সৎ করদাতাদের প্রতি চরম বৈষম্যমূলক বিধায় অনৈতিক এবং অসৎ করদাতাদের বেআইনি সুবিধা দেওয়ার শামিল। তিনি মনে করেন, আসলে এই সুবিধার কারণে অত্যন্ত নিম্ন ‘কর-প্রদান-সদিচ্ছা’ (tax compliance) সৃষ্টি হওয়ায় সরকারেরও খুব বেশি ফায়দা হয় না। এর ফলে সমাজের প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে ভুল মেসেজ দেওয়া হয় এবং দেশের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের খারাপ ধারণা গেড়ে বসে। নাসির দেখিয়েছেন, ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের ১৯(ই) সেকশনে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অপ্রদর্শিত আয় প্রদর্শনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ‘প্রযোজ্য করহারে কর পরিশোধের সঙ্গে ১০ শতাংশ জরিমানা প্রদান’ সুবিধার মাধ্যমে। ভারতে ২০১৭ সালের অবৈধ অর্থ ঘোষণা স্কিমে ৪৯.৯০ শতাংশ ‘কর, সারচার্জ এবং জরিমানা’ দিয়ে অবৈধ অর্থ বৈধকরণের ব্যবস্থা রয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশে শুধু ১০ শতাংশ কর পরিশোধ করে অবৈধ আয় বৈধকরণের বর্তমান ব্যবস্থা নৈতিকও নয় আইনসম্মতও নয়, এটা ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের সরাসরি লঙ্ঘন।
আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত এখনো ১০ শতাংশেরও নিচে রয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ, যথাযথ আয়কর সংগ্রহে সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা। আর এই ব্যর্থতার প্রধান কারণ, দুর্নীতিলব্ধ অনুপার্জিত আয়কে করজালের বাইরে রেখে দেওয়ার অভিপ্রায়ে প্রতিবছর কালোটাকা সাদা করার জন্য সরকারের এই অসাংবিধানিক বাজেটব্যবস্থা চালু রাখা। দক্ষিণ এশিয়ায় কর-জিডিপি অনুপাত বাংলাদেশেই সর্বনিম্ন। উপরন্তু, বাংলাদেশের কর-রাজস্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই পরোক্ষ করের অবদান। অর্থনীতি ও রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে দুর্নীতির প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা শুধুই রাজনৈতিক বাত-কা-বাত। বিশ্বের যেসব দেশের সরকার দুর্নীতি দমনে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, সেসব দেশ ক্রমেই উন্নয়নের প্রতিযোগিতায় চমৎকার নজির সৃষ্টি করছে। এ ব্যাপারে সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে সিঙ্গাপুর, হংকং ও ইন্দোনেশিয়া। সিঙ্গাপুর এশিয়ার সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশ। ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত নরঘাতক সুহার্তোর চরম দুর্নীতিগ্রস্ত একনায়কত্বের অসহায় শিকার ছিল ইন্দোনেশিয়া। সুহার্তোর নিকৃষ্ট অপশাসনকেই বর্ণনা করার জন্য উন্নয়ন চিন্তায় ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ ধারণাটি প্রবর্তিত হয়েছিল। কিন্তু গত ২৩ বছরে ইন্দোনেশিয়া সত্যিকার নির্বাচনী গণতন্ত্রের চর্চার মাধ্যমে দুর্নীতির ওই অতল সাগর থেকে দেশকে উদ্ধারে সমর্থ হওয়ায় এখন ইন্দোনেশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবল জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার বর্তমান নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো ফার্নিচার দোকানের একজন সেলসম্যান ছিলেন; কিন্তু তাঁর সততা ও যোগ্যতার বলে প্রথমে রাজধানী জাকার্তার মেয়র নির্বাচিত হয়ে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জনের মাধ্যমে সুকর্ণকন্যা মেঘবতীর দল থেকে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থিতা অর্জন করেছেন এবং একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে এখন ইন্দোনেশিয়াকে আসিয়ান জোটের একটি অর্থনৈতিক সুপার পাওয়ারে পরিণত করায় নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন। ইন্দোনেশিয়ায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে উইদোদো সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন, যে কাজটি মেঘবতী নিজে করতে পারেননি। হংকং বিংশ শতাব্দীর সত্তর দশকে দুর্নীতির আখড়া বিবেচিত হতো; কিন্তু আশির দশকে তারা সিঙ্গাপুরের সাফল্য অনুকরণের মাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলে এক দশকে উন্নয়নের চার এশীয় বাঘের অন্যতম পরিণত হয়েছিল।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আয়করকে সরকারের কর-রাজস্বের প্রধান সূত্রে পরিণত করতে হলে অপ্রদর্শিত আয় সাদা করার ব্যবস্থার মাধ্যমে কালোটাকাকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের বর্তমান নীতি সরকারকে পরিত্যাগ করতেই হবে। কালোটাকার মালিক শুধু ১০ শতাংশ কর দিয়ে তাঁর অবৈধ আয়কে বৈধ করতে সমর্থ হলে সৎ করদাতা হয়ে ১৫-২০-২৫ শতাংশ আয়কর প্রদান তো আহাম্মকি! কালোটাকার একটি ক্ষুদ্রাংশের জন্য ১০ শতাংশ কর দিয়ে পুরো অবৈধ আয়ের জন্য যদি আইনি বৈধতার সার্টিফিকেট অর্জন করা যায়, তাহলে সরকার কীভাবে কালোটাকা ঠেকাবে? বাংলাদেশে যে কয়েক শ ধনকুবের পয়দা হয়েছে, তাঁদের কয়জন কোটি টাকার বেশি আয়কর দেন? ‘হাকিম জর্দার’ মালিক বছরের পর বছর এ দেশের সর্বোচ্চ আয়কর প্রদানকারী হচ্ছেন, ওয়েলথ-এক্স-এর গবেষণায় যে ২৫৫ জন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর (কমপক্ষে ৩০ মিলিয়ন ডলার বা ২৫৫ কোটি টাকার মালিক) নাম উঠে এসেছে, তাঁদের নাম তো কোটি টাকার বেশি করদাতাদের তালিকায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! এই কালোটাকার মালিকেরাই দেশ থেকে পুঁজি পাচারের প্রধান হোতা। সরকার যদি মনে করে, কালোটাকা সাদা করার ব্যবস্থার কারণেই দেশে বিনিয়োগের জোয়ার সৃষ্টি হচ্ছে, তাহলে মারাত্মক ভুল হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার মাধ্যমে সরকারি রাজস্বের প্রধান সূত্র হিসেবে আয়করকে প্রতিষ্ঠা করতে পারলে প্রতিবছর যে ক্রমবর্ধমান সরকারি রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ ঋণের ওপর বিপজ্জনক নির্ভরশীলতার দুষ্টচক্রে সরকারকে আটকে থাকতে হচ্ছে, তা থেকে সরকার নিষ্কৃতি পাবে।
শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। যাঁরা পালাতে পারেননি তাঁদের জনাকয়েক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন। আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের দুঃশাসনকালে বিএনপিসহ অন্য নেতাদের যেভাবে হেলমেট পরিয়ে জেলখানা থেকে আদালতে হাজির করা হতো, এখন আওয়ামী লীগের নেতাদের একই কায়দায়
২১ ঘণ্টা আগেপ্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের দিন যত যাচ্ছে, ততই নতুন নতুন কিছু প্রশ্নের উদ্ভব হচ্ছে। প্রশ্নগুলো যে গভীরতর রাজনৈতিক বিষয়সংশ্লিষ্ট, তা বলাই বাহুল্য। অনেক সময়ই প্রধান উপদেষ্টার অফিস থেকে সংবাদ সম্মেলন বা সংবাদ ব্রিফিং করে বিষয়গুলো খোলাসার চেষ্টা করা হয়েছে।
২১ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের গুরুত্ব অপরিসীম। বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক ও জনমনে আস্থার সংকটের প্রেক্ষাপটে নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
২১ ঘণ্টা আগেসম্প্রতি হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী তিন দিনের মধ্যে অটোরিকশা বন্ধের প্রস্তাবে চালকদের রাস্তায় নেমে আসা এবং শহর কার্যত অচল হয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। এ অবরোধে সড়ক ও রেলপথে যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছায়।
২ দিন আগে