আইন লঙ্ঘন করে বরগুনার বেতাগী উপজেলার ইটভাটাগুলোয় জ্বালানি হিসেবে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। এসব কাঠ সামাজিক বনায়ন থেকে সংগ্রহ করায় হুমকির মুখে পরিবেশ। জ্বালানি হিসেবে কাঠ পোড়ানো ইটভাটাগুলো বেশির ভাগ জনবসতিপূর্ণ এলাকা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে থাকায় কালো ধোঁয়া ও দূষণে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে। কাঠ চেরাইয়ের জন্য ইটভাটার মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে করাতকল।
বরগুনা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার মেহেদী হাসান বলেন, ইটভাটার কালো ধোঁয়ার দূষণে শিশুদের মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। এতে একদিকে যেমন শ্বাসকষ্ট হয়, অন্যদিকে ফুসফুসে সমস্যা দেখা দেয়। এ ছাড়া হাঁপানি, চোখ দিয়ে পানি পড়া এমনকি ক্যানসার রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
বরগুনা ইটভাটা মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, বেতাগী উপজেলায় ৬টি ইটভাটা সচল রয়েছে। এসব ভাটায় ইট পোড়ানোর জন্য জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করছেন মালিকেরা। ভাটাগুলো হচ্ছে মেসার্স বিসমিল্লা এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স হাওলাদার ব্রিকস, মেসার্স আরএমবি ব্রিকস, মেসার্স কেজেডএফ ব্রিকস, মেসার্স এমএইচকে ব্রিকস।
ইটভাটা স্থাপন ও ইট প্রস্তুত আইন, ২০১৩-এর ধারা ৬-এ বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি হিসাবে কোনো জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করতে পারবেন না। যদি কোনো ব্যক্তি ধারা ৬ বিধান লঙ্ঘন করে ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কাজে জ্বালানি কাঠ ব্যবহার করেন, তাহলে তিনি অনধিক ৩ (তিন) বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৩ (তিন) লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বেতাগী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র গোলাম কবিরের আরএমবি নামের ইটভাটায় কাঠ দিয়ে দেদার ইট পোড়ানো হচ্ছে। এই ভাটার অভ্যন্তরে কয়েক হাজার মণ কাঠ স্তূপ করে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া কাঠ চেরাইয়ে জন্য ভাটার ভেতরে করাতকল বসিয়ে সেখানে শ্রমিকেরা কাঠ চেরাইয়ের কাজ করছেন।
আরএমবি ভাটার পরিচালক মো. জলিল মিয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কয়লার সংকট থাকায় আমরা এ বছর কাঠ দিয়ে ইট পুড়ছি। টাকা দিলেও আমরা কয়লা পাই না। তা ছাড়া বাজারে গত বছরের কয়লা পাওয়া যায়। তাতে ইট ভালোভাবে পুড়ে না।’
উপজেলার বদনীখালী এলাকায় মেসার্স বিসমিল্লা এন্টারপ্রাইজ ইটভাটার ওপরে কাঠ স্তূপ করে রাখা। সেই কাঠ এক শ্রমিক ভাটার চুল্লিতে দিচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শ্রমিক বলেন, কয়লা দিয়ে ইট পোড়ানোর কথা থাকলেও এই ভাটায় কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হয়। প্রতিদিন ভাটায় ৩০০ থেকে ৪০০ মণ কাঠ পোড়ানো হয়।
উপজেলার বুড়ামজুমদার গ্রামের হাওলাদার ইটভাটায় গিয়ে দেখা গেছে, চারজন শ্রমিক ভাটার চুল্লিতে কাঠ দিচ্ছেন এবং ভাটার অভ্যন্তরে কাঠ স্তূপ করে রাখা হয়েছে। ভাটার শ্রমিকেরা জানিয়েছেন, এই ভাটায় প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ মণ কাঠ পোড়ানো হয়।
হাওলাদার ইটভাটার ম্যানেজার দেলোয়ার হোসেন বলেন, কয়লার অনেক দাম থাকায় ইট পোড়ানোর জন্য আমরা কাঠ ব্যবহার করছি। কারণ, কয়লার দাম বেশি এবং ইটের দাম কম।
বেতাগীর ঝোপখালী এলাকায় মেসার্স এমএইচকে ইটভাটায় গিয়ে দেখা গেছে, দুজন শ্রমিক চুল্লি জ্বালানোর জন্য ভাটার ওপরে কাঠ তুলছেন। কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানোর কারণ জানতে চাইলে ভাটার ম্যানেজার ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
এই ভাটার মালিক আমিনুর ইসলাম বলেন, ‘কয়লা কেনার মতো আমার পুঁজি নেই। তাই ইট পোড়াতে জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করছি। আমি এখন নিরুপায়।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী লিংকন বলেন, কোনো অবস্থাতেই ভাটায় কাঠ পোড়ানো উচিত নয়। এভাবে ইট পোড়ানোর জন্য গাছ কাটা অব্যাহত থাকলে পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।
বরগুনা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক হায়াত মাহমুদ রকিব বলেন, ‘কোনো ইটভাটায় যদি ইট পোড়ানোর জন্য কাঠের ব্যবহার হয়, তাহলে ভাটামালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বেতাগী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. বশির গাজী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ইটভাটায় কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো যাবে না। জেলা প্রশাসক স্যারের সঙ্গে কথা বলে যেসব ভাটায় কাঠ পুড়ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’