ছাত্র আন্দোলন
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডসহ নানা অপরাধে চট্টগ্রাম নগরে ৪৯টি মামলায় আসামি করা হয়েছে ২০ হাজার। এর বেশির ভাগই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী। তবে ভুগছেন নিরীহরাও। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন এমন অনেকের নাম এখনো আসামির তালিকায় রয়েছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) তথ্যমতে, গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের আগে এসব ঘটনা নিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর শুধু ৮ থানায় ৪৯টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯টি হত্যা মামলা। আগস্ট থেকে গত ডিসেম্বর মাসের ১ তারিখ পর্যন্ত সিএমপির পাঁচলাইশ থানায় সর্বোচ্চ ১৭টি, কোতোয়ালিতে ১৩টি, চান্দগাঁওয়ে ১০টি ও ডবলমুরিংয়ে ৮টি মামলা করা হয়েছে। বাকি মামলাগুলো হালিশহর, সদরঘাট, বাকলিয়া ও খুলশী থানায় করা হয়। এসব মামলায় মোট এজাহারভুক্ত আসামি রয়েছে ৫,৩৬৭ জন, অজ্ঞাতনামা রয়েছে ১৫ হাজার। এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের তিন সাবেক সংসদ সদস্যসহ গ্রেপ্তার তিন শতাধিক। এর মধ্যে রয়েছেন রাউজান আসনের এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী, নগরের পতেঙ্গা আসনের এম এ লতিফ, সাতকানিয়া আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবু রেজা নদভী, নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান আজিজ, নগর যুবলীগের সহসভাপতি দেবাশীষ পাল দেবু, নগর যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন খোকাসহ নগর-থানা-ওয়ার্ড কমিটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মী।
পুলিশ চট্টগ্রামের এ মামলাগুলোকে রাজনৈতিক বলছে। তারা জানিয়েছে, আসামিদের বেশির ভাগই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, সমর্থক ও দলটির সহযোগী। কিছু আসামি রয়েছেন বিভিন্ন পেশা-শ্রেণির মানুষ। ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব মামলায় পুলিশ ২৪৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। ২ থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত আরও অর্ধশতাধিক আসামি গ্রেপ্তার হয়।
এদিকে নথি বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ মামলাই অসংগতিতে ভরা। ঘটনার সঙ্গে জড়িত না থাকার পরও রাজনৈতিক কারণে অনেককে এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে পূর্বশত্রুতার জেরে অনেক নিরীহ ব্যক্তিকেও মামলায় আসামি করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে মামলার বাদীও জানেন না তিনি মামলা করেছেন, অনেক বাদী আসামিদের চেনেন না।
অনেক বাদী আছেন তাঁরা পুলিশের তালিকাভুক্ত আসামি। কারাগারে থেকেছেন; কিংবা তাঁদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে।
গত ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের মুরাদপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে কক্সবাজারের মহেশখালী এলাকার নির্মাণশ্রমিক সাইফুল ইসলাম আহতের ঘটনায় হত্যাচেষ্টাসহ নানা অভিযোগে ৪৪ জনের নামে ও অজ্ঞাতনামা অনেককে আসামি দেখিয়ে পাঁচলাইশ থানায় একটি মামলা করা হয়। ৩১ আগস্ট ফাতেমা বেগম নামের এক নারী বাদী হয়ে এ মামলা করেন। চট্টগ্রাম শহরে ওই ঘটনায় তৎকালীন সরকারি দলের কয়েকজন নেতা-কর্মী আসামি থাকলেও বেশির ভাগ আসামি রয়েছেন কক্সবাজারের পেকুয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া এবং চট্টগ্রামের কয়েকটি উপজেলার বিভিন্ন পেশার মানুষ। তবে ফাতেমা জানেন না তিনি মামলার বাদী।
মামলার বিষয়টি জানাজানির পর গত ২৩ অক্টোবর মহেশখালীর কালারমারছড়া ইউনিয়নের আঁধারঘোনা গ্রামে থাকা বাদীর বাড়িতে স্থানীয় সাংবাদিকেরা যান। সেখানে বাদী সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, তিনি চট্টগ্রামে গিয়ে কোনো মামলা করেননি।
জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পাঁচলাইশ থানার এসআই নুরুল আলম মিয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, মামলার বাদী ঠিক আছে। তিনিই এই মামলাটি করেছেন। তবে মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে, সেখানে কিছু অসংগতি রয়েছে।
চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার একটি মামলায় মোহাম্মদ এয়াকুব নামের একজন সরকারি কর্মচারীকে আসামি করা হয়েছে। এয়াকুব বলেন, তিনি এ সময় চিকিৎসার জন্য ভারতে ছিলেন। এর ভিসা ও ভ্রমণ নথিও তাঁর কাছে আছে। ১ আগস্ট তিনি চেন্নাই যান এবং চিকিৎসা শেষে ৯ আগস্ট চট্টগ্রামে ফিরে আসেন।
কোতোয়ালি থানায় নাসিরুল আলম নামের একজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। তিনি ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী। তাঁর দাবি, এসব কিছুই তিনি জানেন না।
এদিকে চট্টগ্রামে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা করেও সমালোচনায় আসেন কফিল উদ্দিন নামের এক যুবলীগ কর্মী। তিনি তাঁর মামলায় ১৮৭ জনকে আসামি করেন। আসামির মধ্যে ২৬ জন পুলিশের সদস্য রয়েছে, যাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন চট্টগ্রাম থেকে অনেক আগে বদলি হয়েছেন। কফিল উদ্দিন নিজে অস্ত্র ও মাদক-সংক্রান্ত একাধিক মামলার আসামি। ইতিপূর্বে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে তিনি কারাগারেও ছিলেন।
১৮ জুলাই বহদ্দারহাটে গুলিতে চবি শিক্ষার্থী হৃদয় চন্দ্র তরুয়া নিহতের ঘটনায় চান্দগাঁও থানায় নিহতের বন্ধু পরিচয়ে হত্যা মামলা করেন আজিজুল হক নামের এক যুবক। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই নামে নিহতের কোনো বন্ধু নেই। মামলায় আসামি করা হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী, চট্টগ্রামের সাবেক সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, ব্যবসায়ীসহ ৭০০ জনকে। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যিনি এই মামলার বাদী তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় পাঁচটি মামলা রয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (অপরাধ) মো. রইছ উদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মামলার সঠিক তদন্তপূর্বক যেসব এজাহারভুক্ত আসামির বিরুদ্ধে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা বা জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাঁদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এজাহারভুক্ত আসামির বাইরে তদন্তে প্রাপ্ত অনেক সন্দিগ্ধ আসামি পাওয়া যাচ্ছে। আমরা তাঁদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনছি। ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই তাঁদের কিন্তু ছেড়ে দেওয়া কিংবা অন্যান্য আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।