বয়স, ওজন, উচ্চতা এবং কায়িক শ্রমের ওপর ভিত্তি করে পরিমাণমতো সঠিক খাবার আমাদের খেতে হয়। এটাই ডায়েট। কিন্তু সবাই মনে করি, ডায়েট মানেই ‘ওজন কমানো’। একজন গর্ভবতী যা খাবেন, সেটা তাঁর ডায়েট। তেমনি একজন কিডনি রোগী যেটা খাবেন, সেটা তাঁর ডায়েট। প্রত্যেক মানুষের ডায়েটের ধরনও আলাদা হবে। তাই সবার আগে শরীরের ধরন অনুযায়ী খাবার বাছাই করা শিখতে হবে।
কী খেলে ওজন কমে
আসলে কোনো খাবারেই ওজন কমে না। তবে কিছু খাবার আছে, যেগুলো ওজন কমাতে সহায়তা করে। এসব খাবার সঠিক নির্দেশনা অনুযায়ী পরিমিত পরিমাণে খেলে ওজন কমবে। তাই সবার আগে খাবারের গুণাগুণ সম্পর্কে জেনে নিতে হবে।
সব ধরনের খাবার মানুষ খেয়ে থাকে। ভাত, রুটি, মাছ, মাংস, ডাল, শাকসবজি, ফল—সবকিছু। ওজন কমাতে চাইলে এসব খাবারই খেতে হবে; তবে একটু বুঝেশুনে।
সুষম খাবার খেতে হবে
সুষম খাবার; অর্থাৎ শর্করা, আমিষ, স্নেহ, ভিটামিন-মিনারেল, খনিজ লবণ ও পানি থাকে এমন খাবার খেতে হবে। এমন খাবারগুলো বাছাই করতে হবে, যেসব খাবারে আঁশসমৃদ্ধ এবং গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম। সাধারণত গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৫৫-এর নিচে হলে খাদ্যতালিকায় রাখা যাবে নিঃসন্দেহে।
আবার গ্লাইসেমিক ইনডেক্সের পাশাপাশি গ্লাইসেমিক লোডও খেয়াল রাখতে হবে। যেসব খাবারের গ্লাইসেমিক লোড কম, সেই খাবারগুলো ওজন কমাতে বেশি সহায়তা করে। আবার যদি কোনো খাবারের গ্লাইসেমিক লোড বেশি, কিন্তু গ্লাইসেমিক ইনডেক্স অনেক কম হয়, সেগুলোও ওজন কমাতে সাহায্য করে। যেমন আলুর গ্লাইসেমিক লোড এবং গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (৯০) দুটিই বেশি। কিন্তু গাজরের গ্লাইসেমিক লোড বেশি হলেও গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (৩৫) অনেক কম। এ ক্ষেত্রে আলু ওজন বাড়াতে ভূমিকা রাখে, কিন্তু গাজর ওজন কমাতে সাহায্য করে।
মোট দৈনিক ক্যালরির ৪০ শতাংশ জটিল শর্করা থেকে নিতে হবে। শর্করাকে বলা হয় শক্তি প্রদানকারী খাবার। তাই ওজন কমানোর নামে একে একেবারে বাদ দেওয়া কিংবা জিরো করে ফেলা যাবে না। শর্করা বাছাই করা শিখতে হবে। এ ক্ষেত্রে ওজন কমানোর জন্য কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট বা জটিল শর্করা খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে। যেমন বার্লি আটা, লাল আটা, বার্লি ফ্ল্যাক্স, ওটস, লাল চাল, সেদ্ধ মোটা চাল ইত্যাদি। এসব শর্করার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বেশ কম এবং এগুলো আঁশসমৃদ্ধ।
মোট দৈনিক ক্যালরির ২০ থেকে ২৫ শতাংশ গুড ফ্যাট থেকে নিতে হবে। সূর্যমুখী, সরিষা বা জলপাই তেলের মতো স্বাস্থ্যকর চর্বি কিংবা গুড ফ্যাট রাখতে হবে। গুড ফ্যাট যেমন ওজন কমাতে সাহায্য করে, তেমনি ব্যাড ফ্যাটের পরিমাণ কমায়।
মোট দৈনিক ক্যালরির ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ প্রোটিন ওজন কমানোর সময় পেশি ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
প্রোটিন হিসেবে চামড়া ছাড়া হাঁস-মুরগির মাংস, সামুদ্রিক মাছ, সেদ্ধ ডিম, বাদাম, ডাল, সয়ামিট, চর্বি ছাড়া গরু ও খাসির মাংস খাওয়া যাবে।
ভিটামিন ও মিনারেলের উৎস হিসেবে শাকসবজি খেতে হবে; বিশেষ করে শাক ওজন কমাতে এবং মন ভালো রাখতে সাহায্য করে। সব ধরনের শাকে আঁশ অনেক বেশি থাকে। সবজির মধ্যে লাউ, চালকুমড়া, ফুলকপি, পাতাকপি, ব্রকলি, টমেটো, চিচিঙ্গা, পটোল, পেঁপে ওজন কামানোর ক্ষেত্রে বেশি উপযোগী।
চিবিয়ে খেতে হয় এমন ফল খেতে হবে। যেমন আমড়া, পেয়ারা, আমলকী, বরই, নাশপাতি, জামরুল, জলপাই ইত্যাদি। এই ফলগুলো পরিমাণে বেশি খাওয়া যাবে। অন্যান্য মিষ্টি ফল পরিমিত খাওয়া যাবে। ফল জুস বানিয়ে না খাওয়াই ভালো। ফলের জুস বানালে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স অনেক বেড়ে যায়, যা খুব দ্রুত আপনার রক্তে শর্করার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে ওজন বেড়ে যায়।
রান্নায় তেলের ব্যবহার কমাতে হবে। রান্নায় তেল কম খেলে শরীরে জমানো ফ্যাট ভেঙে সেই ঘাটতি পূরণ করে। এভাবে শরীরে ফ্যাটের পরিমাণ কমে অর্থাৎ ওজন কমে। সয়াবিন তেলের পরিবর্তে রান্নায় সরিষা বা সূর্যমুখীর তেল ব্যবহার করতে হবে। এসব তেলে অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড বেশি থাকে।
রাতে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমাতে হবে। পর্যাপ্ত না ঘুমালে শরীরে কিছু হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়, বিএমআরের ভারসাম্য নষ্ট হয়। ফলে ওজন কমে না।
সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন ব্যায়ামের অভ্যাস করতে হবে। হাঁটা, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা, জিমে যাওয়া, নিয়মিত ফুটবল-ক্রিকেট খেলা—যেকোনো একটা করলেই হবে।
যে ব্যায়ামে হৃৎস্পন্দন বাড়ে, সেই ব্যায়াম ওজন কমাতে বেশি কার্যকরী।
পরামর্শ: জ্যেষ্ঠ পুষ্টি কর্মকর্তা, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক, জেনারেল হাসপাতাল