পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইমরান খানকে কারাগার থেকে বের করে এনে গৃহবন্দী করার বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েক দিন ধরেই আলোচনা চলছে সরকার ও তাঁর দলের মধ্যে। কিন্তু ‘ইমরান খানের গৃহবন্দিত্বের প্রস্তাব’ নিয়ে পিটিআই নেতাদের বক্তব্যে সৃষ্ট বৈপরীত্য প্রক্রিয়াটিকে জটিল করেছে।
পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম দ্য নিউজের খবরে বলা হয়েছে, পিটিআই প্রতিষ্ঠাতার বোন আলিমা খান দাবি করেছেন, খাইবার পাখতুনখাওয়ার মুখ্যমন্ত্রী আলী আমিন গান্দাপুর এই প্রস্তাবটি দিয়েছিলেন। তবে দলের নেতারা, যেমন চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার গহার আলী খান এবং শের আফজাল মারওয়াত এ বিষয়ে ভিন্ন মতপ্রকাশ করেছেন।
মঙ্গলবার আদিয়ালা কারাগারে ইমরানের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে গণমাধ্যমে আলিমা খান জানান, ‘শুরু থেকেই’ এই বিষয়টি নিয়ে সরকারের তরফ থেকে সমঝোতার প্রস্তাব এসেছে। তবে সরাসরি কোনো যোগাযোগ হয়নি।
আলিমা খান জানান, আলী আমিন গান্দাপুরই প্রথম ইমরান খানকে তাঁর বাসভবন বানি গালায় গৃহবন্দী করার প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, ‘আমার ভাই দেড় বছর ধরে কারাগারে। যদি তিনি কোনো গোপন সমঝোতা করতে চাইতেন, তা অনেক আগেই করতেন।’ এ সময় তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘এত দিন কারাগারে রাখার পর এখন কেন গৃহবন্দিত্বের প্রস্তাব?’
তিনি আরও বলেন, ‘ইমরানকে চুপ থাকার এবং কোনো মন্তব্য না করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।’ আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশ্য নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে আলিমা বলেন, ‘পিটিআই প্রতিষ্ঠাতা সব সময় মাত্র দুটি দাবি করেছেন—৯ মের ঘটনাগুলো তদন্তে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন এবং বন্দীদের মুক্তি। সবার গ্রহণযোগ্য জ্যেষ্ঠ বিচারকের নেতৃত্বে বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করা উচিত।’
এ দুই ইস্যুতে অগ্রগতির অভাব নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে আলিমা খান বলেন, ‘কমিশন গঠন ও বন্দীদের মুক্তির জন্য বারবার আহ্বান জানানো হলেও তা উপেক্ষিত হয়েছে।’ তিনি অভিযোগ করেন, ‘আলোচনাকারী কমিটিকে ইমরানের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি।’
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিচার বিভাগীয় কমিশনের গুরুত্ব তুলে ধরে আলিমা বলেন, ‘ইমরান সব সময় আইনের শাসনের এই নীতিগুলো মেনে চলেছেন।’ তিনি আরও অভিযোগ করেন, ‘সরকারের আলোচক দলের কিছু ব্যক্তি আমাদের ম্যান্ডেট চুরি করেছে।’
স্বচ্ছতার অভাব নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে আলিমা বলেন, ‘আইএসআইয়ের (পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স) কাছ থেকে এখন আর কিছুই লুকানোর নেই। সবাই সমঝোতা নিয়ে কথা বলছে—কেউ তিন বছরের নীরবতার চুক্তি, আবার কেউ অন্য শর্তের প্রস্তাব দিচ্ছেন।’
তবে পিটিআইয়ের নেতা ও আইনজীবী মারওয়াত আলিমা খানের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, ‘ইমরানের গৃহবন্দিত্বের প্রস্তাবটি সরকার এবং এস্টাবলিশমেন্টের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নকভির মাধ্যমে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করা হয়।’
মারওয়াত জানান, প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর ইমরানকে তিন সপ্তাহ বা ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তি দেওয়ার একটি বিকল্প প্রস্তাব আসে, যা নকভির মাধ্যমেই জানানো হয়। তিনি বলেন, ‘২৬ নভেম্বর ইসলামাবাদে পিটিআইয়ের মরণপণ বিক্ষোভ চলাকালে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনার পর পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়।’
মারওয়াত স্বীকার করেন যে এস্টাবলিশমেন্ট এর আগে কখনো সরাসরি, কখনো পরোক্ষ যোগাযোগ বজায় রেখেছিল। তবে ২৬ নভেম্বরের ঘটনার পর থেকে আর কোনো গোপন আলোচনা হয়নি বলে স্পষ্ট করেছেন। মারওয়াতের মতে, যদি মহসিন নাকভিকে সরকারের আলোচনাকারী দলের অন্তর্ভুক্ত করা হতো, তবে আলোচনা ইতিমধ্যেই শেষ হতে পারত। কারণ, নাকভি আলোচনার টেবিলে বেশ নমনীয়তা দেখাতে অভ্যস্ত।
অন্যদিকে, পিটিআই চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার গহার আলী খান পুরোপুরি ভিন্ন অবস্থান প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, পিটিআই প্রতিষ্ঠাতাকে বানি গালায় স্থানান্তরের বিষয়ে কখনো কোনো আলোচনা হয়নি। জিও নিউজকে তিনি বলেন, সরকার, নাকভি বা এস্টাবলিশমেন্ট কখনোই পিটিআই প্রতিষ্ঠাতার মুক্তি, গৃহবন্দিত্ব বা স্থানান্তর নিয়ে কোনো পর্যায়ে আলোচনা করেনি। গহার আলী খান স্পষ্ট করেছেন যে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ ২৬ নভেম্বরের কিছু আগে পুনরায় শুরু হয়। তবে তার আগে নাকভির সঙ্গে আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি।
উল্লেখ্য, ৭১ বছর বয়সী ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া ইমরান খান গত বছরের আগস্ট থেকে কারাবন্দী। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দায়ের করা প্রায় ২০০ মামলা আছে। তাঁর মুক্তির দাবি পিটিআইয়ের রাজনীতির অন্যতম লক্ষ্য।
মাসের পর মাসের রাজনৈতিক অচলাবস্থার পর শেষ পর্যন্ত গত মাসে জোট সরকার এবং সংকটে থাকা পিটিআই আলোচনার টেবিলে বসে উত্তেজনা প্রশমনের লক্ষ্যে। পিটিআইও প্রাথমিকভাবে ইমরান খান উল্লিখিত দুটি দাবিই উত্থাপন করেছিল। ইমরান খানসহ সব রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি এবং ৯ মে ও ২৬ নভেম্বরের ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত।
দুই দফা আলোচনার সময় পিটিআইয়ের আলোচনাকারী দল ‘দাবিনামা’ চূড়ান্ত করতে দলের প্রতিষ্ঠাতা ইমরান খানের সঙ্গে ঘন ঘন সাক্ষাতের দাবি জানিয়েছিল। পিটিআই তাদের মূল দাবিগুলো নিয়ে বেশ সোচ্চার থাকলেও, তারা লিখিতভাবে তাদের দাবি সরকারের কমিটির কাছে উপস্থাপন করেনি।
বর্তমানে চলমান আলোচনার প্রক্রিয়া স্থবিরতায় ভুগছে। কারণ, পিটিআই নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠাতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেয়নি। প্রধান বিরোধী দলটি দাবি করেছে, আদিয়ালা কারাগার কর্তৃপক্ষ তাদের খানের সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি।