ভারতবর্ষের সুবিশাল ভূখণ্ডের প্রতিটি কোনায় ছড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নানা রূপ। হাজার বছরে বিভিন্ন ধর্ম, সম্প্রদায় ও সভ্যতা এই মাটিতে অমর সব কীর্তি রেখে গেছে। এর মধ্যে মুসলিমদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; যা শুধু ইতিহাসের পাতায় নয়, ভৌত সৌন্দর্যের মধ্যেও চির অম্লান হয়ে রয়েছে। ভারতবর্ষে ইসলামি স্থাপত্য নৈপুণ্য, সৌন্দর্য ও অনন্য শিল্পবোধের নিদর্শন বহন করে। পারস্য, তুরস্ক, আরব ও মধ্য এশিয়ার স্থাপত্যশৈলীর মেলবন্ধন ভারতীয় ইসলামি স্থাপত্যকে বিশ্বইতিহাসে বিশেষ স্থান করে দিয়েছে।
সূচনাপর্ব
ভারতে ইসলামি স্থাপত্যের সূচনা হয় দিল্লি সালতানাতের হাত ধরে। ১২০৬ সালে কুতুবউদ্দিন আইবেক দিল্লির মসনদে আরোহণ করেন এবং ইসলামি স্থাপত্যের প্রথম চিহ্ন হিসেবে নির্মাণ করেন কুতুব মিনার। লাল বেলে পাথরের কারুকাজ ও সূক্ষ্ম খোদাইয়ের মাধ্যমে এ মিনার ইসলামি স্থাপত্যের নৈপুণ্যের প্রথম উদাহরণ। কুতুব মিনারের পাশাপাশি কুওয়াতুল-ইসলাম মসজিদ এ সময়ের আরেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্যকীর্তি, যা কুতুব মিনারের আশপাশের প্রাচীন স্থাপত্য ও ধ্বংসাবশেষ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে নির্মাণ করা হয়েছে।
কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদ নান্দনিক নকশায় নির্মিত একটি আয়তাকার ইসলামি স্থাপনা, যাকে মুসলিম স্থাপত্যশৈলীতে লিয়ন বলা হয়। এর নির্মাণশৈলীতে আরব-তুর্কি ও ভারতীয় রীতির বিস্ময়কর সমন্বয় ঘটেছে। এ সংমিশ্রণ বিজিত ও বিজয়ীর সহাবস্থানের অনন্য দৃষ্টান্ত। মসজিদের উচ্চতা, সৌন্দর্য, বিশালত্ব প্রকাশে ভারতীয় প্রাচীন স্থাপত্যনিদর্শনের ধ্বংসাবশেষ প্রতিস্থাপিত হয়েছে এই ইসলামি ঐতিহ্যে, নান্দনিক মুনশিয়ানায়।
সুলতানি আমলে ইসলামি স্থাপত্য মূলত ধর্মীয় প্রয়োজনে নির্মাণ করা হতো। মসজিদ, মাদ্রাসা, দরগাহ ও দুর্গগুলো সেই সময়ের প্রধান স্থাপত্য নিদর্শন। পারস্য ও আরব স্থাপত্যের প্রভাব এবং স্থানীয় শিল্পের মিশ্রণে ভারতীয় ইসলামি স্থাপত্য এক নতুন রূপ পেয়েছিল।
মোগল আমল
মোগল সাম্রাজ্যের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে ইসলামি স্থাপত্য তার শৈল্পিক উৎকর্ষের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছায়। এ সময়ের স্থাপনাগুলো কেবল ধর্মীয় গৌরবই নয়, বরং সম্রাটদের ক্ষমতা ও ব্যক্তিগত রুচির প্রতিফলনও। মোগল স্থাপত্যের সূচনা হয়েছিল বাবরের শাসনামলে। তবে আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের শাসনামলে এটি পরিপূর্ণতা অর্জন করে। আকবরের আমলে মোগল স্থাপত্যে ভারতীয় ও পারস্যের শিল্পের সমন্বয় লক্ষ করা যায়। তাঁর স্থাপিত ফতেহপুর সিক্রি বা আগ্রার কেল্লা স্থাপত্যশিল্পের অনন্য শক্তিমান নিদর্শন। অন্যদিকে, শাহজাহানের শাসনামলে মোগল স্থাপত্য শিল্প-গৌরবের চূড়ায় পৌঁছায়। তাঁর আমলে নির্মিত তাজমহল, যা সারা বিশ্বে ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে পরিচিত, মোগল স্থাপত্যের সবচেয়ে উজ্জ্বল রত্ন। মোগল আমলের কয়েকটি নিদর্শন—
তাজমহল
সম্রাট শাহজাহানের সৃষ্টি তাজমহলকে বলা হয় মোগল স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। সাদা মার্বেলের এ সমাধি শুধু একটি স্থাপত্য নয়, এটি প্রেমের প্রতীকও। যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত এই স্থাপত্যে পারস্য, তুর্কি এবং ভারতীয় শিল্পের নিখুঁত মেলবন্ধন দেখা যায়। তাজমহলের মার্বেল পাথরে খোদাই করা ফুলেল নকশা এবং কোরআনের আয়াতের ক্যালিগ্রাফি এক অপার্থিব অনুভূতির জন্ম দেয়।
লাল কেল্লা
শাহজাহানের আরেক অনন্য সৃষ্টি দিল্লির লাল কেল্লা। লাল বেলে পাথরের তৈরি এই দুর্গ কেবল শাসনের প্রতীক নয়, বরং স্থাপত্য সৌন্দর্যেরও দারুণ প্রতিফলন। এর প্রাসাদ, মসজিদ ও উদ্যান মোগল স্থাপত্যের অমূল্য ঐশ্বর্য।
ফতেহপুর সিক্রি ও হুমায়ুনের সমাধি
আকবর নির্মিত ফতেহপুর সিক্রি মোগল স্থাপত্যের আরেক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। বুলন্দ দরজা, জামে মসজিদ এবং পঞ্চমহলের নকশাশৈলী মুগ্ধ করে যে কাউকেই। অন্যদিকে, হুমায়ুনের সমাধিকে গণ্য করা হয় ভারতবর্ষের প্রথম বাগানসমাধি হিসেবে।
দক্ষিণ ভারত
উত্তর ভারতের পাশাপাশি দক্ষিণ ভারতেও মুসলিম শাসনের গভীর প্রভাব পড়েছিল। বিজাপুর, গোলকোন্ডা এবং হায়দরাবাদে ইসলামি স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন পাওয়া যায়। বিজাপুরের গোল গম্বুজ, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গম্বুজ, স্থাপত্যশৈলীর ক্ষেত্রে এক আশ্চর্য সৃষ্টি। গোলকোন্ডা দুর্গ এবং হায়দরাবাদের চার মিনার দক্ষিণ ভারতের ইসলামি স্থাপত্যের অনন্য রত্ন।
ভারতীয় ইসলামি স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য
ভারতীয় ইসলামি স্থাপত্য কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের জন্য বিখ্যাত। যেমন—
গম্বুজ ও মিনার
গম্বুজ ইসলামি স্থাপত্যের মূল আকর্ষণ। এটি মহান আল্লাহর বড়ত্বের প্রতীক। ভারতীয় উপমহাদেশও এর ব্যতীক্রম নয়।
জ্যামিতিক নকশা ও ক্যালিগ্রাফি
ইসলামে প্রাণীর চিত্রায়ণ নিষিদ্ধ থাকার কারণে জ্যামিতিক নকশা এবং আরবি ক্যালিগ্রাফি ইসলামি স্থাপত্যে বহুল ব্যবহৃত হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম স্থাপনাগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়।
জলাশয় ও বাগান
মোগল স্থাপত্যে বাগান ও জলাশয়ের গুরুত্ব ছিল। এটি ইসলামের বেহেশতের ধারণা প্রতিফলিত করে।
ভারতীয় ইসলামি স্থাপত্য শুধু ধর্মীয় পরিচিতি নয়; বরং এটি ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির অঙ্গ। এই স্থাপত্যশৈলী স্থানীয় শিল্প ও প্রযুক্তিকে সমৃদ্ধ করেছে। পারস্যের গম্বুজ, তুর্কি মিনার এবং ভারতীয় খোদাইয়ের সম্মিলন; এই স্থাপত্যকে বৈশ্বিকভাবে অনন্য করে তুলেছে। এ অঞ্চলে ইসলামি স্থাপত্য আমাদের এক অসামান্য ঐতিহ্য উপহার দিয়েছে, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বিস্ময়ের প্রতীক হয়ে থাকবে। এটি ভারতের বহুত্ববাদী সমাজের এক জীবন্ত নিদর্শন, যা অতীতের গৌরব এবং ভবিষ্যতের অনুপ্রেরণার প্রতীক।
লেখক: গবেষক, উচ্চতর ইসলামি আইন গবেষণা বিভাগ, আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম।
তথ্যঋণ
১. হিন্দি ইসলামি ফন্নে তামির/সাহবা ওয়াহিদ।
২. ইসলামি ফন্নে তামির পার এক নজর/ড. গোলাম মঈনুদ্দিন।
৩. বরসগির মে আউওয়ালিন শাহি তামিরাত/মাহবুব উল্লাহ মুজিব।
৪. ইসলামি ফন্নে তামির হিন্দুস্তান মে/সাইয়েদ হাশেম ফরিদাবাদী