কৃষিকে ভিত্তি করেই যেসব উদ্যোক্তা ধীরে ধীরে কৃষি শিল্পোদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন, তাঁদের একজন চট্টগ্রামের রাকিবুর রহমান টুটুল। টুটুল মাত্র ৩০০ মুরগি দিয়ে খামার শুরু করে এখন বছরে হাজার কোটি টাকা আয় করছেন। কৃষিকে তিনি শিল্পে রূপান্তর করেছেন। বছর দুয়েক আগে আমার সুযোগ হয়েছিল চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে তাঁর ডেইরি খামার দেখার। খামারের নাম নাহার ডেইরি।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই সময়ে বিশ্বব্যাপী কৃষি উৎপাদনে তথ্যপ্রযুক্তির কার্যকর ও দক্ষতাপূর্ণ ব্যবহারের তৎপরতা চলছে। কৃষিতে শ্রম কমানো এবং উৎপাদনব্যবস্থাকে গাণিতিক হিসাবের মধ্যে আনতে তথ্যপ্রযুক্তি রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে প্রাণিসম্পদ খাতে। ইন্টারনেটের সঙ্গে কম্পিউটার কিংবা মোবাইল ফোন যুক্ত করে এই খাতের কার্যক্রম পরিচালনায় এসেছে দারুণ সাফল্য। কয়েক বছরে দুগ্ধখামার তথা প্রাণিসম্পদে ইন্টারনেট অব থিংস আইওটি ব্যবহার নিয়ে কয়েকটি প্রতিবেদন আমি প্রচার করেছি। ২০১৬ সালে নেদারল্যান্ডসের ওয়েগিনিংগেন ইউনিভার্সিটির প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা খামারগুলোতে দেখেছি প্রযুক্তি তথা তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির নানামুখী ব্যবহার। তারপর ২০১৮ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলের চুং নামে ডেইরি খামারে স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে একটি প্রতিবেদনের কথা আপনাদের হয়তো মনে থাকতে পারে।
সেখানকার সবকিছু প্রচলিত খামারের মতোই। বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, খামার পরিচালনায় মানুষ নেই বললেই চলে। কিম নামের একজন খামারি ছোট্ট একটি কন্ট্রোলরুম থেকে নিয়ন্ত্রণ করেন পুরো খামার। আর বাংলাদেশে দুগ্ধ খামারে ইন্টারনেট অব থিংসের ব্যবহার প্রথম দেখলাম নারায়ণগঞ্জের কাঞ্চন এলাকায় মাসকো ডেইরি লিমিটেডে। পরে দেখেছি সূর্যমুখী প্রাণিসেবা নামের একটি প্রতিষ্ঠানে আইওটির সফল ব্যবহার। গত বছরের জানুয়ারিতে মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে স্থাপিত ডাচ ডেইরিতেও দেখেছি আইওটির ব্যবহার। দেশে বৃহৎ খামার পর্যায়ে আইওটির সফল ব্যবহারের নজির গড়েছে চট্টগ্রামের নাহার ডেইরি।
জোরারগঞ্জে টুটুলের গবেষণা খামার। বিশাল এলাকা নিয়ে চলছে দেশি গরুর জাত উন্নয়নের কাজ। রেড চিটাগাং আর মুন্সিগঞ্জের দেশীয় জাতের গরুর সঙ্গে কানাডিয়ান হলেস্টিন জাতের গরুর সংকরায়ণে বেশি দুধ দেয়—এমন একটি জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা তিনি করছেন। বলছিলেন, ‘হলেস্টিন জাতের গরু থেকে দুধ পাই ৭০-৮০ লিটার। আর দেশি রেড চিটাগাং থেকে ২-৩ লিটার। হলেস্টিন জাতের গরু আমাদের দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খায় না। তাই চেষ্টা করছি রেড চিটাগাং বা মুন্সিগঞ্জের গরুর সঙ্গে ক্রস করে এমন একটি নতুন জাত উদ্ভাবনের, যাতে করে প্রতিটি গরু থেকে যেন কমপক্ষে দৈনিক ২৫ লিটার দুধ পাওয়া যায়।’ বিশাল আকারের শেডের নিচে ১০০টি রেড চিটাগাং ক্যাটল ও ১০০টি মুন্সিগঞ্জ জাতের গাভি পালা হচ্ছে। ১০ বছরের পরিকল্পনায় প্রক্রিয়াটির ইতিমধ্যে সাত বছর অতিবাহিত হয়েছে। এরই মধ্যে সাফল্য আসতে শুরু করেছে। রেড চিটাগাং জাতের গাভি থেকে জন্ম নিয়েছে সংকরায়িত নতুন জাতের ৫৭টি বাছুর। এখানে শুধু গরুর জাত উন্নয়ন নিয়েই কাজ করছেন না টুটুল, বেশ কিছু ছাগলের জাত উন্নয়নের চেষ্টাও করছেন তিনি। টুটুলের আইওটিনির্ভর ডেইরি খামারটি জোরারগঞ্জ থেকে মিনিট ত্রিশের পথ নলকোতে।
‘১৯৮৬ সালে তখন স্কুলে পড়ি। ছোট থেকেই আমার কৃষির প্রতি ঝোঁক। আপনার মাটি ও মানুষের কোনো পর্বই মিস করতাম না। মুরগির খামার গড়ে কিংবা ডেইরি খামারের প্রতিবেদনগুলো বেশ নাড়া দিত আমাকে। স্কুলে পড়তে পড়তেই ৩০০ মুরগি দিয়ে শুরু করলাম ছোট্ট খামার।’ টুটুল বলছিলেন তাঁর জীবনের গল্প।
‘৩০০ মুরগি কিনে খামার দিলাম। বাঁশ কিনে খাঁচা তৈরি করলাম। আমি তো তখনো স্কুলের ছাত্র! মা-ই দেখাশোনা করতেন। মায়ের নামে খামারের নাম রাখলাম নাহার অ্যাগ্রো। এরপর দুটি গরু কিনে শুরু করলাম ডেইরি খামার। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা। আমাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। আমি সারা জীবন ভেবেছি আমার হারানোর কিছু নেই। ৩০০ মুরগি কেনার টাকাটা থাকলেই হলো। এই ভেবে যেকোনো বড় সিদ্ধান্ত নিতে ভয় করিনি কখনো।’ কী এক দারুণ প্রত্যয়ের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন টুটুল।
টুটুলের কথাই ঠিক, উদ্যোক্তা হতে হলে রিস্ক নিতে হবে। লাভ আর ক্ষতির কিনারায় দাঁড়িয়ে যিনি ঠিক সিদ্ধান্তটি নিয়ে শ্রম আর অধ্যবসায়ে এগিয়ে যেতে পারেন, তিনিই সফল হন। টুটুলের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। ৩৫ বছরের পথচলায় কৃষিভিত্তিক সুবিশাল কার্যক্রম গড়ে তুলেছেন তিনি। এখন চার হাজার কর্মী কাজ করছেন তাঁর বিভিন্ন কৃষিভিত্তিক খামার ও শিল্পকারখানায়। আর্থিক সাফল্যও বিস্ময়কর। বছরে হাজার-বারো শ কোটি টাকার টার্নওভার।
মিরসরাইয়ের নলকো এলাকায় পাহাড়বেষ্টিত নান্দনিক এক ক্ষেত্র গড়ে তুলেছেন টুটুল। উন্নত বিশ্বের আধুনিক দুগ্ধ খামারের মতোই। আধুনিক শিল্প কলকারখানার মতোই নিরাপদ ও গোছানো চারপাশ। খামারের প্রবেশমুখে বায়োসেফটির ব্যবস্থা। ৩৫ একর জায়গায় বিশাল খামার। সারি সারি শেডে নানান জাতের গরু। টুটুল জানালেন, এই খামারে ১ হাজার ২০০টি গরু আছে। এর মধ্যে ৭০০টি দুগ্ধজাত গাভি। সব গাভির গলায় অ্যাকটিভিটিস বেল্ট রয়েছে, এর ভেতরেই রয়েছে মাইক্রোচিপস। এই মাইক্রোচিপস কম্পিউটার বা মোবাইলে পাঠাচ্ছে গাভির শারীরিক ও পারিপার্শ্বিক সব তথ্য। আধুনিক ও কারিগরি এ বিষয়গুলো পুরোপুরি রপ্ত করে নিয়ে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হচ্ছে বিশাল খামারটি।
মনে করিয়ে দেয় কোরিয়ায় চুং নামে দেখা খামারটির কথা। সেখানে যন্ত্রের সাহায্যে খাবারের উপাদানগুলো মিশিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে খাদ্য তৈরি করে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে গরুর সামনে। এখানেও সে রকমই প্রায়। খাদ্য ভরা ট্যাংক নিয়ে একটা গাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে গরুর খাবার। দক্ষিণ কোরিয়ায় কিমের খামারে যেমনটি দেখেছিলাম, খাদ্য প্রস্তুত, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের জন্য সেখানে রয়েছে পৃথক ইউনিট। এখানেও তা-ই। খাবার মজুত করে রাখার ব্যবস্থাটিও বিজ্ঞানসম্মত ও সময়োপযোগী। কাঁচা ভুট্টা সাইলেস করে বছরের সব সময় কাঁচা ঘাসের চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে অনেকগুলো পিটে। বড় বড় খামারে প্রাণিসম্পদের জন্য সারা বছরের খাদ্য সংরক্ষণের বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
সেখানে গাভি উন্মুক্ত বিচরণ করতে করতে নিজেই যখন উপলব্ধি করে তার দুধ দেওয়ার সময় হয়েছে, তখন লাইন ধরে দুধ দোহানো কেন্দ্রে উপস্থিত হয়। শুধু গাভির উপলব্ধি দিয়ে যন্ত্র সন্তুষ্ট হয় না, যন্ত্র যখন তার হিসাব দিয়ে উপলব্ধি করবে যে দুধ দোহানোর জন্য গাভি প্রস্তুত, তখনই সে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দুধ দোহানো শুরু করবে। অন্যথায় নয়। টুটুলের খামারেও একই চিত্র। আর সব স্মার্ট খামারের মতোই টুটুলের খামারেও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে দুধ দোহানোর প্রতিটি কাজ যান্ত্রিক উপায়ে চলে। দুধ দোহানোর সময় উপলব্ধি হলে গরু সারি ধরে আপনা-আপনি চলে যাচ্ছে মিল্কিং পারলারে। মিল্কিং পারলারে প্রবেশের আগে স্বয়ংক্রিয় সেন্সরে চালু হয় শাওয়ার চ্যানেল। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে সারি ধরে এক এক করে গাভি প্রবেশ করে মিল্কিং পার্কে। সেখানে অটো মেশিনে চলে দুগ্ধ দোহন। গাভির ওলানে মেশিন বসানোর আগে কঠোরভাবে মেনে চলা হয় বায়োসেফটি। জীবাণুনাশক ব্যবহার করে ওলান পরিষ্কার করে টিস্যু দিয়ে মুছে তবেই দুধ দোহানো হয়। কারণ ম্যাসটাইটিস বা ওলান ফোলা রোগ নিয়ন্ত্রণে এর চেয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। মনে পড়ছে বেলজিয়ামের ম্যাসটাইটিস ম্যানেজমেন্ট নামের এক প্রতিষ্ঠানে এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। আমাদের গ্রামের কৃষকেরাও দুধ দোহানোর আগে গাভির ওলান পরিষ্কার করে নেন। এটি খুব ভালো চর্চা। যা হোক, টুটুল জানালেন, প্রতিদিন গড়ে ছয় হাজার লিটার দুধ পাওয়া যায়। সরাসরি দুধ বাজারজাত ছাড়াও দুগ্ধজাত নানা পণ্য তৈরির ব্যবস্থাও রয়েছে তাঁর খামারে।
খামারটিতে বাছুর লালনপালন বা তদারকি দেখার মতো। একটি সুস্থ বাছুরই সুন্দর গরুর জাত ধারণ করে—এমন ভাবনা মাথায় রেখে বাছুরের শতভাগ যত্ন নিশ্চিত করছেন তিনি। বছরে ৫০০ থেকে ৬০০টি পর্যন্ত বাছুর পাওয়া যায়। খামারে মূল লাভও আসে এই বাছুর থেকেই।
কেউ যদি তাঁর কাজের ভেতর দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা, শ্রমজীবী মানুষদের প্রতি আন্তরিকতা ও শুদ্ধতা অনুসরণ করেন, তবে সাফল্য আসবেই। ছোট একটি উদ্যোগ থেকে বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড় তুলেছেন টুটুল। তাঁর সাফল্য হোক অন্যদের অনুপ্রেরণা। সুপরিকল্পনা, কাজের প্রতি সততা ও নিষ্ঠায় সাফল্য আসে।
লেখক: পরিচালক ও বার্তা প্রধান, চ্যানেল আই