‘সেন্সর’ ও ‘কন্ট্রোল’ দুটি শব্দই ইংরেজি এবং দুটি শব্দই ঔপনিবেশিক। ইংরেজ শাসনকার্য চালানোর জন্য প্রথম থেকেই উপনিবেশগুলোতে এই শব্দ দুটি চালু করে। সংবাদপত্রে, সভা-সমিতিতে সর্বত্রই সেন্সরের মাধ্যমে জনমতকে রুদ্ধ করার একটা নিয়ম চালু করা হয়। বিভিন্ন ঔপনিবেশিক যুদ্ধে পরাজয়ের কোনো সংবাদ লোকমুখেও যেন প্রচারিত না হয়, তার একটা ব্যবস্থা প্রথম থেকেই তারা করে ফেলেছিল। যুদ্ধে কতজন ইংরেজ মারা গেল, তা জানার উপায় ছিল না। কতজন দেশীয় বিদ্রোহী মারা গেল, তাতে রং ছড়িয়ে বেশ ফলাও করে প্রচার করা হতো। এই সেন্সর ও কন্ট্রোলের মাধ্যমে কখনো কখনো জনগণের মধ্যে এমন ভীতির সঞ্চার করত যে পোড়া লালমুখো সৈন্যদের ভয়ে জনগণ সিঁটিয়ে থাকত। এতে তাদের একের পর এক যুদ্ধ জয়ের জন্যও সুবিধা হয়েছিল।
কলকাতায় ইংরেজদের শোচনীয় পরাজয়ের পর যখন নবাব সিরাজউদ্দৌলা মুর্শিদাবাদে চলে গেলেন, তখন অন্ধকূপ হত্যার এক হৃদয়বিদারক কাহিনি তারা নির্মাণ করে ফেলেছিল এবং কিছুদিন আগপর্যন্ত এটি বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না। কিন্তু তথ্যের অবাধ প্রবাহের ফলে এখন দেখা যাচ্ছে পুরো বিষয়টি একটা মিথ্যা শুধু নয়, খুবই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দীর্ঘ দীর্ঘ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে তারা মিথ্যা প্রচার শিখেছিল এবং সেন্সর ও কন্ট্রোলের মাধ্যমে তারা প্রচারকার্যটি খুব সূক্ষ্মভাবে করতে পারত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অবশ্য হিটলার সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। হিটলারের অনুচর গোয়েবলস আবিষ্কার করেছিল, দশটি মিথ্যা বললেই কালক্রমে তা সত্য হয়ে যায়! ইংরেজ সেদিক থেকে আরেক ধাপ এগিয়ে। তারা নানা ধরনের কালাকানুনের মাধ্যমে আইনগতভাবে সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠা করত এবং দেশবাসীর মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করার নতুন নতুন পথ আবিষ্কার করেছিল।
সংবাদপত্র ও বই প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই খড়্গ ধরেছিল ইংরেজ। যেকোনো বই বা পত্রিকা প্রকাশ হলে তার পাঁচ কপি সরকারের একটি বিশেষ বিভাগে জমা দিতে হতো। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে গ্রামগঞ্জে নানান ধরনের কবিতা, ছড়া, যাত্রাপালা, পালাগান এবং লোকসংগীতকে আশ্রয় করে নানা ধরনের শৈল্পিক প্রতিবাদও যুগ যুগ ধরে অব্যাহত ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আমরা যাকে রেনেসাঁ বলি, সেই সময় যে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবাদ সংগঠিত হচ্ছিল, তাতেও ইংরেজ একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। একদিকে ভাষা এবং মুক্তচিন্তার বিকাশ হচ্ছিল, সাহিত্যে বড় বড় প্রতিভা এসেছিল এবং কিছুটা পাশ্চাত্যের প্রভাবে নাট্যসাহিত্য একটা উত্তরণের পথ পেয়েছিল।
সেই সময়ে ‘নীল দর্পণ’ নাটকটির রচনা এবং অভিনয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শিল্পী-সাহিত্যিকেরা সব সময়ই সমাজে একটি অগ্রগামী অংশ হিসেবে তাঁদের ভূমিকা পালন করেছেন। নাটক সাহিত্যের জন্য যতটা নয়, একটি প্রচারমাধ্যম হিসেবে তার স্থান করে নেয়। প্রথমে পৌরাণিক ধর্মবিষয়ক এবং পরে সামাজিক সমস্যাগুলো নাটকে প্রধান উপজীব্য হয়ে দাঁড়ায়। একদিকে গ্রামগুলোতে কাহিনিনির্ভর যাত্রাপালা আর অন্যদিকে শহরগুলোতে, বিশেষ করে মোকাম কলকাতায় থিয়েটার চালু হয়ে যায়। এই থিয়েটার চালু করার পেছনে অবশ্যই উঠতি বেনিয়াশ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। কিন্তু শিল্পীরা সুকৌশলে ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী নাটক নির্মাণ করে দেশপ্রেমিক মধ্যবিত্তদের চিন্তার প্রতিফলন ঘটান।
১৮৭২ সালে কলকাতায় পাবলিক থিয়েটারের সূচনা হয়। এই সময়ে ভারতবর্ষের শাসনভার ইংল্যান্ডের রাজন্য হাতে তুলে নেয়। সোনার খনি ভারতবর্ষে ইংরেজ রাজন্যদের আসা-যাওয়া বাড়তে থাকে। শিল্পবিপ্লবের পর ইংল্যান্ডে নানা ধরনের সামাজিক বিপ্লব রাষ্ট্রব্যবস্থাকে কখনো কখনো অস্থির করে তোলে। ইউরোপে বিপ্লবীদের আস্তানা গড়ে ওঠে খোদ ইংল্যান্ডে। সেই সঙ্গে পাশ্চাত্যের সাহিত্যে অনুপ্রবেশ ঘটে গেছে ভারতবর্ষে। স্বয়ং কার্ল মার্ক্স তখন লন্ডনে বসে কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো রচনা করছেন, ইউরোপ তখন কমিউনিজমের ভূত দেখেছে। এর আগেই ফরাসি বিপ্লব হয়ে গেছে। যার মূলমন্ত্র ছিল মুক্তি, সাম্য এবং চিন্তার স্বাধীনতা। ফরাসি বিপ্লবের ঢেউ ইউরোপ ছাড়িয়ে সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছিল।
১৮৭১ সালে প্যারিসে প্যারিকমিউন সংগঠিত হয়। সেই প্রথম একটি কমিউনিজম রাষ্ট্র, যদিও সেটি দীর্ঘায়িত হয়নি, তবু তা ছিল মুক্তিকামী মানুষের এক বিশাল প্রেরণা। এই সময়ে ইংল্যান্ডের প্রিন্স অব ওয়েলস কলকাতায় বেড়াতে আসেন। উঠতি ভারতীয় বেনিয়া এবং উকিল-মোক্তারদের ইংরেজ তোষণের একটা বড় উদাহরণ দেখা যায় যখন জগদানন্দ উকিলের বাড়িতে তাঁকে আপ্যায়ন করা হয় নারী, মদ ও নানা ধরনের খাদ্যসম্ভার দিয়ে। ঘটনাটি তখনকার নাট্যশিল্পীদের মধ্যে একটা বড় আলোড়ন সৃষ্টি করে। নাটক রচিত হয়—গজদানন্দ। এই নাটকে ইংরেজ প্রভু এবং তার অনুগত ভারতীয়দের নিয়ে এক প্রহসন। নাটকটি ইংরেজ এবং তাদের বাঙালি দোসরদের নজরে আসে। অভিনেতা, অভিনেত্রী, নাট্যকার সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৮৭৬ প্রণীত হয়। আইনটি যথেষ্ট কঠোর। এই আইনের বলে বহু শিল্পী কারারুদ্ধ হন।
রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮৫ সালে। কিন্তু ইতিহাসে দেখা যায় প্রথমে শিল্পী-সাহিত্যিকেরা প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং পরে রাজনৈতিক শক্তি তার সঙ্গে এসে যুক্ত হয়। আমাদের দেশের ইতিহাসও তা-ই। দেশভাগের পর ভাষা আন্দোলন এবং পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পাশাপাশি রাজনৈতিক আন্দোলনও গড়ে ওঠে। এই সময়ের সমাজের অগ্রগামী অংশ হিসেবে শিল্পী, সাহিত্যিক, ছাত্ররাই পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করেন এবং পরে তা বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। এই সময়ে ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন এসে পাকিস্তানের নড়বড়ে সংবিধানকে স্থগিত করে সামরিক কালাকানুন দিয়ে দেশ চালানোর চেষ্টা চালায় পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী। কিন্তু সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সামনে তা ধোপে টেকেনি এবং একটি রক্তাক্ত যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। খুব দ্রুতই বাংলাদেশে একটি সংবিধান রচিত হয়। সংবিধানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যেমন সন্নিবেশিত হয়েছিল, তেমনি সুদীর্ঘ ব্রিটিশ শাসন এবং চব্বিশ বছরের পাকিস্তানি শাসনের অভিজ্ঞতাকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। সংবিধানে রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ এসব বিষয় যেমন ছিল, তেমনি ছিল মত ও চিন্তাপ্রকাশের স্বাধীনতা। কিন্তু ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক এবং নিষ্ঠুর রাজনৈতিক পালাবদলের ফলে সংবিধান আবারও বুটের তলায় নিষ্পেষিত হয়। নানা ধরনের কালাকানুন দিয়ে পনেরো বছর দেশে সামরিক শাসন চলে। এই সময়ে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের প্রতিনিধিরা বারবার চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে সামনে নিয়ে আসেন।
পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে জহির রায়হানের ছবি জীবন থেকে নেয়া-কে নিয়ে সেন্সর বোর্ড একটা খেলায় মেতে উঠলেও গণ-আন্দোলনের চাপে তা কার্যকর করতে পারেনি। ছবিটি মুক্তি পেয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা হিসেবে একটা ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও কিছু কিছু পাকিস্তানপন্থী রাজনীতিক ও আমলা পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি তাঁদের আনুগত্যের কারণে পত্রপত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশনে পাকিস্তানের প্রতি পরোক্ষ সহানুভূতি প্রকাশ করেন। যে পাকিস্তান চব্বিশ বছর ধরে শোষণ চালিয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে, সেই পাকিস্তানের প্রতি কোনো ধরনের সহানুভূতি একেবারেই অন্যায় অনভিপ্রেত হলেও তাঁরা তা অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করেছেন।
ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাপী চলচ্চিত্রে সেন্সর বোর্ডের ক্ষমতা ক্ষুণ্ন হয়েছে এবং সেন্সরে সার্টিফিকেশন পদ্ধতি চালু হয়েছে। চলচ্চিত্রটি দেখার পর বোর্ড একটি সার্টিফিকেট দিয়ে থাকে, যেখানে ছবিটি কোন বয়সের দর্শকদের দেখার জন্য যুক্তিযুক্ত, তা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু চলচ্চিত্রটি ছেড়ে দেওয়া হয় দর্শকদের ওপর। কোনো ছবিকে সেন্সরের মাধ্যমে বন্ধ করার আইনগত ভিত্তি বোর্ডের থাকে না। বর্তমানে শনিবার বিকেল ছবিটি তিন বছর যাবৎ সেন্সর বোর্ড আটকে রেখেছে এবং
কী কারণে ছবিটি কার অনুভূতিকে আঘাত করবে, তা একেবারেই স্পষ্ট নয়।
বাংলাদেশের সংবিধান এবং দেশের সামাজিক পরিস্থিতি অনুধাবন করে সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, যাঁরা ইতিমধ্যেই অনেক কালাকানুন বাতিল করেছেন, তাঁরা সেন্সর বোর্ডের কানুনটি বাতিল করে ছবিটিকে অবমুক্ত করবেন। এর মধ্য দিয়ে সুদীর্ঘ শতাব্দীর পাষাণ চাপা দেওয়া সেন্সরপ্রথা বাতিল হবে।