প্রবীণ সাংবাদিক তোয়াব খান তাঁর ৮৭ বছরের বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অবসান ঘটিয়েছেন আজ। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাঁর জীবন অবসানের মধ্য দিয়ে সংবাদপত্র জগতে এক মহিরুহের পতন হলো।
তোয়াব খান তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে একাধিক সংবাদপত্রে শুধু কাজ করেননি, তিনি দুজন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের তথ্যসচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তথ্যসচিবের দায়িত্ব পালনকালে যেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তা কি তিনি বিস্তারিত লিখে গেছেন? বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার অল্প সময় আগেও তাঁর সঙ্গে তোয়াব খানের দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে।
আবার সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদেরও তিনি ছিলেন তথ্যসচিব। এরশাদ আমলেই তোয়াব খানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় এবং সেটা তোয়াব খানের মাধ্যমেই। এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর সাপ্তাহিক যায়যায়দিন পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে একপর্যায়ে আমি নিয়মিত রাজনৈতিক বিষয়ে বিশ্লেষণমূলক লেখা লিখতাম। বিষয়টা অবশ্য খুব প্রীতিকর ছিল না। সামরিক শাসনের সময় সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত হতো। দৈনিক পত্রিকাগুলোতে সাধারণত রাজনৈতিক খবরাখবর থাকত না, কারণ রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে নিষিদ্ধ ছিল। পরে রাজনৈতিক কার্যক্রম সীমিতভাবে অনুমোদিত হলেও রাজনৈতিক খবরাখবর কিংবা মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে নানা ধরনের বিধিনিষেধ মেনে চলতে হতো। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অখুশি হন, সেরকম কোনো খবর বা মতামত ছাপা ছিল অপরাধের শামিল।
সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে রাজনৈতিক কলাম লেখার দায়িত্ব আমি পেলেও ঝামেলা এড়ানোর জন্য আমার আসল নাম লুকিয়ে একটি ছদ্মনাম গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছিলেন সম্পাদক সাহেব এবং তারিখ ইব্রাহিম নামটি তিনি নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। এটা বলা নিষ্প্রয়োজন যে তারিখ ইব্রাহিমের রাজনৈতিক কলাম যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এবং স্বাভাবিকভাবেই স্বৈরশাসক এরশাদের কাছে যায়যায়দিন দ্রুতই চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল। একপর্যায়ে যায়যায়দিনের প্রকাশনা বন্ধ করা হয়েছিল। তবে দ্বিতীয় দফায় যখন সেটি প্রকাশ শুরু হয়, তারই একপর্যায়ে প্রধান সামরিক শাসকের কার্যালয় থেকে আমার ডাক আসে এবং সেটা তথ্যসচিব তোয়াব খানের মাধ্যমে। তোয়াব খান ছিলেন একজন আপাদমস্তক ভদ্র ও বিনয়ী মানুষ। তিনি উচ্চ স্বরে কথাও বলতেন না। অভিজ্ঞতা তাঁকে বিনয়ী করে তুলেছিল।
আমি এরশাদ সাহেবের রুমে ঢোকার আগে তোয়াব ভাই আমাকে অভয় দিয়ে বলেন, আমি যেন তাঁর সঙ্গে কোনো ধরনের বিতর্কে জড়িয়ে না পড়ি। এরশাদের সঙ্গে আমার কয়েক মিনিটের সাক্ষাৎকারটিতে অপ্রীতিকর কিছু ঘটেনি। এরশাদ সাহেব প্রথমেই জানতে চেয়েছিলেন আমার বাড়ি কোথায়। আমি পঞ্চগড়ের ছেলে শুনেই তিনি বলে উঠেছিলেন, ‘তুমি আমার এলাকার ছাওয়াল হয়ে কেন আমার বিরুদ্ধে লেখ?’ আমি বলেছিলাম, ‘আমি কারও পক্ষে বা বিপক্ষে লিখি না, যা সত্য তা-ই উল্লেখ করি মাত্র।’ এরশাদ সাহেব বলেছিলেন, তিনি রাজনীতিকে খারাপ মানুষদের হাত থেকে ভালো মানুষের হাতে ফিরিয়ে দেবেন। আমি বলেছিলাম, আপনার সঙ্গে যাঁদের যুক্ত করেছেন, তাঁরা তো কেউ ভালো মানুষ নন। খারাপ মানুষদের দিয়ে কীভাবে ভালো রাজনীতি আপনি করতে চান? একটুও সময় না নিয়ে এরশাদ সাহেব বলেছিলেন, ‘তোমরা যারা টেবিলের অন্য পাশে বসো, তারা যত সহজে মতামত দিতে পারো, আমি টেবিলের এপাশে বসে সেটা পারি না। ইয়ং ম্যান, মনে রাখবা, বলা সহজ, করা কঠিন। আমি একটি কঠিন দায়িত্ব নিয়েছি। আমার এই দায়িত্ব পালনে তোমরা সহযোগিতা করলে আমি খুশি হব।’ সবশেষে তিনি আমাকে বলেছিলেন, মানুষের মনে ক্ষোভ বা অসন্তোষ তৈরি হয় এমন কিছু আমি যেন না লিখি।
এরশাদ সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাতের পর তোয়াব খানের কাছ থেকে আমি বিদায় নিতে গেলে তিনি বলেছিলেন, আমার লেখা তিনি পড়েন এবং তাঁর ভালো লাগে। রাজনৈতিক মতামত লেখার ক্ষেত্রে ভারসাম্য রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন তোয়াব ভাই।
তারপর অনেক ঘটনা ঘটেছে। যায়যায়দিন প্রকাশনা নিষিদ্ধ হয়েছে, সেটা অবশ্য আমার লেখার কারণে নয়। সম্পাদক শফিক রেহমানকে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছে। এরও কয়েক বছর পর প্রবল গণ-আন্দোলনের মুখে এরশাদকে পদত্যাগ করতে হয়। এরশাদের পতনের পর দৈনিক জনকণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদকের দায়িত্ব যখন তোয়াব খান নিলেন, তখন আমাকে তিনি ডেকেছিলেন। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় জনকণ্ঠের সেই সময়ের অফিসে আমি তোয়াব খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তিনি পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে আমাকে নিয়োগও দিয়েছিলেন, কিন্তু একটি বিশেষ কারণে আমি তখন জনকণ্ঠে যোগ দিতে পারিনি। আমি এ বিষয়ে তোয়াব ভাইয়ের সঙ্গে কথা বললে তিনি আমার বিষয়টি অনুধাবন করেন এবং বলেন, আমি যেন জনকণ্ঠে নিয়মিত লিখি।
তোয়াব ভাইয়ের পরামর্শ অনুযায়ী জনকণ্ঠে আমি লেখা শুরু করি। আমার লেখা ‘মন্তব্য প্রতিবেদন’ জনকণ্ঠে প্রথম পাতায় গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে। এটা তোয়াব ভাইয়ের উদারতার কারণেই সম্ভব হয়েছিল। তিনি বয়সে আমার চেয়ে অনেক বড় ছিলেন। কিন্তু আমাকে তিনি বিশেষভাবে স্নেহ করতেন। তাঁর নেতৃত্বে জনকণ্ঠ দেশের একটি জনপ্রিয় দৈনিকে পরিণত হয়েছিল। বেশ কিছুদিন আমি জনকণ্ঠে নিয়মিত কলাম লিখেছি। এর জন্য লেখক সম্মানীও আমি নিয়মিতই পেয়েছি। একপর্যায়ে কোনো কারণে আমি আর জনকণ্ঠে লিখতে পারিনি। তোয়াব ভাই সেই সময় একাধিক দিন ফোনে আমাকে বলেছেন, আমি যখন সময়-সুযোগ পাব, তখনই যেন জনকণ্ঠে লেখা দিই।
এই তো মাস কয়েক আগেই যখন শুনলাম এই পরিণত বয়সেও তিনি নতুন করে ‘দৈনিক বাংলা’র সম্পাদকের দায়িত্ব নিচ্ছেন, তখন এই ভেবে উৎসাহিত হয়েছি যে তাঁর নেতৃত্বে দেশে একটি ভালো নতুন পত্রিকা পাঠকের হাতে যাবে। তোয়াব ভাই ছিলেন বহুদর্শী এক অভিজ্ঞ মানুষ। সংবাদপত্র জগতে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। তাঁর অভিজ্ঞতা দিয়ে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে একটি নতুন দৈনিককেও পাঠকপ্রিয় করা যায়। তিনি বয়সী মানুষ হয়েও তরুণদের সঙ্গে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। কারণ বয়সে প্রবীণ হলেও তাঁর মধ্যে নবীনের উদ্যম ও চাঞ্চল্য ক্রিয়াশীল ছিল শেষ দিন পর্যন্ত।
আমাদের দেশে এখন অসংখ্য সংবাদপত্র, সাংবাদিকের সংখ্যাও অনেক। কিন্তু বস্তুনিষ্ঠ ও মানসম্পন্ন খবর ও মতামতের অভাব এখনো তীব্রভাবে অনুভূত হয়। মানুষের চাহিদা পূরণ করার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বশীল ও রুচিসম্পন্ন সংবাদপত্র প্রকাশ কীভাবে করতে হয়, তার একজন উপযুক্ত শিক্ষক ছিলেন তোয়াব খান। তাঁর মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে একটি বিশেষ অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। সংবাদপত্র জগতে তিনি যে অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতেন, তা স্বীকার করে নিয়ে এটুকুই বলতে চাই, তাঁর শূন্যতা সহজে পূরণ হবে না।
তোয়াব ভাইয়ের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা