অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক অগ্রগতি এবং সংস্কৃতি বিকাশের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মানুষের সম্মিলিত স্বার্থ সুরক্ষার লক্ষ্যেই সার্কের প্রতিষ্ঠা। এসব উদ্দেশ্য সাধনে সদস্য-দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও আস্থার সম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন। বাস্তবে অবশ্য এর উল্টো ঘটনা ঘটছে। আঞ্চলিক বিরোধের কারণে সার্কের উদ্দেশ্যমূলক অগ্রগতির পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সুরক্ষার সম্ভাবনাকে সংকটাকীর্ণ করে ফেলেছে।
ভূ-কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ব-রাজনীতিতে নিজেকে কীভাবে লাভবান করা যায়, সংস্থাটি তা নির্ধারণ করতে পারেনি। ফলে প্রত্যাশার বিপরীত বাস্তবতা বহাল থাকায় অঞ্চলটি সবচেয়ে দরিদ্র থেকে গেছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, সার্কের ক্ষেত্রে এ রকম অচলাবস্থা সহসা সংঘটিত কিছু নয়। বেশ কয়েক বছর ধরে এর সাংগঠনিক প্রবণতা এ ধরনের পরিণতি সৃষ্টিতে প্রভাবকের ভূমিকা রেখেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক এই জোট প্রত্যাশিত মাত্রায় সফলতা না পাওয়ার ক্ষেত্রে যেসব কারণ রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ভারত-পাকিস্তান বিরোধ এবং সেই সঙ্গে ভারতের বড় ভাইসুলভ মানসিকতা সবিশেষ উল্লেখ্য। আয়তন, জনসংখ্যা ও শক্তিমত্তাসহ সবদিক দিয়েই ভারত দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্র। সার্কের অন্য সদস্য-রাষ্ট্র তাকে সন্দেহের সাথে বিবেচনা করে। আবার প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গেই ভারতের পররাষ্ট্রীয় সম্পর্ক সন্তোষজনক না হওয়ায় বিষয়টি সার্কের সফলতার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে।
প্রধানত, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের অগ্রগতির লক্ষ্যে সবচেয়ে জরুরি যে পারস্পরিক বিরোধ নিষ্পত্তি ও শক্তির ভাগাভাগি—সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতিই সবচেয়ে বেশি দায়ী। পরিতাপের বিষয়, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক পরিপূরকতায় বিস্তর ঘাটতি রয়েছে। বরং তারা মসলা, তুলা, পাট ইত্যাদির মতো সমধর্মী পণ্য নিয়ে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাওয়াকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এ ছাড়া অন্যান্য আঞ্চলিক জোটের তুলনায় এই জোটের মধ্যে আন্তঃবাণিজ্যের পরিমাণ অনেক কম, যা উপমহাদেশের অর্থনৈতিক মিশ্রণে বাধা হিসেবে কাজ করছে। মনে রাখা দরকার, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মতো সার্কও একটি অঞ্চলভিত্তিক সাধারণ বাজার।
সার্ক ও বিমসটেক—এই দুই আঞ্চলিক জোট ভৌগোলিকভাবে ওভারল্যাপ/অধিক্রমণ করে। তবুও এটা তাদের অন্য সব বিকল্পের সমান প্রমাণ করে না। সার্ক দক্ষিণ এশিয়াভিত্তিক একটি সাধারণ আঞ্চলিক জোট, যেখানে বিমসটেক দক্ষিণ এশিয়া ও আসিয়ান উভয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি আন্তঃভৌগোলিক ও আন্তঃমুখী জোট। সার্ক ও বিমসটেক তাদের আগ্রহের কিছু জায়গায় একে অন্যের সঙ্গে ওভারল্যাপ বা অধিক্রমণ করলেও সক্ষমতা ও উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে তারা পরস্পরের পরিপূরক। বলা যায়, বিমসটেক সার্কভুক্ত দেশগুলোকে আসিয়ানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে অসাধারণ এক সুযোগ করে দেয়। প্রাপ্যতা, মানুষে মানুষে সম্পর্ক ও ব্যবসার সুযোগের মতো অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি ইস্যু এমনভাবে গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা উচিত, যাতে গোটা অঞ্চল লাভবান হতে পারে। গৌরবান্বিত সীমানা বা ধারাবাহিক প্রাপ্যতার লক্ষ্যে এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এর মধ্যে কেবল সড়ক ও সেতু নয়, সমুদ্র, রেলপথ, টেলিকমসহ অন্যান্য বিষয়ও রয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা থেকে তৈরি হওয়া বিভাজিত অবস্থা নিরসন, বিতর্ক ও সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকি মোকাবিলা এবং স্বচ্ছ বিনিময় ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আন্তঃসীমান্ত দেশগুলোর নেতৃত্ব পর্যায়ে সহযোগিতা অপরিহার্য।
সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোসহ পৃথিবীর প্রতিটি দেশের স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতির জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দেয় কোভিড-১৯ নামক ভাইরাসের সর্বব্যাপী সংক্রমণ। প্রাকৃতিক এই বিপর্যয় থেকে সুরক্ষার লক্ষ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সার্কভুক্ত দেশগুলোকে একত্রিত করে সম্মিলিত পদক্ষেপ নেওয়ার উদ্যোগ নেন। এ উপলক্ষে আয়োজিত সার্ক সদস্যদের ভার্চুয়াল সেই সম্মেলন সত্যিই প্রশংসনীয় ছিল। কারণ, সার্কের নেতৃবৃন্দ ২০১৪ সালের পর আর কোনো ইস্যুতে এভাবে একত্রিত হননি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী কোভিড-১৯ মোকাবিলায় একটি স্বেচ্ছাসেবীমূলক জরুরি তহবিল গঠনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। উদ্দেশ্য ছিল—জরুরি চিকিৎসা উপকরণ ও সংক্রমণ পরীক্ষার কিট সরবরাহ সহজতর করা; অর্থাৎ, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সফল হওয়া।
করোনাভাইরাস মোকাবিলার চলমান এই মাসগুলোতে বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কাসহ সার্কভুক্ত দেশগুলো সার্ককে একটি কার্যকর সংস্থায় রূপান্তরিত করার প্রত্যাশা করছে। জাতি, ধর্ম ও সীমান্তের ভিন্নতা নির্বিশেষে সমস্ত নাগরিকের স্বার্থ ও সুরক্ষার প্রশ্নে মহামারি মোকাবিলায় সার্ক কীভাবে একটি সম্মিলিত মঞ্চ হিসেবে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, এটা স্পষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ মনে করে, কিছু বাধাবিঘ্ন ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আঞ্চলিক সংহতির লক্ষ্যে সার্ক এখনো অনেক সম্ভাবনাময়। বাংলাদেশের কাছে সার্কের গুরুত্ব তাই অসামান্য। সার্ক সনদের নীতি ও আদর্শের প্রতি বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সভা-২০১৭ তে জোর দিয়ে বলেছেন, ‘সার্ক এখনো বেঁচে আছে’। তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে স্বীকার করেছেন, ভৌগোলিক সান্নিধ্যের দরুন যোগাযোগ খাতে দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
সার্ককে তার প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্দেশ্য অনুযায়ী পরিচালিত করতে এবং মহামারি কোভিড-১৯ এর মতো নতুন নতুন পরিস্থিতি মোকাবিলায় আঞ্চলিক একটি মঞ্চ হিসেবে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে ছোট ও বড় উভয় ধরনের রাষ্ট্রের ভূমিকা আছে। এ ক্ষেত্রে ছোট রাষ্ট্রগুলোর, বিশেষত বড় দেশ হিসেবে ভারতকে বৃহৎ হৃদয় নিয়ে কাজ করতে চাপ প্রয়োগ করা দরকার। এ লক্ষ্যে বহুপক্ষীয় আলোচনার সুযোগ বহাল রাখা দরকার। ভৌগোলিক অবস্থান, আয়তন, জনসংখ্যা, শক্তিমত্তা ইত্যাদি নিরিখে ভারত দক্ষিণ এশিয়ার সর্বাধিক বিকশিত একটি রাষ্ট্র। এ হিসেবে সার্কের উদ্দিষ্ট কর্মসূচির ফলপ্রসূ পরিচালনার সম্পদ ও সক্ষমতা সবচেয়ে বেশি ভারতেরই থাকার কথা। গুরুত্বপূর্ণ এই অবস্থান ও দায়িত্বজ্ঞানের দরুন ভারতকে তার একতরফা দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করা উচিত, এবং তার চেয়ে কম শক্তিমত্তার অধিকারী ছোট ছোট দেশগুলোর আত্মনিয়ন্ত্রণ ও মুক্ত বিকাশের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখা উচিত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সার্কভুক্ত দেশগুলোর বেশির ভাগের সঙ্গেই ভারতের সীমান্ত-সংযোগ রয়েছে।
আঞ্চলিক গতিশীলতার নিরিখে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জন্য সার্ক একটি বাস্তবমুখী আঞ্চলিক প্রচেষ্টা। সার্কের মাধ্যমে সহযোগিতার ক্ষেত্র বিকশিত করতে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেকার পারস্পরিক বিরোধ ও বিতর্কসমূহ নিরসন করে এর কার্যকর পথচলা নিশ্চিত করতে হবে। অসংখ্য অপ্রত্যাশিত ত্রুটি সত্ত্বেও সার্ক কখনো পুরোদস্তুর নিষ্ক্রিয় ছিল না। অসামান্য সম্ভাবনা ধারণ করা সার্ককে আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সক্রিয় করে সামনে এগিয়ে নিতে হলে এর পথচলা বা প্রচেষ্টাকে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কৌশলগত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা উচিত হবে না। সার্কের শুকিয়ে যাওয়া ধমনিতে এখনো বিশুদ্ধ রক্তপ্রবাহের সুযোগ আছে। সবার জন্য সমান বাস্তবতা নিয়ে হাজির কোভিড-১৯ এর মতো এমন অনেক বিষয় আছে, যেগুলো মোকাবিলার মধ্য দিয়ে সম্মিলিত স্বার্থের সুরক্ষা সম্ভব এবং এটাই এখন এই সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। নিজস্ব স্বার্থ সুরক্ষার এই সচেতনতাই পারে যৌক্তিক ও কার্যকর উপায়ে বিদ্যমান সংঘর্ষকে সুযোগে পরিণত করতে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে রকম বৈরিতা বিদ্যমান, সে ধরনের বিরোধকে অন্য সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত সার্কের উপ-আঞ্চলিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে দেওয়া উচিত নয়। বরং এসব ক্ষেত্রের অর্জিত অগ্রগতি ও সাফল্য যেন অন্য ক্ষেত্রেও একইভাবে সাফল্য অর্জনে প্ররোচিত করতে পারে, সেদিকে নজর দেওয়া দরকার। এভাবেই গুরুত্বপূর্ণ একটি আঞ্চলিক জোট হিসেবে ইতিবাচকতার দিকে সার্কের কার্যকর বিবর্তন ঘটতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বাস্তবতা বিবেচনায় এটা অত্যন্ত প্রয়োজন। কারণ, আঞ্চলিক সুসম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি, স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির চালিকাশক্তি। এটা মনে রাখা দরকার যে, সার্ক কেবল এর সদস্যরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যম নয়, সার্ক এই অঞ্চলের মানুষে মানুষে সুসম্পর্ক, তাদের সংস্কৃতি ও সম্পদ বিনিময়ের মাধ্যমে সম্মিলিত সমৃদ্ধিরও গুরুত্বপূর্ণ এক আঞ্চলিক জোট।
ড. মোহাম্মদ তারিকুল ইসলাম: সহযোগী অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: t.islam@juniv.edu