ঢাকায় গত শুক্রবার কালবৈশাখী ঝড় হয়েছে। এই খবর দিয়েছে বিভিন্ন স্থানীয় সংবাদমাধ্যম। অনেকেই কাকভেজা হয়েছেন বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিভিন্ন পোস্ট দেখা গেছে। এই বান্দা নিজেও ভেজাদের একজন।
কিন্তু এক বন্ধুবর প্রতিবাদ করে বসলেন। তিনি বললেন, বিকেলে তিনি ঘুমিয়ে ছিলেন। ঘুমানোর সময় ছিল প্রচণ্ড গরম ও কাঠফাটা রোদ। ঘুম ভাঙার পর পেয়েছেন সন্ধ্যার স্তিমিত রোদ ও ঠান্ডা বাতাস। তবে আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরতে তিনি তখন দেখেননি। ফলে ঢাকায় শুক্রবার বিকেলে কালবৈশাখী হয়েছে বলে তিনি মেনে নিতে পারছেন না!
অবাক হচ্ছেন নাকি? আরে আমাদের চারপাশে এখন এমন ‘যুক্তি’সম্পন্ন মানুষ ঢের আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে এসবের বহুল চর্চা চোখে পড়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে এখন এই ধরন কিছু কিছু গণমাধ্যমেও ঢুকে পড়ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ‘ব্যাপক অনুসন্ধান’ করে প্রাথমিকভাবে ছড়িয়ে পড়া তথ্যের ঠিক বিপরীত বিষয়টি তুলে ধরা হচ্ছে।
সেটি করা যেতেই পারে। পরম সত্য বলতে পৃথিবীতে কিছুই নেই। সব সত্যের বাইরেই আরও কিছু বিষয় থাকে, যেটির কারণে সত্য তথ্যের রূপ এদিক-সেদিক হতেই পারে। কিন্তু যদি এমনটা বারবার হতে থাকে, তবে মনে হতেই পারে, ইচ্ছা করেই কালবৈশাখীর অস্তিত্ব নাকচ করার চেষ্টা হচ্ছে। কারণ, কালবৈশাখী ঝড় ও তা থেকে উদ্ভূত বিপুল বৃষ্টিপাতে ময়লা-আবর্জনা যেমন ধুয়ে যায়, তেমনি ভেতরের (রাস্তার বা পয়োনিষ্কাশনের) কঙ্কালটাও বের হয়ে আসতে পারে। তবে কি কঙ্কালের বিশ্রী হাসি ঠেকাতেই কালবৈশাখীকে অস্বীকার করা হবে?
উদাহরণ দিয়ে বোঝা যাক। যেমন ধরুন, নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যকার সংঘর্ষের বিষয়টি। সেই সংঘর্ষে দুজনের প্রাণ গেল। একজনের ক্ষেত্রে (নাহিদ) প্রাথমিকভাবে পরিবারের সদস্যদের বরাতে জানা গেল যে তিনি কর্মস্থলে যাওয়ার উদ্দেশে বের হয়েছিলেন এবং সংঘর্ষস্থলে পরে তাঁকে আহত অবস্থায় পাওয়া গেছে। হাসপাতালে নেওয়ার পর তাঁর মৃত্যু হয়। এ নিয়ে শোরগোল ওঠার কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের সামনে তুলে ধরা হলো এক নতুন তথ্য। তাতে বলা হতে থাকল, নাহিদ আসলে সংঘর্ষকারীদের একজন। সেটি প্রমাণের জন্য দেখিয়ে দেওয়া হলো একটি নির্দিষ্ট ডিজাইনের টি-শার্ট। বলা হতে থাকল—ওই টি-শার্ট পরেই তিনি ঘর থেকে বের হয়েছিলেন, ছবিতেও ওই টি-শার্ট পরা একজনকে পেছন থেকে দেখা গেছে, তাঁকে যাঁরা ওই টি-শার্ট দিয়েছিলেন, তাঁরাও বলতে থাকলেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওই কোম্পানির এই ডিজাইনের টি-শার্ট আমরাই দিয়েছিলাম’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ফলে টি-শার্টই হয়ে গেলে নাহিদের সংঘর্ষে জড়ানোর প্রমাণ।
আচ্ছা, প্রশ্ন কি তোলা যায় না যে ওই কোম্পানির ওই ডিজাইনের টি-শার্ট কি শুধু নাহিদের জন্যই বানানো হয়েছিল? আর কাউকে দেওয়া হয়নি? নাহিদের চেহারার সঙ্গে কি ছবির চেহারা প্রযুক্তির সাহায্যে মেলানো হয়েছিল? নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী বা ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দূরতম সম্পর্ক না থাকার সম্ভাবনা খালি চোখে দেখতে পাওয়া সত্ত্বেও কেন নাহিদ সংঘর্ষে জড়িয়েছিলেন? তার কারণ কি জানা হয়েছিল? নাকি ‘ব্যাপক’ অনুসন্ধানের ফাঁক গলে তা বেরিয়ে গিয়েছিল?
বর্তমানের এই দুরবস্থা জায়েজ করার ‘ট্রেন্ড’ বুঝতে হলে ওপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা জরুরি। কারণ, একই ধরনের ভুল প্রমাণের হিসাব আমরা পাই দারিদ্র্যের ক্ষেত্রেও। বেশ কিছুদিন আগে শুধু দুই বেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চেয়েছিলেন বগুড়ার মো. আলমগীর কবির। তিনি একটি বিজ্ঞপ্তিও টাঙিয়েছিলেন। আর তা নিয়েই শুরু হয় হট্টগোল। প্রায় অনেকেই উঠেপড়ে লেগেছিলেন তাঁর ভাতের কষ্ট পুরোপুরি মিথ্যা প্রমাণের জন্য। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। আর আলমগীরকে মিথ্যা প্রমাণের জন্য করা হয়েছিল ব্যক্তিগত আক্রমণও।
এ নিয়ে আলমগীরকে পুলিশের দপ্তরেও হাজিরা দিতে হয়েছিল। সাংবাদিকদের প্রশ্নবাণের মুখোমুখিও হতে হয়েছিল। এ-সংক্রান্ত ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাতে আমরা কতটা অমানবিক প্রশ্ন করতে পারি, তার চাক্ষুষ প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। কেউ কেউ তুলেছিলেন আলমগীরের ভাতের কষ্ট প্রমাণের প্রসঙ্গ। তাঁর চরিত্র নিয়ে টানাটানির চেষ্টাও হয়েছিল। কেন সে ধরনের প্রশ্ন করা হচ্ছিল, তা বোঝা গিয়েছিল ‘দেশের ভাবমূর্তি’, ‘দেশকে ছোট করার হীন প্রচেষ্টা ইত্যাদি শব্দবন্ধে।
স্থানীয় পুলিশ অবশ্য পরে জানিয়েছিল যে পোস্টার ছাপানোর ব্যাপারে আলমগীরের কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ছিল বলে মনে হয়নি। আলমগীরের চাকরির বিষয়েও সহযোগিতা করে পুলিশ। কিন্তু যে মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়াল এর আগেই হলো এবং তা যে ক্ষত তৈরি করল আলমগীরের মনে, তার মলম আবিষ্কার হয়েছে কি?
এই একই বিষয় আবার শুরু হয়েছে বাগেরহাটের পাঁচ বছরের একটি শিশুকে নিয়ে। তার চাল কিনতে শাক বেচতে রাস্তায় নামার দাবি কেউ কেউ মেনে নিতে চাইছেন না। পাঁচ বছরের শিশুটিরও ‘চরিত্র’ নিয়ে টানাটানি চলছে। ইনিয়ে-বিনিয়ে বলা হচ্ছে, ছেলেটি নাকি বখাটে! তার মা বসে বসে খেতে চায় ইত্যাদি ইত্যাদি। পাঁচ বছরের শিশুর চরিত্রের ছিদ্রান্বেষণ করে আসলে কী পাওয়া যাচ্ছে? তাকে সরকারি বা বেসরকারি যাঁরা সহায়তা দিয়েছেন, সবাই কি চিলের কান নেওয়ার কথা শুনেই দিয়েছেন? সহায়তা দেওয়ার আগে একবারও কি খোঁজখবর নেননি?
গত এক মাসে পথচলতি সময়ে বেশ কয়েকজন আমার কাছে হাত পেতেছেন। চাল-ডাল কেনার জন্যই। এক বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা যখন শুধু এক কেজি ডাল কিনে দেওয়ার আবেদন জানাচ্ছিলেন, তখন দুর্বলতায় তাঁর শরীর কাঁপছিল। সাহায্য দেওয়ার বদলে কি এখন তবে এই প্রশ্ন তুলব যে চাল চাননি যখন, তখন চাল কেনার পয়সা নিশ্চয়ই তাঁর আছে। তাহলে ডাল কিনছেন না কেন? কেন দুর্বল শরীরে আরও বেশি সময় ধরে রিকশা টানছেন না? তবেই তো ডালের পয়সা উঠে যায়!
এসব ঘটনা থেকে অন্তত বোঝা যাচ্ছে যে এ দেশে নিজের দুর্দশার কথা মায় রাস্তায় মরে পড়ে থাকার কথা তুললেও হাজারো ‘অনুসন্ধানী’ চোখ ও মুখের বাক্যবাণের সামনে অসহায় হয়ে থাকতে হবে। এসব এড়াতে চাইলে অবশ্যই দুর্দশার ইতিবৃত্ত ভুলে আপাত ‘সুখী’ হওয়ার ট্রেন্ড তৈরি করতে হবে। ধরুন, আপনার পেটে ভাত নেই, তবু ভাবতে হবে পেট মোর ভরা! ওটিই এখন সবচেয়ে নিরাপদ হয়তো।
অবস্থাদৃষ্টে বোধ হচ্ছে, এ দেশের অনেকে হয়তো ‘ডিনায়াল সিনড্রোম’-এ ভুগছে। ডিনায়াল সিনড্রোম একটি বিশেষ ধরনের মানসিক অবস্থা। এতে ভুগলে মানুষ সত্যিকারের ঘটে যাওয়া ঘটনা বা ফ্যাক্টস অস্বীকার করতে শুরু করে। মনোবিদেরা মনে করেন, এই ‘ডিনায়াল’ বা অস্বীকার আসলে ব্যক্তির একধরনের ডিফেন্স মেকানিজম। মূলত ‘অ্যাংজাইটি’ বা উদ্বেগ উদ্রেককারী বিষয়েই মানুষ এই সিনড্রোমে ভোগে। এর মূল উদ্দেশ্য থাকে অস্বীকারের মাধ্যমে সেই উদ্বেগ সৃষ্টিকারী অস্বস্তিকে মুছে ফেলা।
আমরা কি সেই কারণেই হুট করে অস্বীকারের সংস্কৃতিতে গা ভাসাচ্ছি? যদি তাতেও কারও কারও মনে শান্তি আসে, তবে খারাপ কী! মনের শান্তিই তো বড় শান্তি, তা যতই বানানো হোক না কেন!
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা