কে কার ওপর চড়ে বসছে, কে তা বুঝতে পারে? এখন চড়ার বাজার। মানুষ বাদে সবকিছুর দাম চড়া, দম চড়া, ঝাঁঝ চড়া। চড়া গলায় কে কাকে কিসের হুমকি দিচ্ছে, তার দিকে তাকানোরও ফুরসত নেই কারও। দ্রুত পায়ে হেঁটে যাচ্ছে সবাই। এই যে বাসে চড়া নিয়ে এত কিছু হয়ে গেল, কই পতন নিয়ে তো কেউ প্রশ্ন তুলল না। অথচ প্রশ্নটা পতনেরই।
জ্বালানি তেলের দাম চড়ল, সেই সূত্রে বাড়ল পরিবহন ব্যয় এবং এ দুইয়ের যোগসাজশে আরও একবার কোণঠাসা হলো মানুষ। দ্রব্যমূল্য, আর মানুষের দর বরাবর উল্টো পথের যাত্রী। নাকাল মানুষ এ নিয়ে তেমন কিছু বলল না। এমনকি গণপরিবহনের যাত্রীপ্রতি ভাড়া যে অস্বাভাবিক বাড়ল, তা নিয়েও কোনো উচ্চবাচ্য নেই। বিপাকে পড়ল নিম্ন আয়ের মানুষেরা। এও এক রকম নিত্যকার ঘটনাই। নতুন করে বলবার কিছু নেই। শুধু দু-এক জায়গায় শিক্ষার্থীদের তরফ থেকে জোর প্রতিবাদ এল।
গণপরিবহনগুলো আর শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়া নিতে রাজি নয়। তাদের সঙ্গে এ নিয়ে বেশ কয়েক দফা হয়ে গেল এখানে-সেখানে। ঢাকার রাস্তায় যারা লোকাল বাসে চড়েন, তাঁরা জানেন, এ কোনো নতুন বিষয় নয়। কিন্তু এত সব চিরাচরিত ঘটনার ভিড়ে হঠাৎ করেই এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যা ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।
এত দিন হয়তো আকারে-ইঙ্গিতে ঘটেছে, তাই কেউ নজর করেনি। কিন্তু গতকাল রোববার যখন এক শিক্ষার্থীকে হাফ পাস দিতে চেয়ে ধর্ষণের হুমকি শুনতে হয়, তখন চোখ কচলে বসে পড়েন অনেকে। তাঁরা ভাবেন, বাহ বেশ একটা নতুন কিছু হলো। কিন্তু ভুলে যান, তিনি এবং তাঁরা সবাই মিলেই এই হুমকিটি তৈরি করেছেন। প্রতিদিন নানা বয়সী নারীর ধর্ষিত হওয়ার খবরে কোনো হেলদোল না দেখিয়ে আমরা সবাই এই বিষয়টিকে অনেকটা স্বাভাবিকতা দিয়ে ফেলেছি। এ যেন কাউকে দেখে নেওয়ার মতো কোনো বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এসব হুলুস্থুলের মাঝখানে আজ খোদ সরকারের তরফ থেকে স্বীকার করে নেওয়া হলো যে, এই করোনা দুর্যোগের মধ্যে দেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন আগের চেয়ে বেড়েছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো এলাকা থেকে, কোনো না কোনো বয়সী নারী বা মেয়ে-শিশুর ধর্ষিত হওয়ার, যৌন নিপীড়নের খবর আসছে। কেউ না কেউ সবিস্ময়ে দেখছে, তার শরীরকেই লক্ষ্য বানানো হচ্ছে।
ধর্ষণ প্রসঙ্গটির এতটাই স্বাভাবিকীকরণ ঘটেছে যে, এখন বাস ভাড়া নিয়ে হওয়া বিতণ্ডাতেও অনায়াসে এ নিয়ে হুমকি দিয়ে দেওয়া যায়। একই সঙ্গে এই এক হুমকি আরও অনেক বিষয় সামনে নিয়ে আসে। ধর্ষণের সঙ্গে আদতে যে শুধু ক্ষমতার সমীকরণটি জড়িত, এ ক্ষেত্রে যৌনতা বা যৌনবোধ যে অত্যন্ত ক্ষুদ্র উপলক্ষ এবং প্রতিশোধ, ক্ষমতা ও শক্তি প্রদর্শন, আর সবচেয়ে বড় কথা নির্যাতন স্পৃহাই যে যুক্ত, তা অন্তত এই ঘটনার পর আর বিষদে বর্ণনার কিছু নেই।
হুমকিদাতা পরিবহন শ্রমিক ও ওই বাসের চালক উভয়েই গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একটু কলার নাচাতেই পারে। কিন্তু এই গ্রেপ্তার হওয়া-না হওয়াতে মূল প্রশ্নটি হাওয়া হয়ে যায় না। এই অভিযোগগুলোও হাওয়ায় মিলিয়ে যায় না যে, বিশেষত ছাত্রীদের বাসে ওঠার ক্ষেত্রে ঝক্কি বেশি পোহাতে হয়। গণপরিবহনে নারীদের হেনস্তার হাজারটা ধরনের কথা মাথায় রেখেই এই এটুকু প্রসঙ্গের উল্লেখ করা হচ্ছে। যে কিশোরী বা বালিকা বা তরুণী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার উদ্দেশে ঘর থেকে বের হলো, তার জন্য কোন পরিবহন রেখেছি আমরা? মাঝখানে একটা সময় শুধু ছাত্রীদের জন্য আলাদা বাসের ব্যবস্থা দেখা গেছে, দেখা গেছে কর্মজীবী নারীদের জন্য পৃথক পরিবহন ব্যবস্থার। কিন্তু এসবের কোনোটিই সমাধান আনতে পারেনি। কারণ, পুরুষ নামক প্রাণীটি সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শুধুই জান্তব হয়েছে। তার হাত থেকে বাঁচতে নারীকে ক্রমাগত খাঁচায় ঢুকতে হয়েছে। এটা অনেকটা ঢাকা শহরের সিএনজিচালিত অটোরিকশার মতো বাস্তবতা। চোর ও ছিনতাইকারীর হাত থেকে বাঁচতে এই যানবাহন নিজেই একটি খাঁচায় পরিণত হয়েছে। এ খাঁচায় যে থাকে, সে মানুষ, আর বাইরের দুনিয়া যেন পুরোটাই অপরাধী। যেন খাঁচায় ঢুকলেই অপরাধ মুছে গেল। কিন্তু অপরাধ তো এভাবে মুছে যায় না মুছে যাওয়ার নয়।
একইভাবে নারীকে পৃথক করে, নারীর জন্য পৃথক ব্যবস্থা করে নারীর ওপর পুরুষের অপরাধের মীমাংসা হয় না। এভাবে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে অপরাধের পথটিকে আরও বেশি নিরাপদ করে তোলা হয়। গত কয়েক দশকে এ কাজটিই হয়েছে। তা না হলে নব্বইয়ের দশকে ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা যখন গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিতে পারে, যখন সে সময়ের প্রতিটি পড়তে পারা শিশুর মগজেও ইয়াসমিন এক দুঃখের নাম, এক হাহাকারের নাম হয়ে উঠতে পারে, তখন আজকের প্রতিদিনের ইয়াসমিনেরা হারিয়ে যাচ্ছে কোথায়, কেন?
এবং এই সব জেনেবুঝেও আমরা স্থির হয়ে থাকব। না নড়ব, না চড়ব। কারণ, চড়ার কথা শুনলেই আমাদের মাথায় কাজ করবে বাসে চড়ার কথা। আর সেই সূত্রে ‘ধর্ষণ’ শব্দটা আমাদের মনে পড়ে যাবে। কিন্তু যেহেতু আমরা নিরুপায় এবং শুনতে পাচ্ছি ‘চড়চড়’ সেই শব্দ, যা কানের পর্দা ফাটিয়ে দেওয়ার মতো সজোর এবং অসভ্যের মতো ধারাবাহিক। যেন শুকনো কাঠের মতো ফেটে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে সব। কিংবা আগুনে আত্মাহুতি দিয়ে চড়চড় করে পুড়ে যাচ্ছে, যা কিছু দৃশ্যমান। এই পোড়া দৃশ্যের ভেতরে বসেই আমরা নিতান্ত অন্ধের মতো সাজিয়ে তুলছি, যেন কিছুই হয়নি, যেন ওই শিক্ষার্থী শুধু বদরুন্নেসার, যেন শিক্ষার্থী বলে আদতে কেউ ছিলই না, যেন আমরা অন্য কোনো শহরে, অন্য কোনো দেশেই থাকি। আর এভাবে আমরা যাকে, যে ঘটনাগুলোকে ঘৃণা করি বলি, তাকেই লালন করি, পেলে-পুষে বড় করি। আমাদের ধৈর্যেরও বলিহারি!