হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

মোড়ক নতুন, পণ্য পুরোনো

বিভুরঞ্জন সরকার

আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২৩, ১৩: ০৫

বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি বা বিডিপি নামের একটি নতুন রাজনৈতিক দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য আবেদনের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর রাজনৈতিক মহলে কৌতূহল দেখা দিয়েছে। এটা আসলেই নতুন কোনো রাজনৈতিক দল নাকি নতুন মোড়কে পুরোনো মাল মানুষের সামনে হাজির করার কৌশল, সে প্রশ্নও উঠছে। বলা হচ্ছে, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এটা জামায়াতে ইসলামীর একটি কৌশল। কেন এমনটা মনে করা হচ্ছে? কারণ নতুন এই দলের যে কয়জন নেতার নাম ইসিতে দেওয়া হয়েছে, তাঁরা সবাই জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। বড় পদাধিকারী না হলেও তাঁদের গায়ে কোনো না কোনোভাবে জামায়াতের ছাপ আছে। তবে জামায়াত বলছে, না, তারা নতুন এই দলে নেই, তারা জামায়াত নামেই আছে।

নতুন দলটি নিবন্ধিত হতে পারবে কি? এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীরের একটি বক্তব্যকে ইঙ্গিতপূর্ণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। ভিন্ন নামে আবেদনের ভিত্তিতে জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধন পেতে পারে, এমন ইঙ্গিত দিয়ে নির্বাচন কমিশনার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আবেদনকারী দলের কেউ যুদ্ধাপরাধী না হলে, তাদের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হলে এবং সব শর্ত পূরণ করে ভিন্ন নামে তাদের নিবন্ধন পেতে বাধা নেই।’

নির্বাচন কমিশনারের এই বক্তব্য ধরে এমনও বলা হচ্ছে যে এই নতুন দলের পেছনে সরকার বা সরকারের কোনো এজেন্সিরও ভূমিকা থাকতে পারে। আগামী নির্বাচনে বিএনপি শেষ পর্যন্ত অংশ না নিলে এই নতুন নিবন্ধিত দলকে কাছে টানার কৌশল সরকারের থাকলেও থাকতে পারে। অবশ্য আওয়ামী লীগের মধ্যে এখনো যাঁরা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ধারার সমর্থক এবং নাগরিক সমাজের অনেকেই নাম বদলালেও জামায়াতকে রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়ার বিরোধী। জামায়াতের বিরোধিতাকারীরা মনে করেন, কালসাপ খোলস বদলালেও তার স্বভাব বদলায় না। জামায়াতও তেমন। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতার কারণে ১৯৭২ সালে জামায়াত নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান তাদের রাজনীতি করার সুযোগ দিলে তারা ‘ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ’ বা আইডিএল নামে রাজনীতি শুরু করে।

পরে সুযোগ বুঝে আবার জামায়াত নামে ফিরে আসে। সুযোগসন্ধানী এই দলটি আবারও সেই পুরোনো কৌশল নিয়েছে কি না, তা দেখার বিষয়। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার জন্য প্রকাশ্যে জাতির কাছে ক্ষমা না চাইলে, মওদুদীর আদর্শ থেকে সরে না এলে এবং ধর্মের নামে সন্ত্রাসের পথ ত্যাগ না করলে, তাদের রাজনৈতিক সুযোগ না দেওয়াই শ্রেয়।

 
বিডিপি নামের নতুন এই রাজনৈতিক দলের চেয়ারম্যান আনোয়ারুল ইসলাম চান ও জেনারেল সেক্রেটারি মুহা. নিজামুল হক নাঈম। এই দুই নেতার নাম আগে খুব বেশি কেউ শুনেছেন বলে মনে হয় না। এমনকি রাজনৈতিক বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন—এমন বিশ্লেষক-গবেষকেরাও তাঁদের নাম সম্ভবত শোনেননি। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, আনোয়ারুল ইসলাম চান জামায়াতের ঢাকার ডেমরা থানার আমির আর নিজামুল হক নাঈম ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কর্মপরিষদ সদস্য ছিলেন। থানা পর্যায়ের একজন নেতাকে প্রধান করে কেন একটি নতুন দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল, কোন রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে এই সদ্য ভূমিষ্ঠ দলটি ভূমিকা পালন করবে—এসব প্রশ্ন সংগত কারণেই উঠছে।

জামায়াতের সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করে বিডিপির সেক্রেটারি জেনারেল নিজামুল হক নাঈম বলেছেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা সম্পূর্ণ নতুন একটা দল। বাংলাদেশের সংবিধান মেনেই আমরা রাজনীতিতে এসেছি। সংবিধানের প্রতিটি শব্দকেই আমরা সম্মান করি এবং সেটাকে লালন করেই আমরা রাজনীতি করি।’

জামায়াত থেকে পদত্যাগ করে এসেছেন কি না—জানতে চাইলে নতুন দলের এই নেতা বলেছেন, ‘অনেক দিন আগে শিবিরের রাজনীতি করেছি। সেখানে পদত্যাগের কোনো ব্যবস্থা নেই। আর অনেকেই দল পরিবর্তন করেন, এটা তো করতেই পারেন। আমরা এখন নতুন রাজনৈতিক দল নিয়েই ভাবছি, সবার সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই চলব।’

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট। এর পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। নিবন্ধন বাতিলের পর ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিছু আসনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন জামায়াতে ইসলামীর নেতারা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দলটির অনেক সিনিয়র নেতার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর থেকে চাপে আছে দলটি। তবে জামায়াত আগাগোড়াই একটি অত্যন্ত কৌশলী দল। কৌশল করেই দলটি আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বিশেষ অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। জামায়াতকে বাদ দিয়ে রাজনীতির ছক কেউ যদি কষতে চান, তাহলে ভুল হবে। নিবন্ধন বাতিল হলেও জামায়াত কিন্তু নিষ্ক্রিয় বসে নেই; বরং এটাই হয়তো ঠিক যে দেশে জামায়াতই হলো এখন সবচেয়ে বেশি সংগঠিত রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা যখন মুখে কথার খই ফুটিয়ে বাজিমাত করার রাজনীতিতে ব্যস্ত, তখন জামায়াত মাঠপর্যায়ে কাজ করছে কোনো উচ্চবাচ্য না করে। জামায়াতের নারী কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারীদের মধ্যে জামায়াতের ‘দাওয়াত’ পৌঁছে দিচ্ছেন। দেশের বেশ কিছু অঞ্চলে জামায়াত যেকোনো রাজনৈতিক দলকে চ্যালেঞ্জ করার শক্তি অর্জন করেছে বলে মনে করা হয়।

সরকারি চাপ এড়ানোর জন্য জামায়াত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানকেও তারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা থেকে বিরত হয় না। জামায়াত এখন কোণঠাসা হয়ে পড়েছে কিংবা তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে মনে করে যাঁরা স্বস্তি বোধ করছেন, তাঁরা মাঠে নামলে বুঝতে পারবেন জামায়াত কীভাবে তাদের শক্তি সংহত করছে। জামায়াত নিজ নামে যেমন সক্রিয় আছে, তেমনি অন্য দলের মধ্যেও ঢুকে পড়ছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে জামায়াতের অনুপ্রবেশ ঘটেছে আশঙ্কাজনকভাবে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা টাকা খেয়ে জামায়াতকে দলে জায়গা করে দেন আর জামায়াত টাকা দিয়ে ওই দলগুলোকে নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্যে প্রভাবিত করে। জামায়াতের সবলতার দিক হলো এই দলের কেউ দলত্যাগী হলেও আদর্শচ্যুত না হয়ে বরং যে দলে যান, সেই দলকে জামায়াতীকরণ করতে ভূমিকা পালন করেন। বিএনপি যে এখন জামায়াতকে ছাড়তে পারে না, তার বড় কারণ, দলটির অনেকেই জামায়াতের মত ও পথের অনুসারী হয়ে আছেন। আওয়ামী লীগের মধ্যেও কেউ কেউ আছেন, যাঁরা জামায়াতের চেয়ে কমিউনিস্টদের খারাপ মনে করেন।

নির্বাচন সামনে রেখে এবার জামায়াত অনেক সতর্কতার সঙ্গে কৌশল ও পরিকল্পনা কষতে শুরু করেছে। নির্বাচন যে পদ্ধতিতেই হোক না কেন, আগামী পার্লামেন্ট যাতে জামায়াতি আদর্শের প্রতিনিধিশূন্য না থাকে, সে চেষ্টাই দলটি করছে। গত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে জামায়াত এবার আরও সতর্কতার সঙ্গে পথ চলছে। অন্য রাজনৈতিক দলের থেকে জামায়াতের পার্থক্য হলো, অন্যরা অতীতে ঠেকেও কিছু শেখে না, আর জামায়াত ঠেকে এবং শেখে। গত নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি ‘প্রতারণা’ করেছে বলে মনে করে দলটি। কারণ আলোচনায় জামায়াতকে ৩২টি আসন দেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলেও শেষ পর্যন্ত প্রতীক দিয়েছে ২২টির। নিজ দলের নিবন্ধন না থাকায় বিএনপির সব সিদ্ধান্ত তাদের মেনে নিতে হয়েছে। এবারের নির্বাচনে জামায়াত একটি নির্ভরযোগ্য মিত্র দল চায়। আইনি লড়াইয়ে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন ফেরত পাওয়ার চেষ্টা সফল না হলে দ্বিতীয় কৌশল হিসেবে ভিন্ন নামে নিবন্ধনের চেষ্টা করা হবে। তাতেও ব্যর্থ হলে ছোট কোনো নিবন্ধিত দলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে, সেই দল থেকে প্রার্থী হবেন জামায়াতের নেতারা। এই কৌশলের অংশ হিসেবেই বিডিপির নিবন্ধনের আবেদন কি না, সে প্রশ্ন উঠেছে।

এর আগে ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল পদ থেকে পদত্যাগ করেন লন্ডনে অবস্থানরত ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। এরপর ১৬ ফেব্রুয়ারি শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে দল থেকে বহিষ্কার হন ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মুজিবুর রহমান মঞ্জু। এরপরই জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতাকে নিয়ে ‘জন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’ নামে একটি প্ল্যাটফর্মে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক ও মুজিবুর রহমান মঞ্জু। ২০২০ সালের ২ মে আমার বাংলাদেশ পার্টি বা এবি পার্টির আত্মপ্রকাশ হয়। এরও উদ্যোক্তা জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের একদল সংস্কারপন্থী নেতা-কর্মী, যাঁরা একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার জন্য জামায়াতের ক্ষমা না চাওয়া এবং দলটির বাস্তবভিত্তিক সংস্কারের পদক্ষেপ না নেওয়ায় ক্ষুব্ধ ছিলেন। তখনো মনে করা হয়েছিল, জামায়াত থেকে অনেকে এবি পার্টিতে যোগ দেবেন। জামায়াতের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্যের নামও শোনা গিয়েছিল। কিন্তু গত দুই বছরে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রাজ্জাক ও কেন্দ্রীয় মজলিশে শ‌ুরার সদস্য সাবেক সচিব এ এফ এম সোলায়মান ছাড়া উল্লেখযোগ্য কেউ যোগ দেননি।

রাজনৈতিক দল হিসেবে যাত্রার শুরুতেই গত বছরের অক্টোবরে ভাঙনের মুখে পড়ে এবি পার্টি। দলের বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা আকস্মিক দল ছেড়ে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টিতে যোগ দেন। এর পেছনে জামায়াতের পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন এবি পার্টির নেতারা। এবি পার্টির পরিণতি নতুন দল বিডিপির ক্ষেত্রেও ঘটবে, নাকি সত্যি কোনো চমক তৈরি হবে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা factcheck@ajkerpatrika.com

‘দারিদ্র্য নিরসন’ কথাটায় তিনি বিশ্বাস করতেন না

উচ্চমূল্যেও গ্যাস পাওয়ার নিশ্চয়তা আছে কি

সাধারণ নাগরিকের সংবিধান ভাবনা

গণতন্ত্র কি সোনার হরিণ