গত কয়েক দিনের বিভিন্ন পত্রপত্রিকার খবর ও সামাজিক গণমাধ্যমের সূত্র ধরে জানলাম অনলাইন ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে বাংলাদেশ থেকে শীর্ষস্থানে আছে ভিকি জাহেদ পরিচালিত বহুল আলোচিত নাটক ‘পুনর্জন্ম ৩’। ‘পুনর্জন্ম ৩’ হলো ‘পুনর্জন্ম’ ও ‘পুনর্জন্ম ২’-এর সিক্যুয়েল। দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলোসহ অনলাইন নিউজপোর্টালগুলোতে বলা হচ্ছে চারদিকে ‘পুনর্জন্ম ৩’-এর জয়জয়কার এবং ট্রেন্ডিংয়েও শীর্ষে রয়েছে দেশীয় এই সিরিজ। আমার মতে, ডার্ক থ্রিলারধর্মী এই সিরিজের গল্পের সব থেকে উল্লেখযোগ্য দিক হলো ‘ক্যানিবালিজম’ বা মানুষের মাংস ভক্ষণ। আর এ কারণেই আমার এই লেখার অবতারণা।
ধারাবাহিকটি এতই জনপ্রিয়তা পেয়েছে যে প্রশংসা সবার মুখে মুখে! ভিকি জাহেদ পরিচালিত নাটকটি এই লেখা লেখার আগপর্যন্ত আমি দেখিনি। লিখব বলেই দেখতে বসলাম ‘পুনর্জন্ম’, ‘পুনর্জন্ম ২’ ও ‘পুনর্জন্ম ৩’। গত বছর কেন দেখিনি সিরিজটি? ইচ্ছে করেই দেখিনি। আমার পরিচিতজনদের গল্প শুনে, পত্রপত্রিকায় পড়ে জেনেছিলাম নাটকটিতে মানুষের মাংস কেটে রান্না করে খাওয়ানো হয়েছে। আর একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে এখানেই যত আপত্তি আমার। বাংলাদেশের পাবলিক ও প্রাইভেট পর্যায়ে সহিংসতার যে বাস্তবতা, যে দেশে মানুষকে কেটেকুটে টুকরো করে বস্তায় বন্দী করে বুড়িগঙ্গার পানিতে ফেলে দেওয়া হয়, সেই দেশে ফিকশন ও থ্রিলারের মসলা মাখিয়ে অন্যতম উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিকৃত মানসিকতাকে। ‘পুনর্জন্ম নাটকের গল্প শুনে এবং দেখে আমি রীতিমতো আঁতকে উঠেছি! আমি ভয় পাই এই জন্য না যে, আমি ডার্ক থ্রিলার দেখার মতো কঠিন চিত্তের মানুষ নই। আমার চিন্তা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে! আমার ভয় হলো মানুষ এখন এমনিতেই প্রতিহিংসাপরায়ণ! কথা নেই বার্তা নেই, মানুষ খুন করতে এক সেকেন্ড সময় লাগে না। এর মধ্যে মানুষ মেরে রেস্টুরেন্টে খাওয়ানো যায় এমন কুৎসিত বুদ্ধি কুৎসিত মানুষের মগজে ঢুকতে সময় লাগবে না। মানুষ মেরে প্রমাণ ঢাকতে সেটা নদীতে না ফেলে রেস্টুরেন্টে চালান দিয়ে দেবে। একটুও বুক কাঁপবে না ওসব কুৎসিত মানুষের। পাচার করা, ছেলেধরা, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অনেক দামে বিক্রি করার বিষয়গুলোতে ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি, নাটক সিনেমাতেও দেখেছি এগুলো। পরবর্তী সময়ে এগুলো যে ঘটে, সেটারও অনেক তথ্য-উপাত্ত দেখেছি মানব পাচারবিষয়ক গবেষণা করতে গিয়ে। আজ মানুষের মাংস রান্না করে খাইয়ে দেওয়া হচ্ছে নাটক-সিনেমায়, কাল যে এটা বাস্তবে ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কি? নিঃসন্দেহে পুনর্জন্মের গল্প শুনেই আমার একধরনের ট্রমা কাজ করেছে। ইচ্ছে করেই ওটা আমি আগে দেখিনি।
আগেই বলে রাখি, ব্যক্তিগতভাবে নির্মাতা ভিকি জাহেদ, প্রযোজক কিংবা নাটকের কলাকুশলীদের ওপর আমার কোনো আক্রোশ নেই। নিঃসন্দেহে ভিকি জাহেদ অত্যন্ত মেধাবী একজন নির্মাতা। তাঁর পরিচালিত অনেক কাজ আমি দেখেছি। ‘রেডরাম’, ‘চম্পা হাউজ’, ‘অক্ষর’, ‘কায়কোবাদ’, ‘ঘুণ’, ‘দুরবিন’ নাটকগুলোর নির্মাণশৈলী অনেক উঁচু মানের। বাংলাদেশের নাটক বা সিরিজ নির্মাণের যে পালাবদলের ইতিহাস, সেখানে ভিকি জাহেদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে আমি মনে করি। আর একটু বলে রাখি, বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের নাটক কিংবা ওয়েব সিরিজগুলো প্রশংসার দাবি রাখে। এই নাটকগুলোর সিনেমাটোগ্রাফি, কলাকুশলীদের মেকআপ, পোশাক পরিকল্পনা, শুটিং স্পট—সবই বেশ বাস্তবধর্মী। বাংলাদেশের বর্তমানের নাটকগুলো এখন শুধু একটি শ্রেণির ভাষা ও পোশাকে আবদ্ধ নেই। আমি যখন ‘কাইজার’, ‘কারাগার’, ‘রেডরাম’, ‘মুন্সিগিরি’, ‘মরীচিকা’, ‘সিন্ডিকেট’-এর মতো রহস্য ও থ্রিলার ধারাবাহিকগুলো দেখি, আমার খুব ভালো লাগে। গর্ব করি আমার দেশের নির্মাতা-কলাকুশলীদের কাজ দেখে। শুধু রহস্য ও থ্রিলারই নয়, এখনকার নাটকের বিষয়বস্তুতে নানা শ্রেণি-পেশাকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। যৌনকর্মী, সমকামিতা, বিবাহবিচ্ছেদ, পোস্ট ডিভোর্সড, সন্তান লালন-পালন, মানসিক স্বাস্থ্যসহ নানা সংবেদনশীল বিষয় কোনো রাখঢাক না করেই দেখানো হচ্ছে। এগুলো প্রশংসার দাবি রাখে।
কিছুদিন আগে আমি ‘শুক্লপক্ষ’ নামে একটি নাটক দেখতে বসি। নাটকটি দেখতে ভালো লাগছিল। আজকাল গোয়েন্দাকাহিনি, রহস্যকাহিনি বা থ্রিলার টাইপ নাটকগুলোর গুণমান দেখে ভীষণ ভালো লাগে। তো নাটকটি দেখতে থাকলাম। রহস্য উদ্ঘাটন হবে, টানটান উত্তেজনা। কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় ছিল, সেখানে গিয়ে আমার রাত পোহাল। নাটকের শেষাংশে গিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে সেই ‘পুনর্জন্ম নাটকের আফরান নিশো চরিত্রটির আবির্ভাব। যেখানে তিনিই সেই বিখ্যাত শেফ বা প্রধান বাবুর্চি, যার কাছে বিশ্বাসঘাতক মেয়েদের মেরে মাংসের জোগান দিচ্ছে একজন শিক্ষানবিশ বাবুর্চি। নাটকের চরিত্রগুলোর সাইকোঅ্যানলিসিস বা জেন্ডারবিষয়ক তাত্ত্বিক বিষয়াদি আলোচনায় আজ আমি যাব না। ইশ, কী বীভৎস লেগেছিল সেই রাতে! মানুষের মাংস কেটে পিস পিস করে বক্সে ভরে নিয়ে এসেছে। সেখানে শরীরের কোন অংশের স্বাদ কেমন সেটাও বর্ণনা করা হয়েছে। ‘ক্যানিবালিজম’ বা মানুষের মাংস ভক্ষণ নিয়ে বাংলা ভাষায় বানানো আমার দেখা ধারাবাহিক এটাই প্রথম নয়। ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি’ ওয়েব সিরিজের মুশকান জুবেরীকেও দেখানো হয়েছে ক্যানিবাল চরিত্রে।
তাই নাটক বা সিনেমায় যখন একটি মেয়েকে অত্যন্ত রোমান্টিকভাবে, শৈল্পিকভাবে গণধর্ষণ করা দেখানো হয় কিংবা স্বামী কর্তৃক জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপনের (বৈবাহিক ধর্ষণ) চিত্র দেখায়, আর দর্শক যখন কী ঘটনা ঘটল তার ভালোমন্দ যৌক্তিক বিচার-বিবেচনার সামর্থ্য হারিয়ে তার ‘প্রিয় অভিনেতা’ ওই চরিত্রে কত ‘ভালো’ অভিনয় করল সেটা নিয়ে বাহবা দেয়—আমি তখন চিন্তিত হই। কারণ নাটক-সিনেমা মানুষের জীবনের দর্পণ। তাই সেখানে নির্মাণশৈলীর বাইরে গিয়ে দর্শককে কী দেখানো হলো আর কেমন দর্শক তৈরি করল, দর্শক কী প্রশ্ন করতে শিখল, আর দর্শক সেই শিক্ষা সমাজের কোথায় কাজে লাগাল, সেটা বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে।
পুনর্জন্ম বা শুক্লপক্ষে কী দেখাল আর কী দেখলাম, দর্শকের উচ্ছ্বাস, ট্রেন্ডিংয়ের শীর্ষে ‘ক্যানিবালিজম বা মানুষের মাংস ভক্ষণ’—এগুলোর জট মেলানো কঠিন। এরই মধ্যে আবার শোনা গেল, ‘হাওয়া’ সিনেমার বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়েছে। পত্রিকায় পড়লাম (ডেইলি স্টার, ২৩ আগস্ট ২০২২) আইন ভেঙে বন্যপ্রাণী খাঁচায় বন্দী ও হত্যার অভিযোগে আলোচনায় সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘হাওয়া’। মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত সিনেমাটির বিরুদ্ধে বন্যপ্রাণী আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। উল্লেখ করা হয়েছে, সিনেমাটির একটি দৃশ্যে একটি পাখি হত্যা করে চিবিয়ে খেয়েছেন অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী। সেখানেই বিপত্তি ঘটেছে। বন বিভাগ ভীষণ মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে।
মোট কথা, ‘শুক্লপক্ষ’ কিংবা ‘পুনর্জন্ম’ নাটকের বিকৃত মানসিকতা, ক্যানিবালিজম ও নারী বিদ্বেষের যে রূপ ফুটে উঠেছে; মানুষ সেগুলোকে পছন্দ করছে, উচ্ছ্বসিত হয়েছে—এটা ভেবেই আমি শিহরিত হচ্ছি। এ যেন চারিদিকে ‘মানুষের মাংস ভক্ষণ’ নিয়ে ভক্ত, নির্মাতা-শিল্পী ও কলাকুশলীদের উচ্ছ্বাসের সমান্তরালে আমার ভীতিকর শিহরণ।
লেখক: ম্যানেজার, অ্যান্টি-ভায়োল্যান্স প্রোগ্রাম, সাখি ফর সাউথ এশিয়ান ওম্যান এবং শিক্ষক, স্টেট ইউনিভার্সটি অব নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র