মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করতে গিয়ে মানুষ যেসব অর্থনৈতিক লেনদেন সম্পাদন করে, এর মধ্যে ঋণ ব্যবস্থাপনা একটি। মানুষ তার নিজস্ব আয়ের মাধ্যমে যখন প্রয়োজন মেটাতে পারে না, তখন অন্যের দ্বারস্থ হয়ে ঋণ গ্রহণ করে। ঋণ গ্রহণ ও ঋণ প্রদান পদ্ধতিকে ইসলামে ঋণ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি বলা হয়। ঋণ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির বিবরণ দিয়ে আল্লাহ তাআলা সুরা বাকারার ২৮২ নম্বর আয়াতে বলেন, ‘হে মুমিনগণ! যখন তোমরা কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঋণের আদান-প্রদান করো, তখন তা লিখে রাখো এবং তোমাদের মধ্যে কোনো লেখক ন্যায়সংগতভাবে তা লিখে দেবে।’ বৃহদাকার হওয়ায় আয়াতটি উল্লেখ না করে তা থেকে ঋণ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত যে নীতি-পদ্ধতি নির্গত হয়েছে, তা ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করা হলো:
১. লিখিত আকারে প্রমাণ রাখা, যাতে ভুল-ভ্রান্তি না হয় এবং পরবর্তী সময়ে কোনো পক্ষ অস্বীকার করতে না পারে।
২. ঋণের সময়সীমা উল্লেখ করা। অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঋণ আদান-প্রদান করা বৈধ নয়। ইসলামি আইনবিদগণ বলেন, সময়সীমা এমনভাবে নির্দিষ্ট করতে হবে, যাতে কোনোরূপ অস্পষ্টতা না থাকে। তাই লেখার সময় মাস, দিন ও সময় উল্লেখ থাকতে হবে। যেমন: কেউ বলল, ধান কাটার সময় ঋণ পরিশোধ করব। কিন্তু আবহাওয়ার কারণে ধান কাটার সময় কিছুটা বিলম্ব হলো। ফলে ঋণদাতার সঙ্গে গ্রহীতার মনোমালিন্য হতে পারে এবং অবিশ্বাসেরও সৃষ্টি হতে পারে।
৩. যাঁরা এ চুক্তি লিখবেন, তাঁরা যেন ন্যায়পন্থায় লিখে রাখেন। অর্থাৎ লেখক কোনো এক পক্ষের লোক হতে পারবেন না; বরং নিরপেক্ষ হতে হবে, যাতে কারও মনে সন্দেহের সৃষ্টি না হয়।
৪. ঋণগ্রহীতার দায়িত্বে এ লেখনীর কাজ সম্পাদন হবে এবং এটিই তাঁর জন্য স্বীকারোক্তি। আর যদি ঋণগ্রহীতা বোবা, বোকা অথবা পাগল হন, তবে তাঁর পক্ষে একজন অভিভাবক বা জামিনদার লাগবে, যিনি তাঁর পক্ষ হয়ে সব কাজ সম্পাদন করবেন।
৫. দলিলের সমর্থনে দুজন পুরুষ অথবা একজন পুরুষ ও দুজন নারী সাক্ষী লাগবে। যদি দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে কখনো কলহ দেখা দেয় এবং তা আদালতে উপস্থাপিত হয়, তবে তা সাক্ষীর মাধ্যমে সাব্যস্ত হবে। যেমন এখনকার আদালতেও লেখনীর পাশাপাশি সাক্ষীদের সাক্ষ্যের মাধ্যমে কোনো বিচার ফয়সালা করা হয়।
৬. সাক্ষীগণ অবশ্যই মুসলমান ও ন্যায়পরায়ণ হবেন। যাঁদের কথার ওপর আস্থা রাখা যায়। ফাসিক ও পাপী ব্যক্তি সাক্ষী হতে পারেন না।
৭. এমন ব্যক্তিরা সাক্ষী হবেন, যাঁরা শরিয়তসম্মত কারণ ছাড়া সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করবেন না। কারণ, এটি অস্বীকৃতির শামিল এবং প্রকাশ্য গোনাহর কাজ।
৮. সাক্ষীদের কোনোভাবে বিরক্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে না। যেকোনো উপায়ে তাঁদের ওপর প্রভাব খাটানো তাঁদের বিরক্ত করার শামিল এবং পথখরচ না দেওয়া ক্ষতিগ্রস্ত করার শামিল। এগুলো তাঁদের ন্যায্য অধিকার।
৯. লেনদেন যদি এমন বস্তুর মাধ্যমে হয়, যার সংখ্যা নিরূপণ করা যায়, তবে বস্তুটি গণনার মাধ্যমে হস্তান্তর করতে হবে, আর যদি গণনা করা না যায়, তবে পাত্র বা দাঁড়িপাল্লা দ্বারা পরিমাপ করে দিতে হবে। অনুমান করে অথবা স্তূপাকারে প্রদান করা বৈধ নয়। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি বাইয়ে সালামের লেনদেন করে, সে যেন নির্ধারিত পরিমাণ, নির্ধারিত ওজন এবং নির্ধারিত সময়ের ভিত্তিতে তা সম্পাদন করে।’ (বুখারি-মুসলিম)
ইসলাম শান্তির ধর্ম। ঋণ আদান-প্রদানকে কেন্দ্র করে যেন সমাজে অশান্তি সৃষ্টি না হয়, সে জন্য ইসলাম সুশৃঙ্খল ঋণ পদ্ধতি প্রদান করেছে। যদি এ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা যায়, তবে সমাজ ও রাষ্ট্রে যেমন শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে, তেমনি আখিরাতেও মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।