গাঁজা সেবন ও সাইকোসিস (এমন এক মানসিক পরিস্থিতি যখন মানুষ বাস্তবতার বোধ হারিয়ে ফেলে) তথা মনোবিকারের মধ্যে সম্পর্ক আছে—এটা আমরা অনেকেই জানি। বিভিন্ন গবেষণায় এই সম্পর্কের ঝুঁকি বিভিন্ন রকম। তবে এখনো স্পষ্ট নয়, কীভাবে গাঁজা মনোবিকারের সৃষ্টি করে এবং ধীরে ধীরে তা সিজোফ্রেনিয়ায় রূপ নেয়।
মানুষের জিন, মাদকের কার্যক্ষমতা এবং বয়সের মতো বিষয়গুলো এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে জানা গেছে এত দিনকার বিভিন্ন গবেষণা থেকে। এবার কানাডার বিজ্ঞানীরা মনোবিকারের কারণ হিসেবে গাঁজার সঙ্গে মস্তিষ্কের যোগাযোগের মতো আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ খুঁজে পেয়েছেন।
আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন প্রকাশিত জেএএমএ সাইকিয়াট্রি জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, মনোবিকারের প্রাথমিক পর্যায়ে থাকা বা ঝুঁকির মুখে থাকা তরুণদের মস্তিষ্কে সাইনাপসের ঘনত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
এই গবেষণার অন্যতম গবেষক ও কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির নিউরোফার্মাকোলজিস্ট রোমিনা মিজরাহি বলেছেন, ‘প্রত্যেক গাঁজা সেবনকারী মনোবিকারে আক্রান্ত হবে না, তবে কিছু মানুষের জন্য ঝুঁকির মাত্রা অনেক বেশি। আমাদের গবেষণা এই ঝুঁকির কারণগুলোকে স্পষ্ট করতে সহায়তা করবে।’
গবেষকেরা ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত একটি তৃতীয় পর্যায়ের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা হাসপাতালের ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়সী ৪৯ জন অংশগ্রহণকারীর তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে এমন অনেকে ছিলেন যাঁরা প্রথমবারের মতো মনোবিকারের অভিজ্ঞতা পেয়েছেন বা ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ রোগী’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। তাঁরা সবাই অল্পমাত্রায় অ্যান্টিসাইকোটিকস (সাইকোসিসরোধী ওষুধ) সেবন করছিলেন এবং তাঁরা গাঁজা ছাড়া অন্য কোনো মাদক গ্রহণ করেননি।
অংশগ্রহণকারীদের মানসিক ও শারীরিক পরীক্ষার পাশাপাশি তাদের মস্তিষ্কের কাঠামো ও উপাদান নির্ধারণে পজিট্রন ইমিশন টমোগ্রোফি বা পিইটি (সাধারণত, শরীরের অভ্যন্তরে কোনো অংশের ত্রিমাত্রিক চিত্র পাওয়ার জন্য এই স্ক্যান করা হয়) এবং এমআরআই স্ক্যান করা হয়। এ ছাড়া, কোনো কোন বিষয়গুলো অংশগ্রহণকারী ব্যক্তির মস্তিষ্কে সাইকোসিসকে প্রভাবিত করতে পারে সেগুলোকেও চিহ্নিত করা হয়।
গবেষণা প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীরা লিখেছেন, ‘আমরা মূলত জরুরি বিভাগ থেকে রোগী বাছাই করেছি এবং খুব সাম্প্রতিক মনোবিকারের অভিজ্ঞতা পাওয়া এবং উচ্চমাত্রার ক্লিনিক্যাল সমস্যাযুক্ত রোগীদের অন্তর্ভুক্ত করেছি।’
গবেষকেরা গবেষণায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের সাইনাপসের ঘনত্ব নির্ধারণ করেছেন সিনাপটিক ভেসিকল গ্লাইকোপ্রোটিন ২এ (এসভি২এ) নামক প্রোটিনের স্তর দেখে। এই প্রোটিনটি সাধারণত সাইনাপটিক ভেসিকেলে উপস্থিত থাকে এবং মানুষের শরীরে মস্তিষ্কের সংকেত আদান-প্রদানের নিউরোট্রান্সমিটার সংরক্ষণ করে। সাধারণভাবে, মস্তিষ্কে যত বেশি এসভি২এ থাকে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সেখানে তত বেশি সাইনাপস উপস্থিত থাকে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, যারা প্রথমবার মনোবিকারের অভিজ্ঞতা পেয়েছেন বা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছেন, তাঁদের মস্তিষ্কের কম সাইনাপস ঘনত্বের সঙ্গে উচ্চতর নেতিবাচক মানসিক রোগের লক্ষণের সম্পর্ক রয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, গাঁজা সেবন এসভি২এ-এর স্তর এবং সেই অনুযায়ী সাইনাপসের ঘনত্ব কমিয়ে দেয়। এটি পূর্বের একটি গবেষণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যেখানে দেখা গেছে, গাঁজা সেবনের ফলে এসভি২এ প্রোটিনের স্তর কমে যায়। মিজরাহি বলেন, ‘গাঁজা মস্তিষ্কে প্রাকৃতিকভাবে যে পরিমাণ সাইনাপস উপস্থিত থাকে তার পরিমার্জন ও কাটছাঁটের প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটায়। কিন্তু সুস্থ মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য এই পরিমার্জন ও কাটছাঁট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
গবেষণায় উল্লেখযোগ্যভাবে দেখা গেছে, গাঁজা মস্তিষ্কের স্ট্রাইটাল অঞ্চলে—(স্ট্রাইটাল অঞ্চল মস্তিষ্কের কেন্দ্র ভাগ বেসাল গ্যাংগ্লিয়ার একটি অংশ, সংকেত আদান-প্রদান, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে। ডোপামিনসহ গ্লুটামেট ও গ্যাবা নিউরোট্রান্সমিটারের মাধ্যমে এটি কাজ করে।) এই অঞ্চলে ডোপামিনের ঘাটতির কারণে পারকিনসন রোগ হয়, এখানে নিউরন ক্ষয়ে গেলে হান্টিংটন ডিজিজ দেখা দেয়। এ ছাড়া, এই অঞ্চলটিই মানুষের আসক্তি ও অন্যান্য ছুঁতমার্গ আচরণের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে, যা মনোবিকারের জন্ম দিতে পারে।
তবে এটিও মনে রাখা জরুরি যে এই গবেষণায় গাঁজা সেবন সরাসরি মনোবিকার রোগীদের সাইনাপসের ঘনত্ব কমিয়ে দিয়েছে, এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এই গবেষণায় অল্প নমুনা নিয়ে কাজ করা হয়েছে। এ ছাড়া, এখানে অংশগ্রহণকারীরা মনোবিকারের প্রাথমিক পর্যায়ে ছিলেন এবং তাঁদের দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল ব্যাপকভাবে ভিন্ন হতে পারে।
তবুও, মনোবিকারের প্রাথমিক পর্যায়ে এবং গাঁজা সেবনের ফলে এসভি২এ—স্তরে পরিবর্তনের বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। গবেষকেরা মনে করেন, উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণদের মধ্যে গাঁজার প্রভাবে সাইনাপসের ঘনত্ব হ্রাস মনোবিকার তৈরি করার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে আরও খতিয়ে দেখা উচিত।
ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির নিউরোসায়েন্সের পিএইচডি শিক্ষার্থী বেলেন ব্লাসকো বলেন, ‘বর্তমান ওষুধগুলো মূলত হ্যালুসিনেশন বা ভ্রম নিরাময়ে কাজ করে, তবে (মস্তিষ্কে) সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা, বিভিন্ন কাজ কার বা স্কুল ব্যবস্থাপনার মতো সমস্যাগুলো সমাধানের ক্ষেত্রে (যে জটিলতা তৈরি হয় তা সমাধানে কোনো কাজ) করে না।’
বেলেন ব্লাসকো আরও বলেন, ‘সাইনাপসের ঘনত্বের ওপর নজর দিলে আমরা ভবিষ্যতে এমন থেরাপি তৈরি করতে পারব, যা আক্রান্ত ব্যক্তিদের সামাজিক কার্যক্ষমতা এবং জীবনের মান উন্নত করতে পারবে।’