হোম > সারা দেশ > ঢাকা

বাসা-অফিস-দোকান

সবখানে ভাড়া বাড়ানোর দৌড়

তোফাজ্জল হোসেন রুবেল, ঢাকা 

প্রকাশ : ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০২: ৫৪
ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের বাটা সিগন্যাল মোড়ের একটি বহুতল ভবনের ১১ তলায় ছোট একটু ‘স্পেস’ ভাড়া নিয়ে অফিস শুরু করেছিলেন কামাল হোসেন। জামানত হিসেবে তিন মাসের অগ্রিম ভাড়া দিয়ে সাজসজ্জা করেন। একটি বছর পুরো না হতেই নতুন বছরের শুরুতে তাঁকে চার হাজার টাকা ভাড়া বাড়ানোর কাগজ ধরিয়ে দিয়েছেন কেয়ারটেকার (তত্ত্বাবধায়ক)। কামাল হোসেন আজকের পত্রিকার সঙ্গে এ নিয়ে আলাপকালে বললেন, ‘অফিস চালুর পর থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতায় কাজ প্রায় শুরুই করতে পারিনি। আগামী কয়েক মাসে যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, তাও নিশ্চিত নয়। এরই মধ্যে যেভাবে ভাড়া বাড়ানো হলো, তাতে ব্যবসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি।’

রাজধানীর বাসিন্দাদের সিংহভাগেরই এখানে নিজের আবাসন নেই। সংশ্লিষ্টদের মতে, ‘পরের জায়গায়’ ভাড়ার বিনিময়ে থাকা মানুষের সংখ্যা ৭০ শতাংশ। তাই ৩০ শতাংশ বাড়িঅলার খেয়ালখুশির ওপর নির্ভর করে লাখো ভাড়াটের গৃহবাস। নতুন বছরের শুরু যত সম্ভাবনার বারতাই বয়ে আনুক, বিশেষ করে বাঁধা আয়ের চাকরিজীবী বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ভাড়াটেমাত্রেরই বুক ঢিপ ঢিপ করতে থাকে ডিসেম্বর এলেই। ব্যতিক্রম থাকলেও তার সংখ্যা নিতান্ত কম।

রামপুরার হাজীপাড়ায় ছোট তিনটি রুমের ফ্ল্যাটে থাকেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী মো. জানে আলম। তাঁর বাড়ির মালিক ১ জানুয়ারি একলাফে সাড়ে ৫ হাজার টাকা ভাড়া বাড়ানোর কথা জানিয়েছেন। বাড়িঅলার যুক্তি হলো, বাথরুম আর রান্নাঘরে নতুন টাইল্স বসানো হয়েছে! জানে আলম বলেন, ‘কিছু করার নেই। বাসার পাশে বাচ্চার স্কুল; তাই মেনে নিয়েছি। গত এক বছরে আমার কোনো আয় বাড়েনি। অথচ ভাড়া বাড়ল প্রায় ৪৪ শতাংশ।’

একই সমস্যার কথা বললেন বনশ্রীর বাসিন্দা শরীফ আহমেদ। তাঁর এইচ ব্লকের ৬ নম্বর রোডের বাসাটির মালিক প্রতিবছরই কমবেশি ভাড়া বাড়ান। এ বছরের শুরুতেও ১ হাজার ৫০০ টাকা বাড়ানোর কথা জানিয়ে দিয়েছেন।

ভাড়াটের স্বার্থ কার্যত উপেক্ষিত

খোঁজখবর করে দেখা যায়, রাজধানীর বাড়ির মালিকেরা সাধারণত বছরে ১০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাসাভাড়া বাড়িয়ে থাকেন। নির্ধারিত উপার্জনের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আয়ের সঙ্গে সংগতি নেই। কিন্তু নাগরিক জীবনের এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে খুব একটা তৎপরতা চোখে পড়ে না। ভাড়াটেরা নিজেরাও সংগঠিত নন। ‘ঢাকা ভাড়াটিয়া উন্নয়ন সোসাইটি’ নামের একটি সংগঠন ভাড়াটেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কাজ করে থাকে। তবে তাদের কার্যক্রম কিছু মানববন্ধন আর কর্তৃপক্ষের কাছে স্মারকলিপি দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। নাগরিক জীবনের অবিরাম দৌড়ে ব্যস্ত খুব কম ভাড়াটেই এসব সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকেন বা এসব নিয়ে ভাবেন। এমন প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ‘ঢাকা ভাড়াটিয়া উন্নয়ন সোসাইটি’ নামের সংগঠনটি দাবি তুলেছে, মধ্যবিত্ত ও চাকরিজীবীদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কিস্তিতে কম সুদে ফ্ল্যাট দেওয়ার ব্যবস্থা এবং দ্রুত ওয়ার্ড পর্যায়ে ভাড়াটে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ-সংক্রান্ত আইনের যথাযথ বাস্তবায়নও নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছে সংগঠনটি। তাদের বক্তব্য, এসব দাবি মানা হলে বাড়িভাড়া বাড়ানোর চাপ কমবে।

ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, সরকারের উচিত ভাড়া-সংক্রান্ত একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করা। তাহলে বাড়িঅলা ও ভাড়াটেদের মধ্যে বিরোধ এড়ানো সম্ভব হবে। আর ভাড়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই লিখিত চুক্তি বাধ্যতামূলক করা উচিত। তাহলে অনেক সমস্যারই আইনগত সমাধান সম্ভব।

ভাড়ার অঙ্কের যেন সীমা নেই

রাজধানীর বিভিন্ন অংশের বেশ কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে দেখা যায়, অভিজাত এলাকার বাসাভাড়া এখন যেন আক্ষরিক অর্থেই আকাশচুম্বী। অনেক ক্ষেত্রে বাসার অবস্থান, আকার বা সুযোগ-সুবিধার সঙ্গেও তার তেমন সংগতি নেই। ধানমন্ডি, লালমাটিয়া, গুলশান, বনানী, বারিধারা এলাকার বাসাভাড়া এখন শহরের অতি ক্ষুদ্র অংশের মানুষের হাতের নাগালে। বেশির ভাগ সীমিত আয়ের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবার ভদ্র ও নিরিবিলি পরিবেশের জন্য চাইলেও এসব জায়গায় থাকতে পারবে না। ধানমন্ডি ৫ নম্বর রোডের মাঝামাঝি একটি ৯ তলা ভবনের ৫ তলার ফ্ল্যাটের ভাড়াটে আনিসুর রহমান। ভবনটির নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ না হলেও আড়াই হাজার বর্গফুটের বাসার ভাড়া ১ লাখ টাকা। এর সঙ্গে রয়েছে ৭ হাজার টাকা সার্ভিস চার্জ। আনিসুর রহমানের সন্তানের স্কুল ধানমন্ডি এলাকাতেই। মূলত সন্তানের পড়াশোনা আর নিরিবিলি পরিবেশে থাকার ইচ্ছা পূরণে তাঁকে প্রতি মাসে লাখ টাকার বেশি বাসাভাড়া গুনতে হচ্ছে।

লালমাটিয়া এ-ব্লকের একটি নতুন বাসায় ১ জানুয়ারি ভাড়ায় উঠেছেন মো. আমিনুল ইসলাম নামের এক সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। গতকাল শুক্রবার তিনি আজকের পত্রিকাকে বললেন, ‘শহরের নানা এলাকা ঘুরে লালমাটিয়ার দুটি বাসা পছন্দ হয়। হাজারদুয়েক বর্গফুট আয়তনের বাসা দুটির ভাড়া ৮০ হাজার ও ৬৩ হাজার টাকা করে। সার্ভিস চার্জ যথাক্রমে ৯ হাজার ও সাড়ে ৮ হাজার টাকা। ভেবেচিন্তে ৬৩ হাজারের বাসায় উঠেছি। পাশাপাশি দুটি বাড়ির কাছাকাছি আকারের ফ্ল্যাটের ভাড়ায় এত ব্যবধান! এমন একটি ফ্ল্যাটের ভাড়া এত হতে পারে না। যেহেতু এগুলো তদারকির জন্য কোনো কর্তৃপক্ষ নেই, তাই বাড়িমালিকেরা অনেকটা নিজেদের ইচ্ছেমতো ভাড়া ধার্য করেন।’

মিরপুর রূপনগর আবাসিক এলাকার একটি ৬৫০ বর্গফুটের বাসার মালিক আলী আশরাফ। তিনি বাসার ভাড়া চান ১৪ হাজার টাকা। এর বাইরে সব বিল ও সার্ভিস চার্জ দিতে হবে ভাড়াটেকে। এক প্রশ্নের জবাবে আলী আশরাফ বলেন, ‘প্রতিবছর হোল্ডিং ট্যাক্স, ব্যাংকঋণের সুদের হার বাড়ে। ভাড়া না বাড়ালে নিজের পকেট থেকে ভর্তুকি দিতে হবে। শুধু বাড়ির মালিকের দোষ ধরে লাভ নেই।’

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হামিদুর রহমান খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘পূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে শুধু সরকারি বাসা ও ভবনগুলোর ভাড়া এলাকাভিত্তিতে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। নিয়ম মেনে আবার তার পুনর্মূল্যায়ন হয়। তবে বেসরকারি আবাসনসহ পুরো শহরে মন্ত্রণালয়ের এমন কোনো কার্যক্রম নেই।’

ভাড়া পেতে নারীর যুদ্ধ

একুশ শতকের অনেকটা পেরিয়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দ্বারে এসেও এ শহরে বাসাভাড়া পেতে রাজ্যের ঝক্কি পোহাতে হয় নারীদের। অধিকাংশ বাড়িঅলাই কর্মজীবী প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের বাসাভাড়া দিতে অনাগ্রহী। অনেকে আবার অযৌক্তিক অঙ্কের ভাড়াসহ নানা শর্ত জুড়ে দেন। এসব শর্তের মধ্যে থাকে বাবা, স্বামী বা বড় ভাইয়ের সশরীরে এসে কথা বলা, পুরুষ অভিভাবকের বাসায় থাকা, সন্ধ্যার মধ্যে ফেরাসহ নানা কিছু।

বেসরকারি চাকরিজীবী ফারহানা বহ্নি জানান, বছর না পেরোতেই তাঁর বাসাভাড়া বেড়েছে। ব্যয় সামলাতে না পেরে নতুন বাসায় উঠতে হচ্ছে। কিন্তু অবিবাহিত হওয়ায় এবং পুরুষ অভিভাবক না থাকায় বাসাভাড়া করতে গিয়ে তাঁর নানা নেতিবাচক অভিজ্ঞতা হয়েছে। এমনও হয়েছে, সঙ্গে কোনো পুরুষ থাকবে না শুনে বাসাই দেখানো হয়নি।

এ বিষয়ে নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ‘কর্মজীবী নারী’র সমন্বয়ক রিনা আমেনা বলেন, ‘একজন সিঙ্গেল নারীর জন্য মানসম্পন্ন নিরাপদ বাসস্থান খুঁজে পাওয়াটা বেশ কঠিন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, একা নারী সাবলেট থাকেন। বাড়িঅলা সেখানে অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সরকারের উচিত কর্মজীবী নারীদের জন্য যুক্তিসংগত ভাড়ায় মানসম্মত বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। মহিলা হোস্টেলের সংখ্যা চাহিদার তুলনায় অনেক কম।’

সরকারের ভূমিকার তাগিদ

নগরবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বললেন, ‘বিদেশে অঞ্চলভিত্তিক নাগরিক সুযোগ-সুবিধা চিন্তা করে কর্তৃপক্ষ ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়। এ দেশে কর্তৃপক্ষ থাকলেও তার কার্যকর উদ্যোগ নেই। দিন দিন ভূমি এবং ফ্ল্যাটের দাম বাড়ছে। বেশি দামে ফ্ল্যাট কিনে তো কেউ কম টাকায় ভাড়া দেবে না। ফলে ভূমির ওপর একধরনের নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে সরকারকে। ভূমি যত দিন একচেটিয়া পুঁজিপতিদের কারবার হয়ে থাকবে, তত দিন বাসা-অফিসভাড়া কমানো যাবে না।’

বন্ধ অবৈধ ইটভাটা ফের চালু

চাঁদনী চক মার্কেট পরিচালনা পরিষদ নিয়ে দ্বন্দ্ব: অবৈধভাবে কমিটি দেওয়ার অভিযোগ

প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ফ্রিজে আগুন, পরে ৮ বাড়িতে হামলা-লুটপাট

অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের নতুন সভাপতি নাসির, মহাসচিব নেওয়াজ