মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন মানবতার মুক্তির বার্তাবাহক, ইসলামের শেষ নবী এবং আল্লাহ প্রেরিত শ্রেষ্ঠ রাসুল। তাঁর প্রতি গভীর ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও আনুগত্য পোষণ করা ইমানের মৌলিক অংশ। তাঁর নাম উচ্চারণের সময় কিংবা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশের ক্ষেত্রে শব্দ ও ভাষার যথাযথ ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শব্দ ব্যবহারে অসতর্কতা বা সীমালঙ্ঘন ইমানের পরিপন্থী হতে পারে।
কোরআনের নির্দেশনা
পবিত্র কোরআনে মহানবী (সা.)-এর সম্মান রক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা নবীর কণ্ঠস্বরের চেয়ে তোমাদের কণ্ঠস্বর উঁচু কোরো না এবং তাঁর প্রতি কথার ধরন এমন কোরো না, যেমন তোমরা পরস্পরের সঙ্গে করো। এতে তোমাদের আমলসমূহ বিনষ্ট হয়ে যাবে, অথচ তোমরা তা বুঝতেও পারবে না।’ (সুরা হুজরাত: ২)
এই আয়াতের মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে মহানবী (সা.)-এর শানে অসম্মানজনক বা অনুচিত শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির ইমানও বিপন্ন হতে পারে। শব্দের মাধ্যমেই মানুষের হৃদয়ের অবস্থান প্রকাশ পায়, তাই এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সংযম ও শিষ্টাচার অবলম্বন করা অপরিহার্য।
মদিনায় বসবাসরত ইহুদিরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে অবমাননা করার উদ্দেশ্যে আরবিতে প্রচলিত শব্দ ‘রা-ইনা’ (যার অর্থ, আমাদের প্রতি মনোযোগ দিন) বিকৃত উচ্চারণ করে ব্যবহার করত। এই শব্দের বিকৃত রূপে অপমানজনক অর্থ (আমাদের রাখাল) প্রকাশ পেত। মুসলমানরাও তাঁদের অজান্তে নবীজিকে সম্বোধন করতে একই শব্দ ব্যবহার করতেন। এর ফলে মুসলমানদের সতর্ক করার জন্য আল্লাহ তাআলা আয়াত নাজিল করেন, ‘হে ইমানদারগণ, তোমরা (নবীকে সম্বোধন করে) ‘রা-ইনা’ বলো না; বরং ‘উনজুরনা’ (তাকান) বলো এবং শুনতে থাকো। আর কাফিরদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ (সুরা বাকারা: ১০৪)
একটা শব্দের ভিন্ন অর্থের মাধ্যমে রাসুলের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশের আশঙ্কা থাকার কারণে আল্লাহ তাআলা তা বলতে নিষেধ করেছেন। এখান থেকে তাঁর প্রতি শব্দচয়নে সতর্কতার গুরুত্ব আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে। এ ছাড়া আল্লাহ তাআলা কোরআনের কোথাও তাঁকে ‘হে মুহাম্মদ’ বলে সম্বোধন করেননি। বরং প্রতি সম্বোধনে সম্মান বা স্নেহসূচক উপাধি ব্যবহার করেছেন। মুফাসসিরদের মতে, মহানবী (সা.)-এর প্রতি আল্লাহর অত্যধিক ভালোবাসা ও তাঁর অতুলনীয় মর্যাদা বোঝাতেই আল্লাহ তাআলা এমন করেছেন।
রাসুল (সা.)-এর শানে শব্দচয়নে সতর্কতার গুরুত্বের প্রসঙ্গ এলে স্বাভাবিকভাবে কারও মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে তাঁর ব্যাপারে ‘মাটির তৈরি’, ‘উম্মি’ (নিরক্ষর), ‘রাখাল’ ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগ করা যাবে কি না, যেগুলো কোরআন ও বিভিন্ন হাদিসে প্রসঙ্গক্রমে তাঁর ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়েছে। এর উত্তর হচ্ছে—রাসুল (সা.)-কে ‘মাটির তৈরি’, ‘উম্মি’ (নিরক্ষর) বা ‘রাখাল’ বলা অসম্মান নয়, যদি তা সঠিক প্রেক্ষাপটে এবং ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়। কোরআন ও হাদিসে এসব বিষয় নিয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে। তবে এসব শব্দ ব্যবহারের সময় অভিপ্রায় ও প্রসঙ্গ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
‘মাটির তৈরি’ বলা
কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, সমস্ত মানবজাতিকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং রাসুল (সা.)ও মানুষ ছিলেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনিই সবকিছুকে সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন এবং মানুষের সৃষ্টি শুরু করেছেন কাদামাটি থেকে।’ (সুরা সাজদা: ৭) এ কারণে রাসুল (সা.)কে ‘মাটির তৈরি’ বলা তাঁর মানবিক দিক বোঝানোর জন্য হলে এটি অসম্মান নয়। তবে, যদি কেউ এতে তাঁর মর্যাদা ক্ষুণ্ন করার উদ্দেশ্যে বলেন, তাহলে তা অন্যায়।
‘উম্মি’ বলা
রাসুল (সা.)-কে কোরআনে স্পষ্টভাবে উম্মি (অক্ষরজ্ঞানহীন বা নিরক্ষর) বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা উম্মি রাসুলকে অনুসরণ করে, যার সম্পর্কে তারা তাওরাত ও ইঞ্জিলে লিখিত পেয়েছে।’ (সুরা আরাফ: ১৫৭) রাসুল (সা.)-এর নিরক্ষর হওয়া ছিল তাঁর নবুওয়তের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। এটি তাঁর অসম্মান নয়; বরং এটি প্রমাণ করে যে কোরআন ছিল আল্লাহর অহির ফল, কারণ তিনি নিজে থেকে কিছু লেখার বা সংকলন করার ক্ষমতা রাখতেন না। তবে ‘উম্মি’র অর্থ কখনোই মূর্খ নয়, কেউ এ অর্থ নিলে তা চরম বেয়াদবি হবে।
‘রাখাল’ বলা
রাসুল (সা.) নিজেই বলেছেন, তিনি জীবনের কোনো পর্যায়ে ছাগল চরিয়েছিলেন। এক হাদিসে এসেছে, ‘প্রত্যেক নবীই ছাগল চরিয়েছিলেন।’ সাহাবিরা বললেন, ‘আপনিও?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি মক্কার অধিবাসীদের ভেড়া চরিয়েছি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২১৪৩)
হাদিস বিশারদগণ বলেছেন, নবীদের ভেড়া চরাতে দেওয়ার মূলে রয়েছে তাঁদের নবুওয়তের জন্য প্রস্তুত করা। কারণ ভেড়ার পাল চরানো বড় কষ্টসাধ্য কাজ। যেহেতু একটি সময়ে এসেছে নবীদের পুরো একটি জাতির হিদায়াতের দিশা দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে, আল্লাহ তাঁদের এমন কাজের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তাই রাসুলের রাখাল হওয়ার অর্থ একান্ত দারিদ্র্যের কারণে রাখাল হতে বাধ্য হয়েছেন, এমন বলার সুযোগ নেই।
রাখাল হওয়ার ঘটনাকে ভিত্তি করে রাসুল (সা.)কে সরাসরি রাখাল ছিলেন কিংবা রাখাল হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন বা দরিদ্র কাউবয় ছিলেন-জাতীয় কথা বলা শোভনীয় নয়। কারণ বক্তার উদ্দেশ্য যেটাই হোক, শ্রোতাদের মনে এসব শব্দের ফলে নবীজির ব্যক্তিত্ব ছোট মনে হতে পারে। তাই রাসুলের শানে এমনভাবে শব্দ প্রয়োগ করা থেকে বিরত থাকা উচিত। আল্লাহ তাআলা আমাদের তৌফিক দিন।
লেখক: শিক্ষক ও গবেষক