পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী কার্টুনিস্ট অ্যান টেলনেস মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে পদত্যাগ করেছেন। তাঁর এই চাকরিত্যাগের খবর এখন বিশ্ব মিডিয়ায় এক আলোচিত বিষয়। একটি পত্রিকা থেকে একজন কার্টুনিস্টের পদত্যাগের খবরটি বিশ্বব্যাপী চাউর হতো না যদি তা নিছক সাদামাটা পদত্যাগ হতো। এ পদত্যাগের পেছনে রয়েছে এক সংবাদকর্মীর সাহসী পদক্ষেপ। খবরে বলা হয়েছে, নিজের আঁকা একটি কার্টুন ওয়াশিংটন পোস্ট প্রকাশ না করায় অ্যান টেলনেস ইস্তফা দিয়েছেন। কার্টুনটি এমন—নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সামনে নতজানু হয়ে বসে আছেন ওয়াশিংটন পোস্টের মালিক জেফ বেজোস, তাঁর সঙ্গে রয়েছেন আমেরিকার বড় শিল্পপতিরা। খবরে বলা হয়েছে, আমেরিকার সাম্প্রতিক অবস্থা তুলে ধরতেই এমন কার্টুন এঁকেছিলেন টেলনেস।
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, ওয়াশিংটন পোস্ট কার্টুনটি প্রকাশ করতে রাজি না হওয়ায় বিষয়টিকে ‘মুক্ত সাংবাদিকতার জন্য বিপজ্জনক’ বলে মন্তব্য করেছেন অ্যান টেলনেস। ২০০৮ সাল থেকে ওয়াশিংটন পোস্টে কাজ করে আসছিলেন তিনি। অনলাইনে পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার পর এক পোস্টে তিনি বলেছেন, ‘এই সময়ের মধ্যে আমি আমার কলম দিয়ে যাঁদের এঁকেছি, তাঁদের কারও কারণে কখনো আমার কার্টুনকে হত্যা করতে হয়নি। এবার যে কার্টুনকে হত্যা করা হলো, সেখানে বিলিয়নিয়ার প্রযুক্তি এবং মিডিয়ার নির্বাহীদের সমালোচনা করা হয়েছে, যাঁরা নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সুনজরে আসার জন্য সম্ভব সবকিছু করে আসছেন।’
ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে কার্টুনিস্ট অ্যান টেলনেসের পদত্যাগ বর্তমান সময়ে নতজানু সাংবাদিকতার ধারায় এক ব্যতিক্রমী ঘটনা নিঃসন্দেহে। যেখানে সাংবাদিকদের প্রতিনিয়ত কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার সঙ্গে কিংবা রাষ্ট্রের ক্ষমতাধরদের সঙ্গে আপস করতে হচ্ছে, সেখানে একজন অ্যান টেলনেস অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। তাঁর এই পদত্যাগ শুধু একটি পত্রিকা কর্তৃপক্ষের নতজানু সম্পাদকীয় নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদই নয়, এটা আপসকামীদের গণ্ডদেশে সজোরে চপেটাঘাতও বটে। এই সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য অ্যান টেলনেস সংবাদকর্মীদের স্বাধীনতার সংগ্রামে সাহসী সৈনিকের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হলেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ভাবা হয় উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে। সেখানে মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতার কথাও প্রচার করা হয়ে থাকে। অতীতে তার কিছু নজিরও স্থাপিত হয়েছে। তার মধ্যে বিশ্বখ্যাত ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি অন্যতম। সে কেলেঙ্কারি ফাঁস করেছিল এই ওয়াশিংটন পোস্টই। ১৯৭২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধী ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থীর রাজনৈতিক তথ্য শোনার জন্য ওই দলের সদর দপ্তর ওয়াশিংটন ডিসির ওয়াটারগেট ভবনে আড়িপাতার যন্ত্র স্থাপন করেন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ও রিপাবলিকান দলের প্রার্থী রিচার্ড নিক্সনের কর্মকর্তারা। ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক কার্ল বার্সটেইন তা ফাঁস করে দেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সন এই ঘটনার সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতার কথা বরাবর অস্বীকার করে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত সফল হননি। মূলত সংবাদমাধ্যমের রিপোর্ট ও তদন্ত সংস্থার তদন্তে ঘটনার সত্যতা প্রকাশিত হয় এবং এর সঙ্গে নিক্সনের সম্পৃক্তি প্রকাশিত হয়ে পড়ে। যে কারণে ওই বছর নির্বাচনে জয়লাভ করলেও ১৯৭৪ সালের ৯ আগস্ট তাঁকে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়।
প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও মনিকা লিউনস্কির যৌন কেলেঙ্কারির খবরও পৃথিবী জেনেছিল মার্কিন সংবাদমাধ্যমের কল্যাণেই। আর সে ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন পোস্টের ভূমিকা অন্য যেকোনো মিডিয়ার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। সেই কেলেঙ্কারির খবর প্রকাশ-প্রচার হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনকে টেলিভিশনের লাইভে এসে কৈফিয়ত দিতে হয়েছিল, অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল পরিবার ও দেশবাসীর কাছে।
যে দুটি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করা হলো, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুনিয়া কাঁপানো ঘটনা; যা সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা ও সাহসিকতায় প্রকাশ হয়েছিল। আর দুটি ঘটনায়ই ওয়াশিংটন পোস্টের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদমাধ্যমটির সাহসিকতা ও দায়িত্বশীলতার কারণে ক্ষমতাসীন দুই প্রেসিডেন্টকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে। একজন পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন, অপরজন পদত্যাগ না করলেও জনগণের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে রক্ষা পেয়েছেন। ভাবতে অবাক লাগে, যে ওয়াশিংটন পোস্ট প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও ক্লিনটনের প্রেসিডেন্সিয়াল ক্ষমতাকে ধর্তব্যের মধ্যে না এনে, নিজেদের কর্তব্যে অটল থেকেছে, তারাই আজ আরেকজন প্রেসিডেন্টের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে একটি কার্টুন পত্রস্থ করা থেকে বিরত থেকেছে!
মার্কিন মুলুকের কথা বাদ দিয়ে স্বদেশের দিকে একটু তাকাই। আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে জনসাধারণের সাধারণ অভিযোগ হলো, এরা সত্য প্রকাশ করে না। ইদানীং একটি কথা প্রবচনের রূপ নিয়েছে—‘আগে মানুষ মিথ্যা বলত, মিডিয়া সত্য খুঁজে বের করত। এখন মিডিয়া অসত্য প্রচার করে, মানুষ সত্য খুঁজে বের করে।’ কথাটি হয়তো সর্বাংশে সত্য বা অসত্য নয়। তবে এটা ঠিক যে নানা কারণে আমাদের দেশের মিডিয়া এখন প্রাণ খুলে সত্যকে প্রকাশ করতে পারে না। এই না পারার পেছনে নানা কারণ রয়েছে। প্রথমত, বেশির ভাগ নেতৃস্থানীয় মিডিয়ার মালিক দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ। ফলে ক্ষমতাসীন সরকারের সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির দিকে এসব মিডিয়াকে খেয়াল রেখে সংবাদ প্রকাশ বা প্রচার করতে হয়, সম্পাদকীয় নীতি গ্রহণ করতে হয়। এমনকি দুর্নীতির খবর প্রকাশ করার ক্ষেত্রেও ঘটনার সঙ্গে শাসকপক্ষের কোনো ক্ষমতাধর জড়িত রয়েছেন কি না, তা নিয়ে দশবার ভাবতে হয়। কারণ, ক্ষমতাসীন সরকার বা এর কোনো যন্ত্রাংশ নাখোশ হলে সংশ্লিষ্ট মিডিয়ার ওপর যেকোনো ধরনের খড়্গ নেমে আসতে পারে। দ্বিতীয় কারণটি হলো, মিডিয়ার কর্ণধারদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন সরকারের অনুগত বা সরকারদলীয় সাংবাদিকেরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে যেমন কুণ্ঠিত থাকেন, তেমনি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে উদ্ভট ভিত্তিহীন খবর প্রচারে থাকেন কুণ্ঠাহীন।
তারপরেও বিবেকবান কিছু সাংবাদিক চেষ্টা করেন, অন্তত সাংবাদিকতার মান সমুন্নত রাখতে। আর তা করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রথিতযশা সাংবাদিকদের সরকারি হয়রানির কবল পড়ে নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা কম ঘটেনি। স্বাধীনতার পরপর দৈনিক বাংলা থেকে কবি হাসান হাফিজুর রহমান, মর্নিং নিউজ থেকে আবদুস সালামের মতো প্রথিতযশা সম্পাদকদের চাকরি হারানো, কিংবা জহুর হোসেন চৌধুরীর মতো প্রবীণ সাংবাদিক-কলামিস্টের কারাগারে গমন তারই উদাহরণ। সেই ধারাবাহিকতায় এখনো সাংবাদিক দলন চলছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে এন্তার কথাবার্তা আমরা প্রতিনিয়তই শুনি। কিন্তু স্বাধীনতার আলোকরশ্মি এ জগৎকে এখনো আলোকিত করছে না।
গত বছরের ৫ আগস্টে সমাপ্ত হওয়া শাসনামলটিতে সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিক নির্যাতনে কালো অধ্যায় সৃষ্টি হয়েছে। সত্য প্রকাশের চেষ্টা করায় সাংবাদিক সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি দম্পতিকে নিজ বেডরুমে নৃশংসভাবে নিহত হতে হয়েছে। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও সম্পাদকীয় নীতি অবলম্বন করায় দুই প্রবীণ সম্পাদককে দেশত্যাগ করতে হয়েছিল। অন্যদিকে একদল দলান্ধ সাংবাদিকের উপদ্রব ঘটেছিল; যাঁরা সরকারপ্রধান ও তাঁর সহযোগীদের মনোরঞ্জনে নিজেদের ব্যস্ত রাখতেন। অপরদিকে বিরোধী দল ও সেগুলোর নেতাদের বিরুদ্ধে মনগড়া সংবাদ-মতামত প্রকাশেও পিছপা হতেন না। রাজনৈতিক মতবাদ ও সাংবাদিকতা যে দুটি ভিন্ন বিষয়, তা যেন তাঁরা বিস্মৃত হয়েছিলেন।
বাংলাদেশ এখন ফ্যাসিবাদী শাসনমুক্ত। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাংবাদিকদের বলেছেন তাঁর সরকারের ভুলত্রুটি নির্দ্বিধায় তুলে ধরতে। হাত খুলে লিখতে বলেছেন তিনি। হ্যাঁ, এখন হাত খুলে অনেকেই লিখছেন। তবে তার প্রায় সবই বিগত আওয়ামী লীগ সরকার, শেখ হাসিনা ও তাঁর পারিষদবর্গের বিরুদ্ধে। অনেক কথাই অনেকে চেপে যাচ্ছেন নানা কারণে।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে একজন অ্যান টেলনেস আমাদের নেই, যিনি সত্য প্রকাশে আপসহীন থাকবেন। ভয় কিংবা লোভের মুখে পদাঘাত করে সাংবাদিকতার মহিমাকে সমুন্নত রাখবেন।