বিধান রিবেরু
গণতন্ত্রের জন্য আমরা প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলেছি। গণতন্ত্রের দেখা কি মিলছে? গণতন্ত্র কি কেবল নির্দিষ্ট সময় পরপর ভোটাধিকার? নাকি জনগণের যেমন খুশি তেমন বিচার-আচার? সাধারণ ধারণায় গণতন্ত্র মানে স্রেফ স্বাধীন ও সুষ্ঠুভাবে ভোট প্রদানের অধিকার বোঝায় না, নাগরিকের সমান মানবাধিকারকেও বোঝায়। পরিতাপের বিষয়, এক মানবই আরেক মানবের অধিকার কেড়ে নেয় ক্ষমতা পেলে।
প্লেটো স্বপ্ন দেখেছিলেন একজন ফিলোসফার কিংবা দার্শনিক রাজার হাত দিয়ে রাজ্য পরিচালনা হলে তা সুষ্ঠু হবে। কিন্তু তিনি এটাও বলতে ভোলেননি, সেই দার্শনিক রাজা, বোধবুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও, ক্ষমতার গজদন্ত মিনারে চড়ার পর দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে যেতে পারেন। কাজেই গণতান্ত্রিক উপায়ে কাউকে ক্ষমতায় বসালেই কেবল হয় না, গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য প্রতিনিয়ত পাহারা দিতে হয়। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে যাঁরা ক্ষমতায় গেলেন তাঁরা স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারেন, স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারেন, দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে যেতে পারেন, এমনকি তাঁরা নিজেদের অদক্ষতার স্বাক্ষরও রাখতে পারেন।
প্লেটো গণতন্ত্রের সমালোচনা করতে গিয়ে একটি রূপক গল্পের অবতারণা করেছিলেন। ধরুন, জাহাজের যিনি কাপ্তান, তিনি সমুদ্রের নাড়িনক্ষত্র জানেন। ঢেউয়ের গতিবিধি তাঁর মুখস্থ। কিন্তু জাহাজের অন্য নাবিকেরা যদি নির্বাচনের মাধ্যমে এমন একজনকে তাঁদের কাপ্তান বানান, যাঁর জাহাজ পরিচালনার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, এমনকি সাগরের মতিগতি তিনি বুঝতে পারেন না, তদুপরি তিনি আগ্রহী নন, তাহলে ওই গোটা জাহাজের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে? কাজেই বলা যায়, গণতন্ত্র ভালো জিনিস, কিন্তু একে বুঝেশুনে ব্যবহার করতে হবে। ব্যবহার করবে কে? এই জনগণ। কিন্তু জনগণকে তো আগে শিক্ষিত হতে হবে। আগে তাদের বুঝতে হবে, কোন কাপ্তান তাদের জাহাজকে ভেড়াতে পারবে তীরে।
অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে, ফরাসি বিপ্লবের রক্তরঞ্জিত ইতিহাস থেকে স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ধারণাটি অধুনা গণতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে এসে ভালো করে মিশেছে। রাজতন্ত্রের উৎখাতের ভেতর দিয়ে গণতন্ত্রের যাত্রা ধরা যায় ফরাসি বিপ্লবকে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, ওই যাত্রাপথেই কিন্তু অভ্যন্তরীণ সংঘাত, অবিশ্বাস ও কর্তৃত্ববাদী শাসনও প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। নেপোলিয়ন বোনাপার্টের মতো লোক ইতিহাসে আবির্ভূত হয়েছিলেন, যাঁর মননে ছিল সাম্রাজ্যবাদ। এসব বলে আমি মোটেও ফরাসি বিপ্লবকে ছোট করছি না, বরং বলার চেষ্টা করছি, আধুনিক গণতন্ত্রের ধারণায় ফরাসি বিপ্লবের শিক্ষা গৃহীত হয়েছে। কী সেই শিক্ষা? গণতন্ত্র শুধু প্রতিষ্ঠা করলেই হয় না, তাকে রক্ষণাবেক্ষণ, পাহারা ও দিকনির্দেশনা দিতে হয়। এই দায়িত্ব জনগণেরই।
এখন গণতন্ত্রের ধারণাটা হলো, জঁ-জাক রুশো যেমনটা বলেন, রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সমাজে আগে থেকে গণতন্ত্র বিরাজ করতে হয়। এটা অনেকটা প্লেটোর ধারণা তত্ত্বের মতো। ধরা যাক, আমরা প্রতিদিন কত কত চেয়ার তৈরি করছি। সব চেয়ারের চেহারা কিন্তু এক নয়। তবে চেয়ারসংক্রান্ত সবার ধারণা কিন্তু এক। ঠিক সে রকম দেশে দেশে গণতন্ত্রের চেহারা এক নয়। যুক্তরাষ্ট্রে এক রকম, ভারতে আরেক রকম, আবার বাংলাদেশে আরও ভিন্ন রকম। রূপ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু গণতন্ত্রের ধারণা তো একটাই—মানুষ তার নাগরিক ও মানবিক অধিকার নিয়ে, সবার সঙ্গে সমান মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকবে। এবং সে যে রাষ্ট্রে বসবাস করবে, সেখানে সে তার মত ও চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে পারবে বিনা বাধায়। একটু উল্টো দিক থেকে বললে, সে এমন কিছু করবে না, যাতে অন্যের স্বাধীনতা বা শান্তি বিনষ্ট হয়। অর্থাৎ অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহনশীল থাকবে।
এখন প্রশ্ন করুন, বাংলাদেশে বারবার গণতন্ত্র হোঁচট খাচ্ছে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আরও একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। আমাদের সমাজে কি গণতন্ত্রের ধারণা বিরাজ করে? গণতন্ত্র যদি নাগরিক ও মানবাধিকারের বিষয় হয়, তাহলে সেটা অন্যের বেলায় আমরা কতটা সচেতন? সামষ্টিকভাবে আমরা কি অসচেতন, লোভী, হিংস্র, অসহিষ্ণু ও দখলদারি মানসিকতার পরিচয় বহন করি না? প্রাত্যহিক জীবনের নানাবিধ উদাহরণ থেকেই বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া যায়। ধরুন, নাগরিক অধিকারের কথা যদি বলি, প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার রয়েছে রাজধানীর ফুটপাত ব্যবহার করার।
কিন্তু আমরা কি ব্যবহার করতে পারছি? দখলদারদের কবলে কেবল ফুটপাত নয়, নদী-নালা-খাল-বিল, এমনকি বাচ্চাদের খেলার মাঠ, সবই তো তাদের দখলে।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দেখুন, একজনের সঙ্গে মতের অমিল ঘটলেই আমরা অসহিষ্ণু হয়ে বাস্তবে তার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে জীবন বিপন্ন করে তুলছি। রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে আমরা মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলছি। রাস্তাঘাটে ‘আমি আগে যাব’, ‘আমি আগে খাব’— এমন ধারণার লোকজন দিয়ে ভর্তি। আমরা একটা চরম স্বার্থপর, নির্লজ্জ ও লোভী সমাজ প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছি। এটা কেন হলো, সেই বিচার করবেন সমাজবিজ্ঞানীরা। কিন্তু সমাজ যে রূপ ধারণ করেছে তা কিন্তু খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে।
এখন যে সমাজে নির্লজ্জ স্বার্থপরতাই মূল ধারণা হিসেবে বিরাজ করে, সেখানে মানুষ গণতান্ত্রিক হয়ে উঠতে পারে না। আর এর প্রতিফলন তো রাষ্ট্রের পরিচালনার ক্ষেত্রে ঘটবেই। দেশের জনগণ যেমন, তার শাসকগোষ্ঠীও তেমনই হবে। এটাই তো স্বাভাবিক।
আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চাই, তাহলে সমাজে গণতন্ত্রের ধারণা নিয়ে কাজ করতে হবে। আগে মানুষের মননে গণতন্ত্রের চেতনাকে জাগ্রত করতে হবে। সেটা সম্ভব সমন্বিত দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপের মাধ্যমে। পরিবর্তনটা শুরু করতে হবে নিজের বর্তমানকে বিলুপ্ত করার ভেতর দিয়ে। আমরা যে অস্থিরতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, তাকে সুস্থির করার আর কোনো বিকল্প নেই—নিজের বর্তমানকে বিলুপ্ত করা ছাড়া। আমাদের বিদ্যালয় ও পরিবারে পরিবর্তনের সূচনা করতে না পারলে আমাদের সামাজিক ধারণায় কখনোই গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে পারব না। সমাজে সুকুমার বৃত্তি আগে যা-ও ছিল, এখন কমতে কমতে শূন্যের কোঠায়। কয়টা বাসায় এখন আর পারিবারিক পাঠাগার দেখতে পাওয়া যায়? কয়টা সামাজিক অনুষ্ঠানে এখন বাংলা সংস্কৃতির চর্চা দেখা যায়? অধিকাংশ পরিবারের বড়রা মোবাইল ফোনে চটুল ভিডিও দেখছে, ছোটরাও সেসব অনুসরণ করছে। বিয়ে বা জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমরা নিম্নরুচির হিন্দি গান বাজাচ্ছি, শিশুদের মননও সেভাবে তৈরি হচ্ছে।
শিশুর যুক্তিশীল মন ও গণতান্ত্রিক মানস গঠনের পেছনে যে ধরনের সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন ছিল, সেটা আমাদের হয়নি। আমরা শুধু আন্দোলন করেছি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। চাকরিতে সুযোগ-সুবিধার জন্য। কোটা থাকবে কি থাকবে না সে জন্য, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ না ৩৫, সে জন্য। কিন্তু খুব ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই সমাজে যে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজন ছিল সেটি কিন্তু ঘটেনি। পূর্ণ বিকশিত গণতন্ত্র আদতে সাম্যবাদের কথাই বলে। স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর কথা বলে। ব্যক্তি স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারবেন। অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হবেন না। এবং মতপার্থক্য থাকলেও সবার সঙ্গে সৌহার্দ্যভাব বজায় রাখবেন। কেউ কারও ওপর কোনো সিদ্ধান্ত বা মতাদর্শ চাপিয়ে দেবেন না বা মতাদর্শকে মেনে চলার জন্য বলপ্রয়োগ করবেন না।
গণতন্ত্রের ইতিবাচক দিকটিকে সামনে রেখে আমাদের তা অর্জনে কাজ করে যেতে হবে। আর আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই রাষ্ট্রের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তবে সবার আগে আমাদের সমাজে গণতন্ত্রের ধারণাকে বিস্তৃত করতে হবে। শিক্ষা কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে তো বটেই, এর পাশাপাশি বিভিন্ন শহরে, পাড়া-মহল্লায় ছোট ছোট পাঠাগার, পাঠচক্র, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজনের ভেতর দিয়ে একটি যুক্তিশীল, মানবিক ও শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে তুলতে হবে। একে একটি আন্দোলনে রূপ না দিতে পারলে আমরা আমাদের ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না। নিজেকে নতুন মানুষে পরিণত করতে হলে নিজেকেই আগে ভাঙতে হবে। মানুষই সমাজ গঠন করে, সমাজ থেকে হয় রাষ্ট্র। এই সত্য অনুধাবন না করলে, সোনার হরিণ চিরকালই অধরা থেকে যাবে।
লেখক: বিধান রিবেরু, প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক
গণতন্ত্রের জন্য আমরা প্রতিনিয়ত লড়াই করে চলেছি। গণতন্ত্রের দেখা কি মিলছে? গণতন্ত্র কি কেবল নির্দিষ্ট সময় পরপর ভোটাধিকার? নাকি জনগণের যেমন খুশি তেমন বিচার-আচার? সাধারণ ধারণায় গণতন্ত্র মানে স্রেফ স্বাধীন ও সুষ্ঠুভাবে ভোট প্রদানের অধিকার বোঝায় না, নাগরিকের সমান মানবাধিকারকেও বোঝায়। পরিতাপের বিষয়, এক মানবই আরেক মানবের অধিকার কেড়ে নেয় ক্ষমতা পেলে।
প্লেটো স্বপ্ন দেখেছিলেন একজন ফিলোসফার কিংবা দার্শনিক রাজার হাত দিয়ে রাজ্য পরিচালনা হলে তা সুষ্ঠু হবে। কিন্তু তিনি এটাও বলতে ভোলেননি, সেই দার্শনিক রাজা, বোধবুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও, ক্ষমতার গজদন্ত মিনারে চড়ার পর দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে যেতে পারেন। কাজেই গণতান্ত্রিক উপায়ে কাউকে ক্ষমতায় বসালেই কেবল হয় না, গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য প্রতিনিয়ত পাহারা দিতে হয়। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে যাঁরা ক্ষমতায় গেলেন তাঁরা স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারেন, স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারেন, দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে যেতে পারেন, এমনকি তাঁরা নিজেদের অদক্ষতার স্বাক্ষরও রাখতে পারেন।
প্লেটো গণতন্ত্রের সমালোচনা করতে গিয়ে একটি রূপক গল্পের অবতারণা করেছিলেন। ধরুন, জাহাজের যিনি কাপ্তান, তিনি সমুদ্রের নাড়িনক্ষত্র জানেন। ঢেউয়ের গতিবিধি তাঁর মুখস্থ। কিন্তু জাহাজের অন্য নাবিকেরা যদি নির্বাচনের মাধ্যমে এমন একজনকে তাঁদের কাপ্তান বানান, যাঁর জাহাজ পরিচালনার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, এমনকি সাগরের মতিগতি তিনি বুঝতে পারেন না, তদুপরি তিনি আগ্রহী নন, তাহলে ওই গোটা জাহাজের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যাবে? কাজেই বলা যায়, গণতন্ত্র ভালো জিনিস, কিন্তু একে বুঝেশুনে ব্যবহার করতে হবে। ব্যবহার করবে কে? এই জনগণ। কিন্তু জনগণকে তো আগে শিক্ষিত হতে হবে। আগে তাদের বুঝতে হবে, কোন কাপ্তান তাদের জাহাজকে ভেড়াতে পারবে তীরে।
অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে, ফরাসি বিপ্লবের রক্তরঞ্জিত ইতিহাস থেকে স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ধারণাটি অধুনা গণতন্ত্রের ধারণার সঙ্গে এসে ভালো করে মিশেছে। রাজতন্ত্রের উৎখাতের ভেতর দিয়ে গণতন্ত্রের যাত্রা ধরা যায় ফরাসি বিপ্লবকে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, ওই যাত্রাপথেই কিন্তু অভ্যন্তরীণ সংঘাত, অবিশ্বাস ও কর্তৃত্ববাদী শাসনও প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। নেপোলিয়ন বোনাপার্টের মতো লোক ইতিহাসে আবির্ভূত হয়েছিলেন, যাঁর মননে ছিল সাম্রাজ্যবাদ। এসব বলে আমি মোটেও ফরাসি বিপ্লবকে ছোট করছি না, বরং বলার চেষ্টা করছি, আধুনিক গণতন্ত্রের ধারণায় ফরাসি বিপ্লবের শিক্ষা গৃহীত হয়েছে। কী সেই শিক্ষা? গণতন্ত্র শুধু প্রতিষ্ঠা করলেই হয় না, তাকে রক্ষণাবেক্ষণ, পাহারা ও দিকনির্দেশনা দিতে হয়। এই দায়িত্ব জনগণেরই।
এখন গণতন্ত্রের ধারণাটা হলো, জঁ-জাক রুশো যেমনটা বলেন, রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সমাজে আগে থেকে গণতন্ত্র বিরাজ করতে হয়। এটা অনেকটা প্লেটোর ধারণা তত্ত্বের মতো। ধরা যাক, আমরা প্রতিদিন কত কত চেয়ার তৈরি করছি। সব চেয়ারের চেহারা কিন্তু এক নয়। তবে চেয়ারসংক্রান্ত সবার ধারণা কিন্তু এক। ঠিক সে রকম দেশে দেশে গণতন্ত্রের চেহারা এক নয়। যুক্তরাষ্ট্রে এক রকম, ভারতে আরেক রকম, আবার বাংলাদেশে আরও ভিন্ন রকম। রূপ ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু গণতন্ত্রের ধারণা তো একটাই—মানুষ তার নাগরিক ও মানবিক অধিকার নিয়ে, সবার সঙ্গে সমান মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকবে। এবং সে যে রাষ্ট্রে বসবাস করবে, সেখানে সে তার মত ও চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে পারবে বিনা বাধায়। একটু উল্টো দিক থেকে বললে, সে এমন কিছু করবে না, যাতে অন্যের স্বাধীনতা বা শান্তি বিনষ্ট হয়। অর্থাৎ অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহনশীল থাকবে।
এখন প্রশ্ন করুন, বাংলাদেশে বারবার গণতন্ত্র হোঁচট খাচ্ছে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আরও একটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। আমাদের সমাজে কি গণতন্ত্রের ধারণা বিরাজ করে? গণতন্ত্র যদি নাগরিক ও মানবাধিকারের বিষয় হয়, তাহলে সেটা অন্যের বেলায় আমরা কতটা সচেতন? সামষ্টিকভাবে আমরা কি অসচেতন, লোভী, হিংস্র, অসহিষ্ণু ও দখলদারি মানসিকতার পরিচয় বহন করি না? প্রাত্যহিক জীবনের নানাবিধ উদাহরণ থেকেই বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া যায়। ধরুন, নাগরিক অধিকারের কথা যদি বলি, প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার রয়েছে রাজধানীর ফুটপাত ব্যবহার করার।
কিন্তু আমরা কি ব্যবহার করতে পারছি? দখলদারদের কবলে কেবল ফুটপাত নয়, নদী-নালা-খাল-বিল, এমনকি বাচ্চাদের খেলার মাঠ, সবই তো তাদের দখলে।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে দেখুন, একজনের সঙ্গে মতের অমিল ঘটলেই আমরা অসহিষ্ণু হয়ে বাস্তবে তার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে জীবন বিপন্ন করে তুলছি। রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে আমরা মানুষ পিটিয়ে মেরে ফেলছি। রাস্তাঘাটে ‘আমি আগে যাব’, ‘আমি আগে খাব’— এমন ধারণার লোকজন দিয়ে ভর্তি। আমরা একটা চরম স্বার্থপর, নির্লজ্জ ও লোভী সমাজ প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছি। এটা কেন হলো, সেই বিচার করবেন সমাজবিজ্ঞানীরা। কিন্তু সমাজ যে রূপ ধারণ করেছে তা কিন্তু খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে।
এখন যে সমাজে নির্লজ্জ স্বার্থপরতাই মূল ধারণা হিসেবে বিরাজ করে, সেখানে মানুষ গণতান্ত্রিক হয়ে উঠতে পারে না। আর এর প্রতিফলন তো রাষ্ট্রের পরিচালনার ক্ষেত্রে ঘটবেই। দেশের জনগণ যেমন, তার শাসকগোষ্ঠীও তেমনই হবে। এটাই তো স্বাভাবিক।
আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চাই, তাহলে সমাজে গণতন্ত্রের ধারণা নিয়ে কাজ করতে হবে। আগে মানুষের মননে গণতন্ত্রের চেতনাকে জাগ্রত করতে হবে। সেটা সম্ভব সমন্বিত দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপের মাধ্যমে। পরিবর্তনটা শুরু করতে হবে নিজের বর্তমানকে বিলুপ্ত করার ভেতর দিয়ে। আমরা যে অস্থিরতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, তাকে সুস্থির করার আর কোনো বিকল্প নেই—নিজের বর্তমানকে বিলুপ্ত করা ছাড়া। আমাদের বিদ্যালয় ও পরিবারে পরিবর্তনের সূচনা করতে না পারলে আমাদের সামাজিক ধারণায় কখনোই গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে পারব না। সমাজে সুকুমার বৃত্তি আগে যা-ও ছিল, এখন কমতে কমতে শূন্যের কোঠায়। কয়টা বাসায় এখন আর পারিবারিক পাঠাগার দেখতে পাওয়া যায়? কয়টা সামাজিক অনুষ্ঠানে এখন বাংলা সংস্কৃতির চর্চা দেখা যায়? অধিকাংশ পরিবারের বড়রা মোবাইল ফোনে চটুল ভিডিও দেখছে, ছোটরাও সেসব অনুসরণ করছে। বিয়ে বা জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমরা নিম্নরুচির হিন্দি গান বাজাচ্ছি, শিশুদের মননও সেভাবে তৈরি হচ্ছে।
শিশুর যুক্তিশীল মন ও গণতান্ত্রিক মানস গঠনের পেছনে যে ধরনের সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন ছিল, সেটা আমাদের হয়নি। আমরা শুধু আন্দোলন করেছি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য। চাকরিতে সুযোগ-সুবিধার জন্য। কোটা থাকবে কি থাকবে না সে জন্য, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ না ৩৫, সে জন্য। কিন্তু খুব ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই সমাজে যে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজন ছিল সেটি কিন্তু ঘটেনি। পূর্ণ বিকশিত গণতন্ত্র আদতে সাম্যবাদের কথাই বলে। স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর কথা বলে। ব্যক্তি স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারবেন। অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হবেন না। এবং মতপার্থক্য থাকলেও সবার সঙ্গে সৌহার্দ্যভাব বজায় রাখবেন। কেউ কারও ওপর কোনো সিদ্ধান্ত বা মতাদর্শ চাপিয়ে দেবেন না বা মতাদর্শকে মেনে চলার জন্য বলপ্রয়োগ করবেন না।
গণতন্ত্রের ইতিবাচক দিকটিকে সামনে রেখে আমাদের তা অর্জনে কাজ করে যেতে হবে। আর আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই রাষ্ট্রের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তবে সবার আগে আমাদের সমাজে গণতন্ত্রের ধারণাকে বিস্তৃত করতে হবে। শিক্ষা কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে তো বটেই, এর পাশাপাশি বিভিন্ন শহরে, পাড়া-মহল্লায় ছোট ছোট পাঠাগার, পাঠচক্র, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজনের ভেতর দিয়ে একটি যুক্তিশীল, মানবিক ও শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে তুলতে হবে। একে একটি আন্দোলনে রূপ না দিতে পারলে আমরা আমাদের ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব না। নিজেকে নতুন মানুষে পরিণত করতে হলে নিজেকেই আগে ভাঙতে হবে। মানুষই সমাজ গঠন করে, সমাজ থেকে হয় রাষ্ট্র। এই সত্য অনুধাবন না করলে, সোনার হরিণ চিরকালই অধরা থেকে যাবে।
লেখক: বিধান রিবেরু, প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক
পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী কার্টুনিস্ট অ্যান টেলনেস মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে পদত্যাগ করেছেন। তাঁর এই চাকরিত্যাগের খবর এখন বিশ্ব মিডিয়ায় এক আলোচিত বিষয়। একটি পত্রিকা থেকে একজন কার্টুনিস্টের পদত্যাগের খবরটি বিশ্বব্যাপী চাউর হতো না যদি তা নিছক সাদামাটা পদত্যাগ হতো।
১১ ঘণ্টা আগেবাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পন্ন হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে তিনি তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসায়ই ছিলেন। অন্য সব সহকর্মীকে আত্মগোপনে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের পরামর্শ দিলেও তিনি নিজে আত্মগোপনে যাননি।
১১ ঘণ্টা আগে‘বেচারা’ তহিদুল ইসলাম নীলফামারীর ডিমলার বালাপাড়া ইউনিয়নের ভূমি কার্যালয়ের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা। কোটা সংস্কার থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের নামে যে বিশাল সব ঘটনা ঘটে গেল দেশে, তার খবর সম্ভবত তিনি পাননি। তিনি ভেবেছিলেন, যেভাবে ভূমি অফিসে ‘সেবা’ দানের বিনিময়ে ‘ব্যক্তিগত সেবা’ লাভের সুযোগ তৈরি করে নিয়েছেন...
১১ ঘণ্টা আগেকদিন ধরেই একটা বিষয় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। মানুষের জন্য কোনটা কঠিন—মনে রাখা, নাকি ভুলে যাওয়া? সহজ—কোনটা কত সহজে ভুলে যাওয়া যায়। বাংলাদেশের মানুষের জন্য এটাই যেন সত্য—সহজে অবলীলায় ভুলে যাওয়া। আমরা যাঁরা দেশভাগের সময় জন্মেছি, তাঁদের জীবনেই কত কিছু ঘটে গেল! যদিও সে সময়ের দাঙ্গা দেখিনি কিন্তু...
১ দিন আগে