হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

৪৩তম বিসিএস প্রজ্ঞাপন

বঞ্চিতদের অপরাধ কী?

শরিফুল হাসান

প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮: ৪১
শরিফুল হাসান

‘৪৩তম বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে প্রথমবার গেজেটভুক্ত হই। ওই গেজেট বাতিল করে পুনরায় যখন গেজেট হলো, দেখি আমার নামটা নেই। কখনো রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িত ছিলাম না। বরং আরেকটা সরকারি চাকরি করছি। কেন আমাকে গেজেট থেকে বাদ দেওয়া হলো জবাব কে দেবে?’

৪৩তম বিসিএসের গেজেট প্রকাশের পর এভাবেই ইনবক্সে কথাগুলো জানান মোতাসিন সায়েম। একই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন নাসরিন সুলতানা, অপূর্ব সাহা, নিশাত জাহান, শ্যামল মল্লিকসহ আরও অন্তত ২২২ জন প্রার্থী। ৪৩তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফলে উত্তীর্ণ হলেও চাকরিতে যোগদানের প্রজ্ঞাপনে তাঁদের নাম নেই। কিন্তু কেন সেই প্রশ্নের উত্তরও জানা নেই। সে কারণেই বোধ হয় শিপন দে নামের একজন কষ্ট থেকে লিখেছেন, ‘ঠিক কী কারণে গেজেট থেকে বাদ পড়লাম জানতে পারলে ৪৪ বিসিএসের ভাইভা দিতে যাব কি না সেই সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হতো!’

২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর ৪৩ বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল পিএসসি। প্রায় সাড়ে ৪ লাখ প্রার্থী এতে অংশ নেন। প্রিলিমিনারি, লিখিত, মৌখিক সব পরীক্ষা শেষ করতে করতে সময় লাগে তিন বছর। ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করে ২ হাজার ১৬৩ জনকে ক্যাডার পদে নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি। এরপর তাঁরা জনপ্রশাসনের গেজেটের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু জুলাই থেকে আন্দোলন, এরপর ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনে, বারবার পুলিশি যাচাইয়ে গেজেট প্রকাশে বিলম্ব হতেই থাকে। এরপর ১৫ অক্টোবর যোগদানের প্রজ্ঞাপন প্রকাশ হয়। তাতে ৯৯ জন বাদে পড়েন। এর মধ্যে ৪৫ জন স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অংশ নেননি, বাকি ৫৪ জন নেতিবাচক প্রতিবেদনের কারণে বাদ পড়েন।

ওই প্রজ্ঞাপনে বাকি ২ হাজার ৬৪ জন প্রার্থীকে ২০২৪ সালের ১৭ নভেম্বর চাকরিতে যোগদান করতে বলা হয়। দীর্ঘ চার বছরের অপেক্ষার পর এই প্রজ্ঞাপন পেয়ে যে যেখানে চাকরি করতেন তা ছেড়ে যোগদানের প্রস্তুতি নেন। কিন্তু ২৮ অক্টোবর রাতে হঠাৎ করেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যোগদানের তারিখ পিছিয়ে ১ জানুয়ারি নির্ধারণ করে। তবে এর কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। তবে এর মধ্যে আবার পুলিশ-গোয়েন্দাদের দিয়ে যাচাই শুরু হয়। এরপর আগের গেজেট বাতিল করে ৩০ ডিসেম্বর নতুন গেজেট প্রকাশ করা হয়। এভাবে কোনো বিসিএসে একই সরকারের আমলে প্রজ্ঞাপন বাতিল করে আরেকবার প্রজ্ঞাপন প্রকাশের নজির নেই। তবে দ্বিতীয়বার প্রকাশিত এই ফলে নতুন করে আরও ১৬৮ জন বাদ পড়েছেন। এর ফলে এক বিসিএসেই যাচাইয়ের নামে অন্তত ২২২ জনকে বাদ দেওয়া হলো, যেটি নজিরবিহীন।

বাদ পড়াদের প্রায় সবার অভিযোগ, তাঁরা কখনো কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ছিলেন না। কিন্তু তারপরেও গোয়েন্দা প্রতিবেদনে রাজনৈতিক বিবেচনা, বিশেষ জেলায় বাড়ি কিংবা ধর্মের বিষয়টি সামনে এসেছে বলে অভিযোগ তাঁদের। দীর্ঘ চার বছরের অপেক্ষা আর অক্লান্ত পরিশ্রমে বিসিএসে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়ে এভাবে বাদ পড়ায় সব প্রার্থীই ভীষণ হতাশা প্রকাশ করেছেন। অনেকেই বলেছেন তাঁদের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে।

সোহানা আরেফিন লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি হই। বাসা ভাড়া করে থাকার মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই বলে প্রথম বর্ষে হলে উঠি রাজনৈতিক গণরুমে। কয়েক মাস পর নিয়ম অনুযায়ী সিট পেয়ে পলিটিক্যাল রুম ছাড়ি। অথচ আমার গেজেট আটকে গেল। এই কষ্ট কাকে বোঝাব? আমার অপরাধটা কী?’

একজন লিখেছেন, গোপালগঞ্জে বাড়ি হওয়া কিংবা হিন্দু হওয়া কি কোনো অপরাধ? মতিউর রহমান নামে আরেকজন বলেছেন, ‘স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কোথাও আমি রাজনীতি করিনি। বাবা কৃষক। প্রথম গেজেটে নাম থাকলেও দ্বিতীয় গেজেটে নেই। কেন আমাদের সব স্বপ্ন কেড়ে নেওয়া হলো? আমাদের অপরাধটা কী?’

বাদ পড়াদের গল্পগুলো প্রায় একই। অধিকাংশই দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। লেখাপড়া নিয়েই ছিলেন। আসলে বিসিএসের চূড়ান্ত ফল হওয়ার পর আইনগতভাবে কাউকে আটকে রাখার সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরেও দেখা যায় রাজনৈতিক ভিন্নমত খোঁজার নামে তুচ্ছ সব কারণে সব আমলে কেউ না কেউ বাদ পড়েন।

এর আগে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরে ২৮তম ব্যাচ থেকে ৪২তম ব্যাচ পর্যন্ত অন্তত ২৬৫ জন প্রার্থীর নিয়োগ আটকে ছিল। তবে সরকারের পতনের পর গত ১৪ আগস্ট তাঁদের সবার নিয়োগের গেজেট হয়েছে। কিন্তু পুরোনো অপচর্চা বন্ধ হয়নি।

কেবল ৪৩ বিসিএস নয়, রং খোঁজার এই চেষ্টায় সংকটে পড়েছেন ৪০তম বিসিএসের ৬৬ জন শিক্ষানবিশ সহকারী পুলিশ সুপারও (এএসপি)। প্রায় ১৫ মাস হয়ে গেলেও তাঁদের পাসিং প্যারেড হয়নি। কাউকে অবাক করা সব কারণ দর্শানোর চিঠি দিয়ে বলা হচ্ছে, প্রশিক্ষণ চলাকালে তাঁরা ‘ধীরে’ হেঁটেছেন। এগুলো হয়রানি আর অপচর্চা। ফৌজদারি অপরাধের বাইরে অন্য কোনো তথ্য যাচাই করার কথা না থাকলেও নানা ধরনের নেতিবাচক প্রতিবেদন দিয়ে অনেক তরুণের স্বপ্ন শেষ করে দেওয়া হয়। লাখ লাখ প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে একজন প্রার্থী যখন বিসিএসে চূড়ান্ত উত্তীর্ণ হন, তখন যেকোনো অজুহাতে বাদ দেওয়ার এই ধরনের অপচর্চা ভীষণ অনাকাঙ্ক্ষিত।

নেতিবাচক এসব প্রতিবেদন বা রাজনৈতিক রং খোঁজার বদলে একজন কর্মকর্তার নিয়োগ থেকে শুরু করে বদলি, পদোন্নতি—সবকিছুতে মেধা, সততা ও যোগ্যতাই বিবেচ্য হওয়া উচিত। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে জুলাই-আগস্টের আন্দোলন কিন্তু এই ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধেই হয়েছিল। কাজেই ৪৩তম বিসিএসে বাদ পড়াদের তথ্য পুনরায় যাচাই করে কোনো অপরাধ না পাওয়া গেলে দ্রুত যোগদানের সুযোগ দেওয়া উচিত। কাঙ্ক্ষিত ও সুন্দর সুশাসনের একটি বাংলাদেশ গড়তে হলে যাচাইয়ের নামে এই ধরনের অপচর্চা বন্ধ করতেই হবে। নতুন বছরে, নতুন সময়ে নতুন এক বাংলাদেশের জন্য তারুণ্যের এই চাওয়া নিশ্চয়ই অন্যায় নয়!

লেখক: শরিফুল হাসান, কলামিস্ট ও বিশ্লেষক

এই দেশে একটি নির্বাচন হতে হবে

আগামীর বাংলাদেশ, পজিটিভ বাংলাদেশ

বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার যোদ্ধা

সংবিধান কি ছেলের হাতের মোয়া