হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার যোদ্ধা

ফয়সাল শাহরিয়ার

প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭: ৫২
আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭: ৫২
শহীদ সিরাজুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

৮ আগস্ট ১৯৭১ সাল। তরুণ মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম তদানীন্তন বৃহত্তর সিলেট জেলার অন্তর্ভুক্ত সুনামগঞ্জ মহকুমার আওতাধীন গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর সাচনা বাজারের অদূরে তাঁর এলএমজি পোস্টে অবস্থান করছিলেন। তখন সুনামগঞ্জের সাচনা বাজারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি শক্তিশালী অবস্থান ছিল।

শ্রাবণ মাস। তখন প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। সারা রাত টিপটিপ বৃষ্টির ফলে সিরাজুল ইসলাম এলএমজির সাইটে তাঁর দৃষ্টি সঠিকভাবে নিবদ্ধ করতে পারছিলেন না। ইতিমধ্যে ভোরের অস্পষ্ট আলোয় সিরাজুল ইসলামের মুক্তিযোদ্ধা প্লাটুনের অবস্থান ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠায় তিনি কিছুটা চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ছিলেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সিরাজুল ইসলামের আশঙ্কাকে বাস্তবায়িত করে সাচনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তিশালী অবস্থান থেকে একই সঙ্গে তিনটি এলএমজি মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তিযোদ্ধারা যথেষ্ট অসুবিধাজনক অবস্থায় পড়ে যান। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন অল্প সময়ের মধ্যেই গুরুতর আহত হন।

সিরাজুল ইসলাম উপলব্ধি করতে সক্ষম হন যে অবিলম্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাংকারগুলোকে নিষ্ক্রিয় করা না গেলে তাঁদের প্লাটুনটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। এক সহযোদ্ধাকে কাভারিং ফায়ার দিতে বলে তরুণ সিরাজুল ইসলাম কয়েকটি গ্রেনেড নিয়ে একাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাংকারগুলোকে ধ্বংসের লক্ষ্যে এগিয়ে যান। শত্রুর দুটি বাংকার সফলভাবে ধ্বংস করলেও তৃতীয় বাংকারে গ্রেনেড চার্জ করার সময় তিনি অরক্ষিত অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হন।

মুমূর্ষু অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলামের মনে পড়ে যায় স্নেহের ছোট বোন মনোয়ারার কথা। পিতা মকতুল হোসেনের একমাত্র পুত্রসন্তান সিরাজুল ইসলামের স্বপ্ন ছিল তাঁর ছোট দুই বোনকে এমনভাবে বড় করবেন, যাতে তারা পুত্রসন্তানের সমতুল্য হয়ে বেড়ে ওঠে। সিরাজুল ইসলামের অনুপস্থিতিতে কি তাঁর বাবা সে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন?

গুরুতর আহত সিরাজুল ইসলামকে তাঁর সহযোদ্ধারা নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সহযোদ্ধাদের সব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম পথে শাহাদাত বরণ করেন। পরে তাঁকে নিকটবর্তী টেকেরহাট নামক স্থানে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় সমাধিস্থ করা হয়।

সিরাজুল ইসলাম ১৯৫২ সালের ৩ মার্চ তদানীন্তন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার আওতাধীন কিশোরগঞ্জ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) দুর্গম হাওর অঞ্চলের ইটনা উপজেলার ছিলনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব-কৈশোরে সিরাজুল ইসলাম ইটনা উপজেলা সদরে অবস্থিত মহেশচন্দ্র শিক্ষানিকেতনে শিক্ষা গ্রহণ করেন। ওই স্কুল থেকেই তিনি ১৯৬৭ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তদানীন্তন কিশোরগঞ্জ মহকুমা সদরে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী গুরুদয়াল কলেজে ভর্তি হন।

ওই সময় প্রকৃতপক্ষে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ একটি যুগসন্ধিক্ষণ অতিক্রম করছিল। তরুণ ছাত্রদের অনেকেই পরাক্রমশালী সামরিক শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের জনগণের সফল সংগ্রাম দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তরুণ সিরাজুল ইসলামও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। উপরন্তু এ সময়ে তিনি কিশোরগঞ্জের তৎকালীন বিখ্যাত বামপন্থী নেতা আইয়ুব রেজা চৌধুরীর সংস্পর্শে আসেন। অনেকাংশে আইয়ুব রেজা চৌধুরীর অনুপ্রেরণাতেই তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে জড়িত হন।

১৯৬৯ সালের ছাত্র-জনতার আইয়ুববিরোধী আন্দোলন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে।’ ৬৯-এর গণ-আন্দোলনের শহীদ আসাদ হয়ে ওঠেন সিরাজুল ইসলামের আদর্শ। ইতিমধ্যে সিরাজুল ইসলাম ১৯৬৯ সালে গুরুদয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে একই কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে গুরুদয়াল কলেজের ইউনিয়ন নির্বাচনে সিরাজুল ইসলাম ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু ছাত্রলীগের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জন্য ওই বছর গুরুদয়াল কলেজে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণের ওপর চরম হিংস্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু বাঙালি জাতি প্রথম দিন থেকেই যথাসাধ্য প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাঙালির ওই বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ এবং তৎপরবর্তী জনযুদ্ধ তরুণ সিরাজুল ইসলামের জন্য ছিল তাঁর স্বপ্নের বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার একটি সুবর্ণ সুযোগ। প্রয়োজনীয় সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য সিরাজুল ইসলাম ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসেই প্রতিবেশী দেশে যান। সেখানে ইকো ওয়ান প্রশিক্ষণকেন্দ্রে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে তিনি বাংলাদেশে ফিরে এসে ৫ নম্বর সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সিরাজুল ইসলাম পরে কৃতিত্বের সঙ্গে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নেন। ৮ আগস্ট তিনি অতুলনীয় বীরত্ব প্রদর্শন করে সুনামগঞ্জের সাচনা বাজারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন।

বিজয়ের পরে বাংলাদেশ সরকার শহীদ সিরাজুল ইসলামকে বীরত্বসূচক ‘বীর বিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করে। কিন্তু যে বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯ বছরের তরুণ সিরাজুল ইসলাম আত্মবিসর্জন দিয়েছিলেন, বিগত ৫৩ বছরেও তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। সম্ভবত আশা করা অন্যায় হবে না যে বাংলাদেশের বর্তমান তরুণ প্রজন্ম সেই স্বপ্নের বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশকে বাস্তব রূপ দান করবে।

ফিরে চল মাটির টানে

ট্রাম্পের শপথ ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ

যে আগুন জ্বলেছিল

এই দেশে একটি নির্বাচন হতে হবে