বাংলাদেশে বটতলার একজন উকিল ছিলেন। বটতলার হলে কী হবে, তিনি ছিলেন ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ গভর্নর—জবরদস্ত শাসক মোনায়েম খান। তাঁর দাপটে পূর্ব পাকিস্তান ছিল কম্পমান। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের এই স্বৈরশাসক একবার তাঁর ওস্তাদ ‘পাকিস্তানের’ স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের কাছ থেকে হুকুম পান পূর্ব পাকিস্তানে কত গরু-ছাগল বিগত ঝড়ে মারা গেছে, তার তথ্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দিতে হবে। যথারীতি হুকুম গভর্নরের অফিস থেকে জেলা শাসক হয়ে মহকুমা শাসক হয়ে সিও (ডেভ) (বর্তমান ইউএনও)-এর অফিসে যায়। মাত্র ২৪ ঘণ্টা সময়। এর মধ্যে কী করে এই পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা হবে, এই চিন্তায় তরুণ সিও (ডেভ)-এর মাথা গরম। এমন সময় এক চৌকিদার তাঁকে বলল, ‘স্যার, দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি আপনাকে কাল সকালের মধ্যে মৃত গরু-ছাগলের হিসাব জোগাড় করে দেব।’
‘কীভাবে?’ সিও (ডেভ)-এর প্রশ্ন। চৌকিদার নির্বিকার। বারবার আশ্বস্ত করছেন অফিসারকে। সত্যি সত্যি পরদিন সকালে চৌকিদার একটি হিসাব নিয়ে আসে—একদম ইউনিয়নওয়ারি। সর্বমোট ৮৯৬টি গরু-ছাগল গত ঝড়ে মারা গেছে। যথারীতি পরিসংখ্যানটি ডিসি অফিসে যায়। ডিসি খুব খুশি। পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। কিন্তু মনে মনে ভারি অখুশি। এত সহজে এই তথ্য কীভাবে জোগাড় হলো? জেরা করার পর তিনি কেরানিকে বললেন পরিসংখ্যান পাঠাতে। তবে এই সংখ্যার সঙ্গে আরও ৪ যোগ করে দিতে বললেন। কারণ, এই অসম্ভব তথ্য পাঠিয়েছে চৌকিদার ও সিও (ডেভ)। আর কেরানি ও ডিসি সাহেব তা সই করে পাঠাচ্ছেন গভর্নরের কাছে আজ। ৮৯৬-এর সঙ্গে ৪ যোগ করে তা করা হলো ৯০০। অর্থাৎ, মৃত গরু-ছাগলের সঙ্গে এই অসম্ভব পরিসংখ্যান পাঠানোর জন্য তাঁরা চারজন যোগ হলেন!
এই ঘটনার কথা বহুবার শোনা। পূর্ব পাকিস্তান আমলে শুনেছি। স্বাধীন বাংলাদেশে শুনেছি। কত বছর হলো? ৫৫-৬০ বছর তো বটেই। দেখা যাচ্ছে, একই কীর্তি চলছে আজও। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর তথ্য জালিয়াতির কথা বারবার বলা হচ্ছে। একবার নয়, দুবার নয়, সরকার যত না বলছে, তার চেয়ে বেশি বলছে সরকারের ‘বন্ধুরা’। একটি প্রতিবেদন কয়েক দিন আগে প্রকাশিত হয়েছে, যার শিরোনাম, ‘তথ্য লুকিয়েছে আগের সরকার’। ভেতরে কী বলা হয়েছে? ভেতরে আছে, ‘আগের সরকারের ১৫ বছরের তথ্য নিয়ে নানা ধরনের বিভ্রাট তৈরি হয়েছে। প্রকৃত তথ্য লুকানোর চেষ্টা করেছে সেই সরকার। ফলে রপ্তানি আয়, মোট দেশজ উৎপাদনের হিসাব (জিডিপি) ইত্যাদি নিয়ে প্রায়ই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।’ কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, তথ্যবিভ্রাটের পেছনে কিছু আছে ভুলের হিসাবায়ন আর কিছু আছে রাজনীতিবিদদের নেতিবাচক ভূমিকা। কারণ, সঠিক তথ্যের অভাবে আর্থিক ও সামাজিক খাতে ঠিক নীতি প্রণয়ন করা সম্ভব নয়।
বলা হচ্ছে তথ্য লুকিয়েছে আগের সরকার। কী নতুন কথা এটা? ১৫ বছরের গত শাসনামলে ‘ভুল’ ‘ম্যানুফ্যাকচারড’ পরিসংখ্যানের ব্যাপারে সবাই অভিযোগ করেছে। অর্থনীতিবিদেরা এ কথা বলেছেন। প্রশাসকেরা বলেছেন। নীতিনির্ধারকেরা বলেছেন। চারদিক থেকে বলা হয়েছে। ১৫ বছর নয়, এর আগেও তা হয়েছে। আমাদের স্মরণশক্তি কম, আমরা ভুলে যাই। পরিসংখ্যান নিয়ে জালিয়াতি চলছে বহুদিন ধরেই। তা না হলে মোনায়েম খানের গল্পের জন্ম হতো না। এমনকি গত সরকারের আমলে দুই মন্ত্রী প্রকাশ্যে সম্মেলনে পরিসংখ্যান নিয়ে বাহাস করেছেন। আমার মনে আছে ধান-চালের কথা। ধানের নতুন মৌসুম। কিন্তু তারপরেও চালের দাম বাড়ছে। কেন? কোনো কারণ খুঁজে কেউ পায় না। যেমন ঘটছে এবারও—বরাবরের মতো। ভালো আমন ফসল হয়েছে। সরকার বলছে বাম্পার ফলন। গুদামে স্টক আছে। কৃষকের হাতেও চাল আছে। আমদানিও জারি আছে। তবু চালের দাম না শুধু, সব পণ্যের দাম বাড়ে। কেউ কোনো কারণ খুঁজে পায় না। সিন্ডিকেটওয়ালারা বাজার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়। বস্তুত সোনার বাংলায় পুঁজি গঠনের মাধ্যম হয়েছে মোটামুটি চারটি—ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা, জনশক্তি রপ্তানি, ভূমির ব্যবসা এবং তৈরি পোশাকের ব্যবসা। একটাও ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি নয়। অথচ এসবই হচ্ছে আমাদের দেশে পুঁজি গঠনের পথ। ওই পথেই সিন্ডিকেটওয়ালারা টাকা বানাচ্ছে। বাণিজ্যমন্ত্রী হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। বড় বড় ব্যবসায়ী যাঁদের এক লাফে সয়াবিনের দাম ৮ টাকা লিটারে বাড়াতে গায়ে লাগে না।
এই যে নীতি, এতে একইভাবে চালের দাম আগেও বেড়েছে, এখনো বাড়ছে। তাই একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী আজ থেকে ৫ বছর আগে বলেছিলেন আমাদের পরিসংখ্যান ঠিক নয়। যদি ঠিক হতো তাহলে আমাদের চাল রপ্তানি করার কথা। কীভাবে? ভাবটা সহজ। প্রতিবছর লোকসংখ্যা কত, তা বলা হচ্ছে। ধান-চালের উৎপাদন কত তা-ও বলা হচ্ছে। একজন মানুষের কত চালের প্রয়োজন, তার হিসাব আছে। সেই হিসাবে বছরে কত চাল লাগবে, তার হিসাবও করা যায়। দেখা যায় ওই আন্তর্জাতিক হিসাবে আমাদের চাল বছরে উদ্বৃত্ত হয়। কিন্তু তারপরও আমরা চাল আমদানি করি। গমের কথা না-ইবা বললাম। একসময় বাঙালি আটা খেত না। স্বাধীনের পরে গমের কথা বললে মানুষ বলত, ‘এই কারণে স্বাধীন?’ আর আজ আমাদের ৬০-৭০ লাখ টন গম আমদানি করতে হয়। অথচ আমরা বলি, খাদ্যশস্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। এটা আত্মপ্রতারণা ছাড়া আর কী? আর এই চাল-গমের জন্য আমরা নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি কয়েকটি দেশের ওপর। এটা কি ভালো লক্ষণ? এখানে তাহলে আমাদের হয় জনসংখ্যার হিসাব ঠিক নয়, নতুবা ধান-চালের উৎপাদনের তথ্য ঠিক নয়।
আবার ধরুন আলুর কথা। এই কিছুদিন আগেও আলু নিয়ে আমাদের কত গর্ব। কয়েক বছর আগে চালের বদলে, ভাতের বদলে আটার রুটি খাওয়ার জন্য এক অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল গান লিখেছিলেন। সে গান গাইয়েছিলেন জনপ্রিয় শিল্পী মমতাজকে দিয়ে। আলুতে আমরা উদ্বৃত্ত। আলু রপ্তানি করতে পারি। আর আজ? এখন আলু আমদানি করতে হচ্ছে। আলুর জন্য হইচই। আলুর মৌসুমে আলুর কেজি ৯০-১০০ টাকা। বিভিন্ন দেশ থেকে আলু আমদানি করতে হয়। তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়াল? চালের তথ্য ঠিক নয়, আলুর তথ্য ঠিক নয়। একইভাবে মসলা, পেঁয়াজ, সয়াবিন তেল, চিনি—কোনোটার তথ্যই ঠিক নয়। আমরা এসব জিনিস যত আমদানি করি, তত জিনিস লাগে কি না জরিপ করে দেখা দরকার। শুধু কি এসব দ্রব্য? না। আরও আছে। রপ্তানির তথ্য ঠিক নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক, রাজস্ব বোর্ড, রপ্তানি উন্নয়ন বোর্ড—একেক প্রতিষ্ঠান একেক কথা বলে। সম্প্রতি রপ্তানির তথ্যে ধরা পড়েছে বড় জালিয়াতি। কিন্তু কারও কি বিচার হয়েছে? যারা এই সর্বনাশ দিনের পর দিন করল, তারা কোথায়? একবার বলা হয়েছিল, এসব হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকসের কারণে। সেখানে পরিসংখ্যানের কোনো লোক নেই। বিভিন্ন জায়গা থেকে খাতিরের লোক দিয়ে এই প্রতিষ্ঠান চালানো হচ্ছে। কেউ কেউ একে ‘বামন’ প্রতিষ্ঠান বলে আখ্যায়িত করেছেন। শুধু কি তাই? কী কেলেঙ্কারিই না করেছি আমরা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিসাবায়নে! ধরে ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের এসব পণ্ডিতদের কি বিচার করা সম্ভব? বর্তমান সরকার তো দেখছি বিচারের ব্যাপারে আগ্রহী। তাহলে পরিসংখ্যান জালিয়াতি করে যারা দেশকে ডুবাল বা ডুবাচ্ছে তাদের বিচার করতে অসুবিধা কী? যে দেশের আমদানি-রপ্তানি তথ্য, জিডিপি তথ্য, মাথাপিছু আয়ের তথ্য, ধান-চালের তথ্য ঠিক নেই, সে দেশের ভবিষ্যৎ কী, ভাবতেই অবাক লাগে! অন্তর্বর্তী সরকার অন্তত এই সমস্যাটার সমাধান করে দিয়ে যাক। খুব বড় কাজ নয়। বর্তমান পরিসংখ্যান ভুল, অতীতেরটা ভুল। অতএব পুরো সিরিজ শুদ্ধ করতে হবে। কাজটা কঠিন। তবু তা করা দরকার। আমরা জানতে চাই, প্রকৃত অবস্থাটা কী। অতীত সরকার কী বলল আর আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কিসে বাহবা দিল, বোঝা দরকার।
লেখক: সাবেক শিক্ষক, ঢাবি; অর্থনীতি বিশ্লেষক