স্কটল্যান্ডে গ্লাসগো রিভারসাইড জাদুঘরে আয়োজন করা হয়েছে এক ব্যতিক্রমী প্রদর্শনী। ব্রিটিশ–ভারতে সাগরে কাজ করা দক্ষিণ এশীয় খালাসিদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রদর্শনী হচ্ছে সেখানে। এই খালাসিরাই ‘লস্কর’ নামে পরিচিত। এই আয়োজনের পেছনে রয়েছে স্থানীয় কমিউনিটি সংগঠন বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশন গ্লাসগো।
মূলত লস্করদের সম্পর্কে গবেষণার অংশ হিসেবে আয়োজন করা হয়েছে এই প্রদর্শনীর। এই গোষ্ঠীটি নিয়ে যারা গবেষণা করছেন, তাঁরা বলেন, লস্কররা ছিলেন ব্রিটিশ জাহাজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। খুবই সাদাসিধা জীবনযাপন করতেন। তাঁদের জীবনযাত্রার ব্যয় ছিল খুব সামান্য। তাঁদের মজুরি দেওয়া হতো যৎসামান্য। অধিকাংশ লস্কর ছিলেন মুসলিম। তাঁরা মদ্যপান করতেন না। যেকারণে ঝগড়া–বিবাদে কম জড়াতেন। এসব কারণেই ব্রিটিশ জাহাজ কোম্পানিগুলো খালাসি নিয়োগের ক্ষেত্রে এই বাঙালিরাই ছিলেন প্রথম পছন্দ।
ব্রিটিশ আমলে গ্লাসগো শহরে লস্করদের জন্য বিশেষ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। কুইন্স ডকে তাঁদের জন্য আলাদা টয়লেট, একটি হোস্টেল এবং একটি ক্লাব তৈরি করা হয়। প্রদর্শনীতে এই ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হিসেবে একটি ঢালাই লোহার ফলক সংরক্ষিত আছে, যা গ্লাসগোর কুইন্স ডকের একটি শৌচাগারের অংশ ছিল। এতে ইংরেজি লেখা ‘LASCARS ONLY’ আর নিচেই বাংলায় লেখা ‘এই কমতালা খালি নসকরের জন্যে’।
এই প্রদর্শনীতে আরও রয়েছে সি–লাইনার (কার্গো জাহাজ) ভাইসরয় অব ইন্ডিয়া–এর ১: ৪৮ স্কেলের একটি মডেল, যেখানে লস্করদের ছোট ছোট প্রতিকৃতিও রাখা হয়েছে। এ ছাড়া, বেশ কয়েকজন লস্করের গল্পও তুলে ধরা হয়েছে প্রদর্শনীটিতে। যেমন—মুসা আলী, ১৯৫০ সালে গ্লাসগোতে অনিচ্ছাকৃতভাবে তাঁর কাছ থেকে গুটি বসন্ত ছড়িয়ে পড়ে। আছে বাংলাদেশি লস্কর আব্দুল ফাত্তাহর গল্পও। তিনি বাংলাদেশের সিলেটের বাসিন্দা। একবার ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের হাতে বন্দী হয়েছিলেন।
এ ছাড়াও প্রদর্শনীতে লস্করদের জীবনাচরণের ওপর নির্মিত ‘মাউন্টেন অব লাইট’ চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। ইতিহাসের পাশাপাশি পৌরাণিক ও লোককাহিনির মিশেলে সাজানো হয়েছে এই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন গ্লাসগো, গ্লাসগো লাইফ মিউজিয়াম এবং আওয়ার শেয়ারড কালচার হেরিটেজ প্রকল্পের তরুণ সদস্যরা একসঙ্গে কাজ করে এই প্রদর্শনী সম্ভব করেছেন। এর মধ্যে চলচ্চিত্র ছাড়াও ছিল ম্যাগাজিন, পডকাস্ট, ব্লগ এবং অন্যান্য শিল্পকর্ম।
এই প্রদর্শনী লস্করদের ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার পাশাপাশি তাঁদের জীবনসংগ্রামের স্বীকৃতি দিচ্ছে বলে মনে করেন আয়োজকেরা।
প্রকল্প সম্পর্কে যা জানা যায়
১৯৯২ সালে গ্লাসগো মিউজিয়ামে ‘LASCARS ONLY’ লেখা একটি কাস্ট আয়রনের ফলক পাওয়া যায়, যা ১৮৯০–এর দশকে স্টোবক্রস কুই–এর শৌচাগারে ব্যবহৃত হয়েছিল। লস্কররা মূলত দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নাবিক ছিলেন, যারা ইউরোপীয় শিপিং কোম্পানিগুলোর বৈষম্যমূলক শর্তে কাজ করতেন। এ আবিষ্কার গ্লাসগোর বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন, আওয়ার শেয়ারড কালচার হেরিটেজ (ওএসসিএইচ) ও গ্লাসগো লাইফ মিউজিয়ামস–কে এক মঞ্চে আনে। তারা যৌথভাবে লস্করদের ইতিহাস ও স্কটল্যান্ডের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা শুরু করে।
২০২২ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ‘LASCARi’ বা লস্করি নামে একটি নাটক নির্মাণ করে। এটি মঞ্চস্থ হয়েছিল গ্লাসগোর ‘টল শিপ গ্লেনলি’ জাহাজে। এ ছাড়া, ওএসসিএইচ–এর সদস্যরা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, চিত্রকর্ম ও ইতিহাস সংরক্ষণমূলক কাজ করেন। গ্লাসগো লাইফ মিউজিয়াম দুটি সেমিনার ও পপ-আপ প্রদর্শনীর আয়োজন করে, যেখানে দক্ষিণ এশীয় নাবিক ও গবেষকেরা তাঁদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।
২০২৩ সালে দ্বিতীয় পর্যায়ে একটি তথ্যচিত্র, বই ও পডকাস্ট নির্মাণ করা হয়। ‘স্কটল্যান্ডস লস্কর হেরিটেজ’ বইটিতে লস্করদের অজানা ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। প্রকল্পটি একটি আন্তঃপ্রজন্ম উদ্যাপনে পরিণত হয়, যেখানে ইতিহাস, সংস্কৃতি ও দক্ষিণ এশীয় অভিবাসী অভিজ্ঞতার সংযোগ গড়ে ওঠে।
প্রকল্পটি লস্করদের ইতিহাসকে গ্লাসগোর মূলধারায় তুলে এনেছে। গবেষণায় বাংলাদেশি ভাষাবিদ ও নাবিকেরা যুক্ত হন, যার ফলে ঐতিহ্য আরও গভীরভাবে অনুধাবন করা সম্ভব হয়। এই উদ্যোগ সাবেক নাবিক আবদুল ফাত্তাহ-এর মতো অনেকের জন্য জীবন পরিবর্তন করে দেয়। এখানে প্রাপ্ত পারিশ্রমিক দিয়ে তিনি বাংলাদেশে একটি ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলেন।
প্রকল্পটি ২০২৩ সালের ‘মিউজিয়ামস চেঞ্জ লাইভস’ পুরস্কার জিতেছে এবং ‘স্কটল্যান্ডস লস্কর হেরিটেজ’ বইটি ‘সলটায়ার সোসাইটি স্কটিশ রিসার্চ বুক অব দ্য ইয়ার’ মনোনীত হয়।
তথ্যসূত্র: গ্লাসগো লাইফ, দ্য বেস্ট ইন হেরিটেজ